বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড: ষড়যন্ত্রের পর্দা সরেনি

  • ড. মো. শাহিনুর রহমান   
  • ১৫ আগস্ট, ২০২১ ১৭:৩৬

এই হত্যাকাণ্ডের যে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং বেশকিছু রাজনীতিক যে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল সে বিষয়গুলো বিচারকাজ শেষ হওয়ার পরও অনেকটা অস্পষ্ট রয়ে গেছে। এ হত্যাকাণ্ডের যে দুটি দিক- একটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আরেকটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, যার কোনোটাই অদ্যাবধি স্পষ্টভাবে এই বিচারে উঠে আসেনি। দেশের প্রচলিত আইনে আর দশটা হত্যাকাণ্ডের বিচার যেভাবে হয়ে থাকে, সেভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বিচারকাজ শেষ হলেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের অনেকেই এখনও রয়ে গেছে দেশের বাইরে। সংঘটনের প্রায় ৩৫ বছর পর এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি জড়িত সাবেক সেনাসদস্যদের দণ্ড দেয়া হলেও বেসামরিক কোনো ব্যক্তির বিচার হতে দেখা যায়নি। বিশ্লেষকরা একমত যে, এটি নিছক হত্যাকাণ্ড নয়, বরং এর পেছনে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। হত্যা মামলার রায়েও যে, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ রয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তার সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার হত্যাকারীদের বিচার না করার বিধান রেখে জারি করে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। দুই দশকেরও পর ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয় এবং এর চূড়ান্ত রায়ে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত এই ১২ জনের সবাই তৎকালীন মধ্যম সারির সেনাকর্মকর্তা যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ড এবং পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছিল।

এই হত্যাকাণ্ডের যে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং বেশকিছু রাজনীতিক যে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল সে বিষয়গুলো বিচারকাজ শেষ হওয়ার পরও অনেকটা অস্পষ্ট রয়ে গেছে। এ হত্যাকাণ্ডের যে দুটি দিক- একটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আরেকটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, যার কোনোটাই অদ্যাবধি স্পষ্টভাবে এই বিচারে উঠে আসেনি। দেশের প্রচলিত আইনে আর দশটা হত্যাকাণ্ডের বিচার যেভাবে হয়ে থাকে, সেভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়েছে।

১৯৯৬ সালে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের যে মামলা দায়ের করা হয়, তাতে সেনাসদস্যদের বাইরে যে কজনকে আসামি করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে মূল একজন খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং আরও দুজন- তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষী আগেই মারা গিয়েছিল, যে-কারণে তাদের নাম আগেই মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়।

১৯৯৮ সালে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নিম্ন আদালত থেকে রায় দেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দীর্ঘ সময় উচ্চ আদালতে আপিলের কার্যক্রম ঝুলে থাকে। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে উচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায় দেন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ৬ জন এখনও যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে এবং একজন মারা গেছে। হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে গঠিত সরকারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার এবং বাকশালের অনেকে যোগ দিয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল মাহবুব আলম চাষী এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ আরও অনেকে।

যে দেশি এবং বিদেশি শক্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, আন্তর্জাতিকভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাহায্য করেছিল, তারা যৌথভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে বলে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ অভিজ্ঞ মহলের অনেকে মনে করেন।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর খোন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান প্রমুখ যারা সরকার গঠন করেছে এবং হত্যাকারীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা সবাই এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মনে করার সুস্পষ্ট অনেক প্রমাণ রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অবস্থা বিবেচনা করলে এর সঙ্গে বেসামরিক একটি অংশের সম্পর্ক রয়েছে বলে বোঝা যায়।

পরবর্তী সময়ে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজনীতিকদের যোগসাজশের বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা বা তদন্ত হয়নি। হত্যামামলার রায়ে ষড়যন্ত্রের কথা বলা হলেও এর পেছনে ঠিক কী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং রাজনীতিকরা ঠিক কীভাবে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল, সে-বিষয়টি মামলায় উঠে আসেনি। হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় আড়াই মাস খন্দকার মোশতাকের সরকার ক্ষমতায় ছিল। এই সময়ের মধ্যে তারা হত্যাকারীদের দায়মুক্তির অধ্যাদেশ জারি করে, কিন্তু তাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী ছিল, তা অনেকটা অস্পষ্টই থেকে গেছে।

মেজর (শরীফুল হক) ডালিম নামে বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা রেডিও স্টেশন দখল করে বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে কোনো পূর্ব আলোচনা বা পরিকল্পনা ছিল, এমন মনে হয় না। পরদিন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোও ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ-এর প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানায় এবং সৌদি আরবকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আনার চেষ্টা করে।

কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে অকস্মাৎ ইসলামি প্রজাতন্ত্র তৈরির ধারণা টেকেনি এবং বিস্ময়কারভাবে খন্দকার মোশতাককেও এ ব্যাপারে আর চেষ্টা করতে দেখা যায়নি। অনেক পরে ১৯৮০’র দশকে ক্ষমতাসীন আরেক সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সংবিধানে সংশোধনী এনে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে এ দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের লেবাস পরানোর একটা চেষ্টা করে।

আওয়ামী লীগের প্রবীণ শীর্ষনেতারাও মনে করেন, হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কিছু বিষয় পূর্ণাঙ্গভাবে উঠে আসেনি। তবে এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক যোগসাজশ ছিল বলে তারাও মনে করেন। তারা এ-ও মনে করেন যে, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যারা জড়িত তাদের বিচার হলেও, একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করা যেত যদি একটি বেসামরিক তদন্ত কমিটি করে এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে কোথায় কীভাবে হয়েছিল এবং আরও কারা কারা নেপথ্যে ছিল, এটা বের করা যেত।

এতে জাতি অবশ্যই উপকৃত হতো এবং তার ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক হতো। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আরও কারা ছিল এবং কী উদ্দেশ্যে ছিল, সেটি নিয়ে গবেষণাসহ আরও তদন্ত এখন সময়ের দাবি। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা, সফল রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। সে কারণে এখনই এই তদন্তের উদ্যোগ নেয়ার সর্বোৎকৃষ্ট সময় বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন।

আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিকভাবে আদালতের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যবস্থা করলেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের দিকটি এখনও সামনে আসেনি। যারা খন্দকার মোশতাকের সরকারে যোগ দিয়েছিল, তাদের অনেকে বিদেশেও গিয়েছিল। এতে মনে হয়, তাদের সবাইকে যে জোর করে এ সরকারে নেয়া হয়েছিল, সেটা ঠিক নয়। জোর করে নিলে বিদেশে গেলে প্রথম সুযোগেই তারা পালিয়ে যেতে পারত।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এমপি সম্প্রতি বলেছেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং যোগসাজশের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই তদন্ত কবে শুরু হবে সেটি এখনও নিশ্চিত নয়, তবে এ বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের কাজ এখনও চলছে। বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন অত্যুচ্চ অবস্থান বিবেচনা করলে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছাড়া গুটিকয়েক বিপথগামী সেনা সদস্য এবং তার নিজের দলের একজন বেঈমান এ ঘটনা ঘটিয়েছে- এটা অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করে আনিসুল হক বলেছেন, প্রকৃত সত্যটা বের করার চেষ্টা এখনও চলছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্মোহ একটি গবেষণা হলে হয়তো ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক অস্পষ্টতাই দূর হয়ে যাবে, এ ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির আগামীর নিরঙ্কুশ অস্তিত্বের স্বার্থে ঝুলির ভেতরে লুকানো বেড়ালগুলো বের করে আনার এখনই সময়।

লেখক: সাবেক উপ-উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

এ বিভাগের আরো খবর