বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তিন কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে এত উদ্বেগ!

  •    
  • ১১ আগস্ট, ২০২১ ১৮:৫৮

অনেকে নিজের নামে না কিনে স্ত্রী-সন্তানদের নামে কেনে। এ রকম বিলাসবহুল ফ্ল্যাটগুলোর মালিক কারা, তাদের মধ্যে কতজন আসলেই এসব ফ্ল্যাট কেনার যোগ্যতা রাখে, কতজন তাদের দৃশ্যমান আয় দিয়ে এসব কিনেছে, তার কোনো ডাটাবেজ কি সরকারের হাতে আছে? যদি না থাকে বা যদি এই ইস্যুতে আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী কাজ না করে বা করতে না পারে, তাহলে শুধু এক পরীমনির সাড়ে তিন কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে মাতামাতি করা অযৌক্তিক।

চিত্রনায়িকা পরীমনি ইস্যুতে বেশ কদিন ধরেই গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে। তবে পরীমনিকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো, তার বাসা থেকে কত বোতল মদ উদ্ধার করা হলো, তার সঙ্গে বিদেশে কথিত প্রমোদভ্রমণে কারা গিয়েছেন ইত্যাদি আলোচনা ছাপিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা দামের একটি গাড়ি আলোচনার সামনে চলে আসছে। বলা হচ্ছে, এই গাড়িটি তাকে কোনো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি উপহার দিয়েছেন। আবার বলা হচ্ছে যে, তিনি নিজেই গাড়িটি কেনার জন্য একদিনের জন্য টেস্ট ড্রাইভে নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেনেননি।

উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ২ মে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) অর্থপাচারের যে তথ্য প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। বলা হয়েছে, আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ভয়েস এবং ওভার ভয়েসের মাধ্যমেই প্রধানত এই অর্থপাচার করা হয়। এবারের প্রতিবেদনে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।

প্রশ্ন হলো, যে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়; বড় প্রকল্প থেকে শত শত কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যায়; হিরার দাম দিয়ে তুলার বালিশ ও কাপড়ের পর্দা কেনা হয়— সেই দেশে মাত্র তিন কোটি টাকা দামের একটা গাড়ি নিয়ে জাতির এত আগ্রহ কেন? রাজধানীর গুলশান বারিধারা এলাকার রাস্তার পাশে দাঁড়ালে এরকম তিন চার কোটি টাকা দামের গাড়ি ঘণ্টায় অন্তত তিন চারটি দেখা যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি এ সব গাড়ির মালিককে গিয়ে জিজ্ঞেস করে যে, তাকে গাড়িটা কে উপহার দিয়েছে বা কত টাকা দাম কিংবা তিনি এত টাকা কোথায় পেলেন? বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি তো বটেই, যে দেশে জনগণের পয়সার বেতন হওয়ায় সরকারি কর্মচারীরাও কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়েন, সেই দেশে একটি তিন কোটি টাকা দামের গাড়ি নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ কেন?

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ২০২০ সালের ২৪ জুন পরীমনির সাদা রঙের হ্যারিয়ার গাড়িটি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার রয়েল ব্লু রঙের মাসেরাতি গাড়ির ছবি প্রকাশ করে জানান, এটি তার নতুন গাড়ি। গাড়িটি নতুন করে আলোচনায় আসে তার গ্রেপ্তার হওয়ার পরে। যদিও নিউজবাংলার একটি খবরে বলা হয়, গাড়িটির মালিকানা পরীমনির নয়। এমনকি সেটি এখন আছে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের শোরুমে। কারণ গাড়িটি পরীমনি কিনতে চাইলেও সেই প্রক্রিয়া আর এগোয়নি।

এই বিলাসবহুল গাড়িটি পরীমনি কিনেছিলেন কি টেস্ট ড্রাইভে নিয়েছিলেন নাকি তাকে উপহার দেয়া হলেও এখন পরিস্থিতির কারণে অন্য কথা বলা হচ্ছে, সেই বিতর্ক পাশে রেখে বরং বলা যায়, ঢাকার রাস্তায় এ রকম বিলাসবহুল গাড়ির সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তো বটেই, সংসদ সদস্যরাও শুল্কমুক্ত সুবিধায় যেসব গাড়ি আনেন, তাও বিলাসবহুল এবং শুল্ক দিয়ে আনতে গেলে সে সব গাড়ির দামও কোটির ওপরে।

যারা এসব দামি গাড়িতে চড়েন, তাদের সবার আয়-ব্যয় কি রাষ্ট্র খতিয়ে দেখে? সবাই কি নিয়ম মেনে ট্যাক্স দেয়? আইনি সুবিধা নিয়ে কালো টাকা সাদা করলেই কি তারা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যাবেন?

রাজধানীর বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও বাড়িগুলোর মালিক কারা? অসংখ্য মানুষের একাধিক দামি ফ্ল্যাট আছে— যাদের একটি ফ্ল্যাটেরও মালিক হওয়ার কথা নয়। অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যাদের বেতন দিয়ে রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর যাত্রাবাড়ীতেও ফ্ল্যাট কিনতে পারার কথা নয়, তারা গুলশান বারিধারা ধানমন্ডিতে কী করে ফ্ল্যাট কেনেন? অনেকে নিজের নামে না কিনে স্ত্রী-সন্তানদের নামে কেনে। এ রকম বিলাসবহুল ফ্ল্যাটগুলোর মালিক কারা, তাদের মধ্যে কতজন আসলেই এসব ফ্ল্যাট কেনার যোগ্যতা রাখে, কতজন তাদের দৃশ্যমান আয় দিয়ে এসব কিনেছে, তার কোনো ডাটাবেজ কি সরকারের হাতে আছে? যদি না থাকে বা যদি এই ইস্যুতে আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী কাজ না করে বা করতে না পারে, তাহলে শুধু এক পরীমনির সাড়ে তিন কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে মাতামাতি করা অযৌক্তিক।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, বর্তমানে কানাডায় স্থায়ী বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা এক লাখের বেশি। মূলত দেশের ধনী ব্যবসায়ী, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের স্ত্রী-সন্তানরা অনেকেই বিনিয়োগ ভিসায় কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন। যাদের বসবাস টরেন্টোসহ অন্যান্য শহরে। বলা হয়, তাদের বড় অংশই সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবার। প্রশ্ন হলো, একজন সরকারি কর্মকর্তা সর্বোচ্চ কত টাকা বেতন পান এবং সেই টাকা দিয়ে কী করে কানাডার মতো দেশে পরিবারের লোকজনকে স্থায়ী করেন? সরকারের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের টাকার কত শতাংশ খরচ হয়, আর কত শতাংশ লুটপাট হয়ে কিছু মানুষের পকেট ভারী হয়, তার বড় উদাহরণ বালিশ ও পর্দাকাণ্ড।

অনেক রাজনীতিবিদের কানাডায় বড় ব্যবসা ও বিলাসবহুল বাড়ি আছে। অনেকের একাধিক বাড়ি আছে। বলা হয়, প্রথমে দেশ থেকে টাকা হুন্ডির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নেয়া হয়। পরে সেই টাকা মধ্যপ্রাচ্যে আয় দেখিয়ে কানাডার কোনো ব্যাংক হিসাবে নিয়ে আসা হয়।

২০১৯ সালে বিবিসির এক খবরে বলা হয়, বিশ্বে অতি ধনী (বাংলাদেশি টাকায় যাদের সম্পদ আড়াই শ কোটি টাকার বেশি) মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত হারে বাড়ছে বাংলাদেশে। প্রশ্ন হলো, মানুষ এত ধনী হয় কী করে? অস্বীকার করার উপায় নেই, লাগামহীন দুর্নীতি, সুশাসন তথা প্রশাসনের সর্বত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকাই অবৈধভাবে ধনী বা সম্পদশালী হওয়ার পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি ঘোষণা, যেকোনো দুর্নীতি চোখে পড়লে বিনামূল্যে কল করে জানিয়ে দেয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের হটলাইন নম্বর (১০৬) চালু, সারা দেশে ৩,৭৩৬টি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, ২৬,১২৩টি সততা সংঘ গড়ে তোলা, দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে জোরালো করার লক্ষ্যে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সারা দেশে টিআইবির ‘সচেতন নাগরিক কমিটি’ গঠনসহ নানা উদ্যোগের পরেও দেশে দুর্নীতি কতটা কমেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

আমাদের দেশে বেশ কটি উপায়ে বাংলাদেশে কালো টাকা তৈরি হয়। যেমন: পেশাজীবীদের অপ্রদর্শিত আয়- চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, এনজিও খাত কিংবা এমন অনেক পেশায় চাকরির বাইরেও পেশাগত চর্চার মাধ্যমে অর্থ আয়ের সুযোগ আছে। ঘুষ-দুর্নীতি সেবা খাত, ক্রয় খাতে কেউ যদি ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন তাহলে সেটি তার বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এভাবে অনেকে নগদ অর্থ উপার্জন করেন যেগুলো বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে বা অর্থনীতিতে আসে না।

দেশে নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা, কালোবাজারি, চোরাকারবারি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার বাজারও বেশ বড়। এসব কাজে জড়িতরা বিপুল অংকের টাকা আয় করেন। সুতরাং, এসব জায়গায় বেশ বড়সর আকারে অভিযান চালাতে না পারলে শুধু একজন মানুষের সাড়ে তিন কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে কথা বললে সেটি খণ্ডিত আলোচনা হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের সামগ্রিক দুর্নীতি তথা রাতারাতি ধনী হওয়ার পথ বন্ধ করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা—সেটিও কতটা উপস্থিত—তাও প্রশ্নাতীত নয়। অর্থাৎ, মানুষকে ঠকিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে, ভয় দেখিয়ে, জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা লুট করে ধনী হওয়ার সমস্ত পথ খোলা রেখে শুধু একটি গাড়ি নিয়ে কথা বলা নিরর্থক।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর