বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বঙ্গবন্ধু ও একটি কষ্টের স্মৃতি

  • মুন্সী আব্দুর রহমান   
  • ১৩ আগস্ট, ২০২১ ১৩:১৮

একটু হেসে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলার সিংহাসন নাহি রবে খালি। বঙ্গ থাকবে, বন্ধু থাকবে না। জাতি থাকবে পিতা থাকবে না। আমার যদি সিংহাসনে থাকতে হয় তা হলে জাতির পিতা আমার থাকা হবে না।’

১৯৭৪ সালের ২৪ জুলাই নুরুল ইসলাম ঠান্ডু ভাই (সাবেক রাকসু ভিপি), সাবেক ছাত্রনেতা মির্জা আনিসুর রহমান ও আমি আব্দুল জলিল ভাইয়ের বাসায় যাই। জলিল ভাইয়ের সঙ্গে যাই গণভবনে । গনভবন গেটে আমাদের জন‍্য অপেক্ষায় ছিলেন মন্নুজান হল ছাত্রী সংসদের ভিপি লাইজু আপা ও নাটোরের আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। উদ্দেশ‍্য রাজশাহী বিশ্ববিদ‍্যালয়ের পক্ষ হতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৌজন‍্য সাক্ষাৎ।

গণভবনে ঢুকে জলিল ভাই বঙ্গবন্ধুর কক্ষে ঢুকতেই তিনি উঠে এসে বললেন, ‘চল লনে বসি।’ আমরা তার সঙ্গে পুবপাশে লনে এসে বসলাম। কর্মচারীরা লনে চেয়ার এনে দিলে বঙ্গবন্ধু মাঝের চেয়ারটায় বসলেন। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন তথ‍্যমন্ত্রী কোরবান আলী, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ ভাই, তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে তিনি আমাদের দেশের পরিস্থিতির ওপর কিছু বললেন এবং ওই দিন মওলানা ভাসানী, মশিউর রহমান যাদু মিয়া ও আতাউর রহমান খানদের পল্টনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশের বিষয়ও জানালেন। বললেন, মুনসুর ভাইকে (তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) বলেছি রাজাকারটাকে (যাদু মিয়াকে) লাল দালানে রেখে আসতে। (যাদু মিয়া রাজাকার ছিলেন, পরবর্তী সময়ে জিয়া জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে তাকে সিনিয়র মন্ত্রী বানান) মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খানকে সম্মানের সঙ্গে বাড়ি পৌঁছে দিতে।

কথা শেষ হতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলী এসে হাজির হলেন। ওনাকে দেখেই বঙ্গবন্ধু আমাদের বসতে বলে তাৎক্ষণিক উঠে গেলেন এবং কিছুক্ষণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওনার সঙ্গে কথা বলে আবার এসে চেয়ারে বসলেন। আমরা কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলাম, গম্ভীর হয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রাজাকারটাকে লালদালানে আতাউর রহমান খানকে নিজবাসায়, মওলানা ভাসানীকে সসম্মানে টাঙ্গাইলের সন্তোষে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং বললেন দেশে যা শুরু হয়েছে তাতে আমার আর ক্ষমতায় থাকা হবে না স্নায়ুযুদ্ধ, বিভাজন, জাসদ সৃষ্টি, আওয়ামী লীগে ভুল বোঝাবুঝি, মোশতাক গ্রুপ সক্রিয়, তাজউদ্দিন আহমেদ, জেনারেল ওসমানী, আবু সাইয়িদ চ‍ৌধুরীসহ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘদিনের অতি বিশ্বস্ত নেতার দূরত্ব সৃষ্টি ও ফায়দা হাসিলের ষড়যন্ত্র। দুর্ভিক্ষ, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সব মিলিয়ে অবস্থা ভালো ছিল না।

লাইজু আপা বললেন, এ সিংহাসন শুধু আপনার। একটু হেসে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলার সিংহাসন নাহি রবে খালি। বঙ্গ থাকবে, বন্ধু থাকবে না। জাতি থাকবে পিতা থাকবে না। আমার যদি সিংহাসনে থাকতে হয় তা হলে জাতির পিতা আমার থাকা হবে না।’ ঠান্ডু ভাই বললেন, তবু আপনারই এই সিংহাসন। বঙ্গবন্ধু হেসে আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আব্দুর রহমান তুই তো আইনের ছাত্র বল তো জাতির পিতা না থাকলে সে জাতির কী হয়? বলেই গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং বলে উঠলেন, সবাই যা শুরু করেছে আমি চাদর গায়ে দিয়ে টুঙ্গিপাড়া চলে যাব।’

১৫ আগস্ট গোপালগঞ্জ-সংলগ্ন মানিকদাহ গ্রামে এমদাদুল হক চৌধুরীর বাড়িতে ছিলাম। সকাল ৬টার দিকে একটি বাচ্চা ছেলে খবর দিল শেখ মুজিবকে হত‍্যার খবর হচ্ছে রেডিওতে। আমি ও চৌধুরী সাহেব লাফিয়ে উঠলাম, রেডিও খুললাম। খবর শুনে নির্বাক হয়ে গেলাম। কানে বেজে উঠল গণভবনে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত ভবিষ্যদ্বাণী ‘বাংলার সিংহাসন নাহি রবে খালি, বঙ্গ থাকবে, বন্ধু থাকবে না। জাতি থাকবে, পিতা থাকবে না। আমি চাদর গায়ে দিয়ে টুঙ্গিপাড়া চলে যাব।’

১০টার দিকে আমি ও চৌধুরী সাহেব শহরে আসি। শহর জনপদ স্তব্ধ ছিল কোথা ও কোন পাখির ডাক, জনপদে কোলাহল ছিল না, বাতাসে ছিল না কোনো স্পন্দন। গভীর উৎকন্ঠায় ১৫ আগস্ট শেষ হলো। পরদিন সকাল ১০টার দিকে হেলিকপ্টারটি দেখা গেল টুঙ্গিপাড়ার আকাশে বাংলা মায়ের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বাধীন বাংলার স্থপতি, জাতির পিতা চাদর গায়ে দিয়ে টুঙ্গিপাড়া আসলেন। ১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর বাল‍্যবন্ধু মোল্লা জালালউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা রইস মিয়া, এমদিদুল হক চৌধুরী বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম‍্যান) আক্তারউদ্দিন মিয়া ও কিছু নেতাকর্মীসহ টুঙ্গিপাড়া যাই। গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করি। অশ্রুতে ভরে ওঠে চোখ। মনে হলো মহাবীর আলেকজান্ডার বলছেন, ‘সেলুকাস বিচিত্র এই দেশ!’ মনে পড়ে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ উ দৌলার মৃত‍্যুর সময়ের শেষ কথাটি- হায়রে অভাগা দেশ!

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, সাবেক ভিপি, এসএম হল ছাত্র সংসদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ‍্যালয় ১৯৭২।

এ বিভাগের আরো খবর