বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বেগম রোকেয়া ও ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ১০ আগস্ট, ২০২১ ১০:৫২

বেগম রোকেয়া সব সময় সাম্যের ডাক দিয়ে গেছেন। তিনি পুরুষতান্ত্রিক কিংবা নারীতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন সমাজে নারী ও পুরুষ যাতে একসঙ্গে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে বাঁচে। উনিশ শতকের দিকে যখন মেয়েরা ছিল অবরোধবাসিনী, তখন তিনিই সেই ঝিমিয়ে পড়া নারী জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।

ভারতবর্ষের সবচেয়ে অন্যতম আলোকিত মানুষটির নাম সম্ভবত বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মতো মেধাবী, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মননশীল, সাহসী নারী বাঙালি সমাজে আজও বিরল। তিনি তার কর্ম ও রচনা দিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন। শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না— একথা তিনি অনেক জোরের সঙ্গে বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই নারী সমাজ নীরব সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে পারবে। নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি নারীকে তার স্ব-মহিমায় প্রজ্জ্বলিত হবার শক্তি জুগিয়েছেন।

রোকেয়া সেই কবে ডাক দিয়েছিলেন, ‘আর ঘুমাইও না; এখন আর রাত্রি নাই, এখন সুবেহ সাদেক মোয়াজ্জিন আজান দিতেছেন।’ এই আহ্বান ছিল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের নাগরিক অধিকার বুঝে নেয়ার ডাক। রোকেয়া বিশ্বাস করতেন, সমস্ত ব্যাধির মহৌষধ হলো প্রকৃত আধুনিক শিক্ষা। তিনি বলেছেন-

‘‘শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি। অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রাখিতেন। এখন দূরদর্শী ভ্রাতাগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে ইহাতে তাঁহাদের ক্ষতি ও অবনতি হইতেছে। তাই তাঁহারা জাগিয়া উঠিতে ও উঠাইতে ব্যস্ত হইয়াছেন। আমি ইতঃপূর্বেও বলিয়াছি যে ‘নর ও নারী উভয়ে মিলিয়ে একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ উন্নতি লাভ করিতে পারিবে না’ এখনও তাহাই বলি। এবং আবশ্যক হইলে ঐ কথা শতবার বলিব।’’

রোকেয়ার এই আহ্বানের পর কেটেছে প্রায় একটা শতাব্দী। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ রোকেয়ার আহ্বান কতটা শুনেছে, তার দেখানো পথে কতটা পাড়ি দিয়েছে, সে ব্যাপারে সন্দেহের নিরসন এখনও হয়নি। আমাদের সমাজ এখনও শিক্ষা তথা উন্নয়নের পথে পা বাড়াতে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। মেয়েদের বেশি লেখাপড়া না করানো, অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া, লেখাপড়া জানা মেয়েদেরও ঘরসংসারের দায়িত্ব পালনের কথা বলে চাকরিবাকরি করতে না দেয়া ইত্যাদি ঘটনা হরহামাশাই ঘটে। পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে সত্য, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।

নারীশিক্ষার প্রসার এবং নারীদের দুর্দশা মোচনে হাতে-কলমে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। নারীজীবনকে অর্থবান করার জন্য তাদের শোচনীয় দাসত্ব থেকে মুক্তি আবশ্যক, এ ব্যাপারে রোকেয়ার চিন্তায় কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। সমকালীন অন্য নারী সমাজ সংস্কারকদের থেকে তার পার্থক্য এখানেই। অন্যরা নারীর দুর্দশা লাঘব করতে চেয়েছেন মাত্র। তারাও লেখাপড়া বা গৃহকর্মের কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য নারীদের আরও ভালো মা বা স্ত্রী হওয়া, অর্থাৎ ঐতিহ্যশীল ভূমিকাতেই তারা নারীকে দেখেছিলেন। কিন্তু নারী-জীবনের এই সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। রোকেয়া মনে করেছিলেন, নারীদের সহিষ্ণুতার প্রশংসা আসলে পুরুষ সমাজের শোষণ এবং দুর্ব্যবহারের সমর্থন। নারীমুক্তির অর্থ পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন। নারী পুরুষের সহকর্মী সহধর্মিণী হবেন, এটাই ছিল তার আশা। তিনি বলেছিলেন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন ছাড়া নারীর মুক্তি অসম্ভব। রোকেয়া দাবি করেছিলেন, নারী-পুরুষের সমান অধিকার। নারীরা যে পুরুষদ্বারা শোষিত— এই চেতনা প্রথম নারী হিসেবে তিনি তুলে ধরেছিলেন।

‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লিখেছিলেন—

“আপনারা কি কোনোদিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে আমরা কি? দাসী! পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? না। আমরা দাসী কেন? কারণ আছে।”

এরপর তিনি অন্যত্র লিখেছেন—

“বিপদসংকুল সংসার হইতে সর্বদা সুরক্ষিতা আছি বলিয়া আমরা সাহস, ভরসা, বল একেবারে হারাইয়াছি। আত্মনির্ভরতা ছাড়িয়া স্বামীদের নিতান্ত মুখাপেক্ষী হইয়া পড়িয়াছি। সামান্য হইতে সামান্যতর বিপদে পড়িলে আমরা গৃহকোণে লুকাইয়া গগনভেদী আর্তনাদে রোদন করিয়া থাকি! ভ্রাতৃমহোদয়গণ আবার আমাদের নাকি কান্নার কথা তুলিয়া কেমন বিদ্রূপ করেন তাহা কে না জানে? আর সে বিদ্রূপ আমরা নীরবে সহ্য করি। আমরা কেমন শোচনীয়রূপে ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, তাহা ভাবিলে ঘৃণায়-লজ্জায় মৃতপ্রায় হই।”

বেগম রোকেয়া সবসময় সাম্যের ডাক দিয়ে গেছেন। তিনি পুরুষতান্ত্রিক কিংবা নারীতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন সমাজে নারী ও পুরুষ যাতে একসঙ্গে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে বাঁচে। উনিশ শতকের দিকে যখন মেয়েরা ছিল অবরোধবাসিনী, তখন তিনিই সেই ঝিমিয়ে পড়া নারী জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।

তিনি কখনোই পুরুষকে ছোট করে দেখেননি। তাই তো তিনি লিখেছেন—

“আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপ? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।”

তিনি আরও বলেছেন—

“দেহের দু’টি চক্ষুস্বরূপ, মানুষের সবরকমের কাজকর্মের প্রয়োজনে দু’টি চক্ষুর গুরুত্ব সমান।”

তিনি নারী ও পুরুষকে একটি গাড়ির দু’টি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেননা একটি চাকা ছাড়া পুরো গাড়িটাই অচল। তাই নারী ও পুরুষ যদি মিলেমিশে কাজ করে, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবেই। সমাজের অর্ধেক অংশকে বাদ দিলে কখনোই রাষ্ট্রের উন্নতি হবে না। তাই তো তিনি ছিলেন সমতায় বিশ্বাসী।

বেগম রোকেয়া অনুভব করেছিলেন, ধর্ম অনেকক্ষেত্রেই নারীকে দাবিয়ে রাখার এক অস্ত্র। তাইতো তিনি ধর্মের নামে নারীদের অবদমিত করে রাখার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন— “যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।”

কিন্তু এত বছর ধর্মের নামে আজও নারীদের অবরূদ্ধ করে রাখার প্রয়াস চালানো হয়। নারীর চলাফেরার ওপর এখনও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। মেয়েদের কাজ ঘরসংসার করা, তাদের অবস্থান অন্তঃপুরে— এমন কথা সমাজের অনেকই বিশ্বাস করে। উদার সমাজ, মুক্ত পরিবেশ আমরা এখনও গড়ে তুলতে পারিনি। অবশ্য উদার ও মুক্ত সমাজ এমনি এমনি আসে না। তার জন্য আন্তরিক প্রয়াস প্রয়োজন। এগিয়ে গিয়ে সেই প্রয়াস করতে হয় সমাজের অগ্রসরমান মানুষদেরই। কিন্তু এখানে আমাদের বিশেষ দুর্বলতা। নারী উন্নয়নে নারীদের ভূমিকাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সমাজের সার্বিক পরিবর্তনে বর্তমান নারীদের অবস্থান কোথায়? এখন অনেক নারী লেখাপড়া শিখছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারছে। চাকরির পরীক্ষায় সফল হচ্ছে।

তবে কিনা— ওইটুকুই। জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর নিজের সমাজের জন্য কাজ করার প্রয়াস কোথায়? আমার সমাজের প্রতি কর্তব্য অন্য সমাজের মানুষজন এসে করে দেবেন, এই ভাবনাই বোধহয় শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। ভোগবাদী জীবনের প্যাঁচে আটকে চাকরি, সন্তানের ক্যারিয়ার, ভালো বাড়ি— এত কিছুর মধ্যে নিজেদের জংধরা সমাজ নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?

অথচ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কত সামাজিক কাজকর্ম করেছিলেন। হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে ১৯১১ সালে ১৬ মার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। ১৯১৬ সালে মুসলমান নারীর সামাজিক কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’। সামাজিক সংস্কারের বিষয়ে, শিক্ষার প্রসার নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন সারা জীবন। গত শতাব্দীতে রোকেয়া যা পারেন এই শতাব্দীতে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থায় বাঙালি নারী তা পারেন না কেন?

বেগম রোকেয়ার জীবনী ও তার রচনাবলি পাঠ করা, বার বার পড়ে সেগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন করা আজ অত্যন্ত জরুরি। রোকেয়া-নির্দেশিত পথেই আমরা পেতে পারি নারীমুক্তির দিশা।

লেখক: কলাম লেখক-সাবেক ছাত্রনেতা

এ বিভাগের আরো খবর