আগস্ট মাস এলেই বাঙালি জাতি যখন শোকে কাতর হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই স্বাধীনতার পরাজিত দেশি-বিদেশি চক্র নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের হোয়াইট নিউজ নামে একটি নিউজ পোর্টাল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্জনকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে জনগণের মধ্যে একটি ভুলবার্তা দেয়ার অপচেষ্টা করে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিকৃত করে জয় বাংলার পরে জয় পাকিস্তান সংযুক্ত করা হয়েছে; এবং বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণকে কাটছাঁট করে বলা হয়েছে যে, তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভাঙতে চাননি, তিনি মুসলিম লীগেরও খাঁটি নেতা ছিলেন।
এসব অপপ্রচার যে নতুন তা কিন্তু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এরা এসব করে আসছে। একসময় তাদের এদেশীয় এজেন্ট জিয়াপুত্র তারেক এরকম শব্দ বোমা ফাটিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেছে। সেও বলেছে শেখ মুজিব ছিলেন পাকিস্তানের বন্ধু, তিনি কখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। এসব উদ্ভট বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমান করা যায়, সবকিছুই একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। যারা কোনোভাবেই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে মেনে নিতে পারছে না। এরকম সস্তা অপপ্রচার চালিয়ে হিমালয়সম বঙ্গবন্ধুকে কি ছোট করা যাবে? বাঙালি জাতির হৃদয়ের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্থান।
পাকিস্তান কখনোই বাংলাদেশের কাছে তাদের করুণ পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই তারা ষড়যন্ত্রের খেলা শুরু করে। আর সবসময় এদেশের কিছু কুলাঙ্গার তাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের প্রথম অপারেশন ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। তারা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুই তাদের পথের কাঁটা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ভাবধারায় পরিচালিত করা যাবে।
বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বোরচিত ঘটনা ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। পৃথিবীতে এরকম নির্মম হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি নেই, যেখানে শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা বধূসহ পরিবারের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিদেশে থাকার কারণে সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। পাকিস্তানি এজেন্ট জিয়া-মোশতাক গং হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয় যা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। নরঘাতকরা তাদের সাাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে গেছে পিছনে থেকে তাদের মদদ দিয়েছে তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়া অবৈধ ক্ষমতা দখল করেই পাকিস্তানি প্রভুদের খুশি করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে এহেন কাজ নেই যা করেননি। একাত্তরের স্বীকৃত রাজাকার শাহ আজিজ, আবদুল আলীম, মাওলানা মান্নানকে বানালেন মন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতের আমির গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব প্রদান ও একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে করা হয় পুনর্বাসিত। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয় দেয়া হয়। দালাল আইন বাতিল করে সাড়ে সাত হাজার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে মুক্তি ও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আসামিদের দেয়া হয় দায়মুক্তি। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের নায়ক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুখথুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি।
পঁচাত্তরের আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা সেদিন হয়তো বুঝতে পারেনি একদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে ঝান্ডা হাতে দাঁড়াবেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে তাদের স্বপ্ন কখনও সফল হবে না। শুরু করে নতুন মিশন। ১৯ বার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। যার সর্বশেষ ছিল বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। যার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে ছিলেন শেখ হাসিনা।
হামলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুইটি কান। হামলায় কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ চব্বিশজন নিহত হন, আহত হয়েছিলেন শত শত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। এ হামলায় মাস্টারমাইন্ডের ভূমিকায় ছিল জিয়াপুত্র তারেক রহমান। হাওয়া ভবনে বসে তারেক রহমান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানফেরত জঙ্গিদের নিয়ে গ্রেনেড হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে। আর এদের গ্রেনেড দিয়ে সহযোগিতা করে পাকিস্তান। যে গ্রেনেডগুলো হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে তা শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীই ব্যবহার করে থাকে। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল জিয়াউর রহমান আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নেতৃত্ব দেয় জিয়াপুত্র তারেক রহমান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে মৌলবাদী পাকিস্তানপন্থি তাঁবেদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আর অপরদিকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭৫ সালে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যা করে তাদের সেই অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা।
কেননা, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে হত্যাকারীরা পরবর্তী ২১ বছরে তাদের এজেন্ডা অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে আবার বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে যেভাবে কাজ শুরু করেছিলেন তাতে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা বুঝে যায় বঙ্গকন্যা থাকলে তাদের আশা অচিরেই দুরাশায় পরিণত হবে, যার ফলে ঘটানো হয় ২১ আগস্টের ভয়াবহ ঘটনা।
শোকাবহ আগস্ট এলেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। কখনো জামায়াত-শিবির চক্রের নাশকতা ও জঙ্গি হামলার চেষ্টা। অপপ্রচার করে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিতর্কিত করার। আবার কখনও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরি করে।
বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভাবাদর্শ বহনকারী বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত। গণবিচ্ছিন্ন হয়ে এসব দলের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। এ জন্য তারা সরকারের বিরুদ্ধে গুজব রটানোর জন্য বেছে নিয়েছে সামাজিক গণমাধ্যমকে। প্রতিনিয়ত ফেসবুক, ইউটিউবে বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এগুলো রাষ্ট্র এবং সরকারকে আক্রমণ করে তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে আগে চাকরি করতেন, দেশে অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন এমন ব্যক্তিদেরকে এসব কাজে লাগানো হয়েছে। আর এদেশে সেগুলো প্রচারের জন্য বিএনপি-জামায়াতের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ক্যাডারদের ব্যবহার করা হচ্ছে। যাতে করে ভিডিওগুলো আপলোড করার পর মুহূর্তেই মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। বিদেশে বসে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার পরিবার, মুক্তিযুদ্ধ ও বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছে সাজাপ্রাপ্ত আসামি তারেক রহমান, সঙ্গে আছে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের দোসর ও তাদের বংশধরেরা। এসব কাজে ব্যয় করা হচ্ছে শত শত কোটি টাকা।
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার মাসকেই ষড়যন্ত্রকারীরা বেছে নেয়া হয়। ১৫ আগস্ট ’৭৫ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী জনসমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা করে পরাজিত শক্তিরা প্রমাণ করেছে তারা কখনও বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারছে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক করোনা মোকাবিলায়ও বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে শেখ হাসিনার সরকার। যেভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকে পাকিস্তানসহ আঞ্চলিক দেশগুলোকে পিছিয়ে ফেলে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তাতে করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা এসব অর্জনকে আর সহ্য করতে পারছে না। শুরু করেছে নতুন ষড়যন্ত্র।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে এসব অপপ্রচারের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক। মিথ্যা বলে কিছু সময়ের জন্য জনগণকে বিভ্রান্ত করা গেলেও যে বেশি সময় সত্যকে আড়াল করা যায় না, এর উদাহরণ বিএনপিই। এক সময় জনগণকে বার বার মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় গেলেও তাদের অবস্থা এখন খাদের কিনারায়। অপপ্রচার করে বাংলাদেশের মানুষকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে, কোনো অপশক্তি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে রোধ করতে পারবে না।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।