পরিবারের বাজার করার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়েছি অনেক আগে। যতদূর মনে পড়ে, ক্লাস সিক্সে ওঠার পর থেকেই বাজারের ব্যাগ হাতে উঠেছে। কিন্তু এ নিয়ে আমার কোনো বিরক্তি কখনোই ছিল না। বাজার করতে আমার ভালোই লাগে। তবে একটা শর্ত আছে, পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকতে হবে, অন্তত যা কিনতে চাই তার সমপরিমাণ টাকা। প্রথমদিকে বাজার নিয়ে জবাবদিহি করতে হতো আম্মার কাছে। পরবর্তীকালে নিজে যখন উপার্জন করতে শুরু করলাম, তখন অনেকটাই স্বাধীনভাবে বাজার করতে শুরু করেছি। তবে নানান পণ্যের দরদাম আম্মার কাছে বলার বিষয়ে সতর্ক ছিলাম। ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতিও বদলে যায়। পরবর্তী সময়ে পেশাগত কারণে আমার আবাসস্থল ও সময় বদলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়ে যায় অনেক কিছু। বাজারের সব দায়দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ওপর, যা বিগত কয়েক বছর ধরে চলমান।
শিশুকালে দাদার হাত ধরে গ্রামের বাজারে যেতাম। তার হাত শক্ত করে ধরে সারা বাজার ঘুরতাম। দাদা আমাকে নানান জিনিস কিনে দিতেন, এরমধ্যে জাম ও বাদাম কিনে দিয়েছিলেন, সে কথা খুব মনে আছে। কালো রঙের সুদৃশ্য লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে থাকা দীর্ঘদেহী মানুষটির হাত ধরে যখন আমিও হাঁটতাম, জয় বাংলা বাজারের এ মাথা ও মাথা ঘুরে বেড়াতাম, তখন আমার শিশুমন আনন্দে নেচে উঠত। ঠিক মনে আছে তখন চালের দাম ছিল কেজিপ্রতি মাত্র ছয়-সাত টাকা। এর তিন দশক পর আজকে ৫০ টাকার নিচে কোনো খাবার উপযোগী চাল কিনতে পাওয়া যায় না।
আমরা দেখি অপেক্ষাকৃত উৎপাদন বেশি হওয়ায় প্রতিবছর বোরো মৌসুমে চালের দাম অনেকটাই কমে যায়। এবার কিন্তু তেমনটা হয়নি। বরং মৌসুম শেষ না হতেই দাম বাড়ছে। কোরবানির ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে সব ধরনের চালের দাম দুদফা বেড়েছে। শুধু চাল কেন? ডিম, মুরগি, চিনি এবং ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন জিনিসটির দাম বাড়েনি? গত মাসের শুরুর দিকে টয়লেট টিস্যু ও ডাইনিং টিস্যু কিনেছি যথাক্রমে ১৭ টাকা পিস ও ৫৫ টাকা প্রতি প্যাকেট; চলতি মাসে এর দাম বেড়েছে ৩ থেকে ১৫ টাকা করে। আর সবজির দাম? পাইকারি থেকে খুচরা বিক্রেতা যে যার ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে চলেছে।
ঈদের আগে যে কাঁচামরিচ কিনলাম ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি, সেই কাঁচামরিচ এখন কিনছি ২৫০ গ্রাম ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে। কেন দাম বাড়ছে, এই প্রশ্ন তাদের করা যায় না, নিলে নিবেন না নিলে না নেবেন। কেউ কোনো উত্তর দিতে রাজি নয়। এমন নয় যে, আমার মতো অন্যরা, চোখের সামনে দেখছি, লোকজন আসছে ব্যাগ ভরে বাজার করে নিয়ে চলে যাচ্ছে। কোনো প্রশ্ন নেই। মনে মনে ভাবি, তাহলে এই প্রশ্ন কি শুধু আমার একার মনেই! এই যে সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অবাধে বাড়িয়ে যাচ্ছে, এর কোনো প্রতিবাদ নেই?
এইযে চাল, তেলসহ প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিক রকম বেড়ে চলেছে, তা নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেই কদিন আগে। দেখলাম তাতে অনেকে মন্তব্য করেছেন। যারা মন্তব্য করেছেন তারা সবাই আমার মতোই বিরক্ত, একই সঙ্গে অসহায়। মন্তব্যে এক কবি লিখেছেন- দেশটা বেনিয়ার থাবায়, জনতা অসহায়। কিশোরগঞ্জের এক সাংবাদিক লিখেছেন-সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলপিজি গ্যাসের দামও বাড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তরুণ এক লেখক মন্তব্য করেছেন- আমাদের এখানেও তো তেলের দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। মধ্যবিত্তের ভুঁড়ি কমছে। আর গরিবরা সিদ্ধ খাচ্ছে। সবাই মুখে কুলুপ এঁটে। কথা বললেই যেন জুজু এসে ধরবে। এমন আরও বেশকিছু মন্তব্য আছে, আমার সেই স্ট্যাটাসটির নিচে।
এসব পড়ে বোধ করি সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে, কষ্ট আছে। কিন্তু এসব উগড়ে দেবার সঠিক জায়গা তারা পাচ্ছে না। সবশেষ আশ্রয়স্থল সোস্যাল মিডিয়া। সেখানেই যা বলার কেউ কেউ বলে চলেছেন। তাতে কি কিছু হয়, হচ্ছে? হোক না হোক কথা তো বলতে পারছে।
একবার ভাবুন তো, প্রায় দুই বছর হতে চলল, কোভিড নামের মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে আয়-উপার্জনহীন সাধারণ মানুষের অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে? নিম্ন আয়ের মানুষ, দৈনিক শ্রমজীবী, রিকশাচালক, অনিয়মিত ও অর্ধবেতনের বেসরকারি চাকরিজীবী, মহামারিতে চাকরি হারানো বেকার যুবক-যুবতী, পেনশনের টাকায় সংসার চালানো বৃদ্ধ, সদ্য বেকার হয়ে যাওয়া সাংবাদিক, পেশাদার লেখক, সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, নাট্যশিল্পী, শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই কালে তারা কেমন আছে? তাদের বাড়ির চুলায় তিনবেলাই কি আগুন জ্বলে? অসুস্থ পিতা-মাতার ওষুধ কি কিনতে পারছে? স্ত্রী-সন্তানের সামান্য চাওয়া পূরণে তারা কতটা অসহায়! কেউ কি ভেবেছে তাদের কথা?
আজ যখন আমাদের সামনে এই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হচ্ছে, আমরা তখন প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছি মহাসমারোহে। যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছিল বাংলার দামাল সন্তানেরা, গত পাঁচ দশকে তার কতটুকু পূরণ হয়েছে? হয়তো সে হিসাব মিলানোর সুযোগও করোনা কেড়ে নিয়েছে। প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকাই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের দেশ ধীরে ধীরে উন্নত দেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো টাকায় শক্তিশালী হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। তাহলে কেন এত বৈষম্য বাড়ছে? মধ্যবিত্ত নামের শ্রেণি পরিচয়টি বিলীন হয়ে কার্যত নিম্ন মধ্যবিত্ত নামে আপ্রাণ বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশে ধনী আর গরিব নামের দুটো শ্রেণির অবস্থান ও ব্যবধান স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
চলমান এই গভীর সংকটের কালে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগামটা টেনে ধরবে কে? কেন? সরকার ধরবে, রাষ্ট্র ধরবে। আমরাতো তাই চাই। রাষ্ট্র তার জনগণের কল্যাণে আরও নিবেদিত হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সরকার সর্বোচ্চ তৎপর হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রের নগণ্য এক নাগরিক হিসেবে এই প্রত্যাশা তো করতেই পারি, তাই নয় কি?
লেখক: লেখক ও গবেষক।