রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ অমীমাংসিত রয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিল। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে নির্দেশ দান করা হোক। দেশটি অভিযোগ করেছিল যে মিয়ানমার সরকার তাদের দেশের নাগরিক লাখ লাখ রোহিঙ্গার ওপর অমানসিক, অমানবিক নির্যাতন করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। ওই রোহিঙ্গাদের পরিপূর্ণ অধিকার রয়েছে স্বদেশে ফিরে যাবার কিন্তু মিয়ানমার তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধা দিচ্ছে।
এই মোকদ্দমায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মিয়ানমারের তৎকালীন সরকারপ্রধান অং সান সু চি আন্তর্জাতিক আদালতে উপস্থিত হয়ে বাদীর আবেদনের তীব্র বিরোধিতা করে তার সরকারের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। কদিনব্যাপী উভয় পক্ষের শুনানি শেষে হেগের আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য নাকচ করে রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নির্দেশনা দিয়ে আদেশ জারি করে। অং সান সু চির সরকার এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী সে নির্দেশ মেনে নেয়নি।
বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি নিয়ে নানা সময়ে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো- বিশেষ করে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ করার পর জানা গিয়েছিল পর্যায়ক্রমে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকামী রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করে ফেরত নেয়া হবে। কিন্তু সে কথা তারা রাখেনি, রোহিঙ্গাদের বৃহদাংশও যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। ফলে সমস্যাটির সমাধান আন্তর্জাতিক মহল থেকেও পাওয়া গেল না।
বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়, খাবার, পরিধেয়, চিকিৎসা এবং তাদের শিশুসন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার দায় পড়ে যায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপও অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন সহ্যের সকল সীমা অতিক্রম করায় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে দলে দলে হাঁটাপথে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। রোহিঙ্গারা স্রোতের মতো লাখে লাখে ঢুকে পড়ে কক্সবাজার, উখিয়া এবং সংলগ্ন এলাকাসমূহে। বাংলাদেশ সরকার তাদের বাধা দেয়নি বরং সীমান্ত খুলে দিয়েছিল রোহিঙ্গাদের নিরাপদে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার সুবিধার্থে। এ সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করেছে মিয়ানমার সরকার এবং রোহিঙ্গা বিতাড়নপ্রক্রিয়া বেড়েই চলেছে।
২০১৭ সালের আগেও প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা একইভাবে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিল, তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ আজও হয়নি। ফলে ওই রোহিঙ্গারাও এযাবৎকাল ধরে দিব্যি বাংলাদেশে বসবাস করছে। শুধু তাই নয়, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে রোহিঙ্গা পুরুষ বা মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করতে বললে রোহিঙ্গারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। দেখা যাচ্ছে- তার পরিণতিতে প্রতিটি রোহিঙ্গা নারী তিন, চার বা তারও বেশি সন্তান জন্ম দিয়ে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাংলাদেশে বিপুলভাবে বৃদ্ধি করছে এবং তা বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এবং সরকারেরও নানাবিধ সংকট আরও জটিল হয়ে উঠছে।
রোহিঙ্গাসংকটকে কেন্দ্র করে দুর্গত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার নামে ইউএনএইচসিআর ও আরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা, অনেকগুলো দেশি-বিদেশি এনজিও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভিড় জমায়। এদের অনেকের কার্যকলাপ সন্দেহজনক বলেও অনুভূত হয়।
কক্সবাজার, উখিয়া প্রভৃতি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র এলাকাগুলোয় সেখানকার আদি বাসিন্দাদের সঙ্গে দ্বিগুণ, তিন গুণ রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় গ্রহণ করায় স্থানীয় ও অস্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে পড়ে। স্থানীয়ভাবে ওই এলকায় বিপুলসংখ্যক বাড়তি মানুষ এসে ঠাঁই নেয়ার ফলে তাদের আশ্রয়ের জন্য অস্থায়ী ঘরবাড়ি, মসজিদ, স্কুল, হাসপাতাল প্রভৃতি গড়ে তুলতে হয়। ভারসাম্য ভেঙে পড়ার ফলে ওই এলাকার আদি বাসিন্দারা আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের চাইতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতে থাকে।
আকস্মিকভাবে ওই এলাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ সব রকমের পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। সাহায্যনির্ভর রোহিঙ্গারা সাহায্য পেলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের সবকিছু অত্যধিক চড়া দামে কিনতে বাধ্য হতে হয়। স্থানীয় অধিবাসীরাই মারাত্মক বিপর্যয়ের শিকার হন নানাভাবে।
শুধু পণ্যমূল্য বৃদ্ধিই নয়। অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণের নামে অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করে তারা বনাঞ্চল ধ্বংস করে, পাহাড় কেটে ও নদীর তীর থেকে মাটি কেটে এনে মেঝে, বারান্দা বা ঘরের দেয়াল প্রভৃতি তৈরি করায় এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। যেখানে-সেখানে মলমূত্র ত্যাগ ও কাশি, থুতু প্রভৃতি ফেলার ফলে শুধু রোহিঙ্গারা নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদেরও স্বাস্থ্যহানি ঘটে।
তদুপরি, রোহিঙ্গাদের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে প্রায়ই রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় মারামারি, খুনোখুনিও ঘটে। অনেকে মাদক ও নানাবিধ আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাকারবারিতেও লিপ্ত হয়। ফলে থানা-পুলিশের আনাগোনাও বেড়ে যায়। ইয়াবা ও অস্ত্র চোরাকারবারির দায়ে অনেক রোহিঙ্গা গ্রেপ্তারও হয়।
অপরদিকে বেশ কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের অসৎ আমলাকে কাজে লাগিয়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, বাংলাদেশের নাগরিকত্বের সনদ, বাংলাদেশের পাসপোর্ট পর্যন্ত নানা স্থানের বিভিন্ন সরকারি অফিস থেকে সংগ্রহ করতে থাকে। এবারে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট গ্রহণ করে ২০১৭ সালের আগে এ দেশে আসা বহু রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে বহুতলবিশিষ্ট বাড়িঘর, ব্যবসা-বিতান গড়ে তুলে স্ব-স্ব এলাকার হর্তাকর্তা বনে গিয়েছেন, সেসব জায়গার স্থানীয় বাসিন্দায়ও পরিণত হয়েছেন। অনেকে আবার নিজ ছেলেমেয়েদের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়-স্বজনেও পরিণত হয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের সবচাইতে বড় সুবিধা এই যে, তারা বাংলা ভাষাভাষী এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে এ দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় সবাই মুসলিম। সে কারণে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পক্ষে আদৌ কঠিন নয়। এই একই কারণে মিয়ানমার সরকারও আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের বাঙালি, বাংলাদেশি নাগরিক বলে দাবি করার সুবিধা নিয়ে থাকে।
এসব বিষয় নিয়ে ভাবলে রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশের সংকটের সার্বিক দিক উন্মোচিত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর খবরদারি- যা শেষ বিচারে বাংলাদেশ বা রোহিঙ্গাদের নয়, মিয়ানমার সরকারের পক্ষেই যায়।
খবরদারি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ল যখন বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে বিপুলসংখ্যক আবাসিক ভবন, স্কুল, মসজিদ, হাসপাতাল পথঘাট প্রভৃতি নির্মাণ করে সেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেতে উদ্যত হলো। বিদেশি কিছু সংস্থা ও রাষ্ট্র বলতে শুরু করল ভাসানচর অত্যন্ত দুর্গম, সেখানে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর অর্থ তাদের শাস্তি দেয়া এবং আরও বেশি অসুবিধায় ফেলা। ফলে বাংলাদেশ সরকার বহু অর্থ ব্যয় করে বিদেশি দূতাবাসসমূহের কর্মকর্তাদের ভাসানচরে নিয়ে দেখাল। তারা এ বিষয়ে আশ্বস্ত হয়। বলল, কাউকে যেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভাসানচরে নেয়া না হয়। তখন আবার রোহিঙ্গা নেতাদের নিয়ে দেখানোর পর তারা ভাসানচরে যাওয়ার পক্ষে অভিমত দেয়। ইতোমধ্যে বহুসংখ্যক রোহিঙ্গা পরিবারকে সেখানে পাঠানো হয়েছে এবং সকল সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে তারা সেখানে অনেকটা স্বনির্ভর হয়েও উঠছে।
বিদেশিদের আসল মতলব প্রকাশ্যে জানা গেল ২ আগস্ট বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে। তিনি ওই দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিদেশিরা চান, বাংলাদেশে সাময়িকভাবে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অবারিত চাকরির সুযোগ। তারা চাইছে, রোহিঙ্গারা যেন দেশের যেকোনো স্থানে জমির মালিকানা ও আইনি অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারে। এমনকি, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার প্রদানের জন্যও প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দেয়া এসব প্রস্তাবের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের ওপর শর্তারোপ করে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, ‘এখন হয়তো আলোচনার মাধ্যমে আপস রক্ষা হবে। তবে এটা নিশ্চিত যে, তারা আমাদের একটা চাপের মধ্যে রাখবে। হয়তো টাকাপয়সা দিতে ঝামেলা করবে।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাবের কথা আমরা জানতে পারলাম জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে। তারা ভাসানচরে যাওয়ার জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলোর একটি হলো বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাব গ্রহণ। সেখানে বলা আছে, রোহিঙ্গাদের সব ধরনের আইনি অধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশিদের মতো অধিকার দিতে হবে। কাজ করার অধিকার দিতে হবে, তাদের জন্মমৃত্যু নিবন্ধন করতে হবে, যেখানে খুশি সেখানে চলাচলের অবাধ অধিকারও দিতে হবে। এ ছাড়া ইচ্ছামাফিক বসতি গড়ার অধিকার, জমি কেনার অধিকার অর্থাৎ মালিকানার অধিকার, যা ইচ্ছা ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে।
এসব ছাড়া অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকারসহ নিজের ইচ্ছামতো যাতে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। তারা যেন সহজে যেকোনো চাকরি পেতে পারে অর্থাৎ চাকরির ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা কোনো বৈষম্যের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব করলে বিশ্বব্যাংক তাদের জন্য দুই হাজার কোটি টাকার মতো একটা ফান্ড দেবে। আর এ অধিকারগুলো দেয়া না হলে একটা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের বক্তব্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে আমরা এসব মানছি না। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের নামে যেসব টাকাপয়সা আসে আমরা তার চেহারাও দেখি না। ওই টাকার সব খরচ করে ইউএনএইচসিআর ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। তিনি অভিযোগ করেন, বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের নামে টাকা পাঠায় কিন্তু সেগুলো যায় বিভিন্ন সংস্থার কাছে। এসব সংস্থা কীভাবে টাকাপয়সা খরচ করে, সেটারও কোনো হিসাব-নিকাশ আমরা পাই না।
অতীতের আচরণ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে, তারা প্রভু সেজে থাকতে চায়। যেন মামাবাড়ির আবদার।
এখন যে প্রেসক্রিপশন তারা দিয়েছে তা মানার অর্থ হলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে বাংলাদেশে পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান এবং এ দেশের নাগরিকের সব অধিকারেরও নিঃশর্ত স্বীকৃতি!
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।