করোনা মহামরি সারা পৃথিবীকে প্রায় বিপর্যস্ত করে তুলেছে। মানুষের জীবন-জীবিকার সংকট এখন প্রকট। বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম এখন মুখ্য। করোনাকালে উদ্ভূত জটিল এবং অভূতপূর্ব এই পরিস্থিতিতে মহাসংকটে পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। হতদরিদ্র মানুষজন সরকার ও বিত্তবান শ্রেণির কাছ থেকে দান, সাহায্য, সহায়তা পেয়ে থাকেন। কিন্তু খাদে পড়া অসহায় মধ্যবিত্ত সমাজকে কে দেবে সহায়তা? মুখ বুজে সব সহ্য করা ছাড়া আর উপায় কী? করোনা-সংক্রমণের ব্যাপকতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, মধ্যবিত্তের দুর্ভোগ ততই দুর্বিষহ হচ্ছে। কবে কখন যে এই অসহনীয় অধ্যায়ের অবসান হবে, তা কেউ জানে না।
ফলে মধ্যবিত্তের সংকট সমস্যার সমাধান হওয়ার আশু কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কঠিন এই বাস্তবতায় মধ্যবিত্ত কী করে টিকবে এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। করোনার কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছেন শতকরা ৩৬ জন। তিন শতাংশ মানুষের চাকরি থাকা সত্ত্বেও তারা বেতন-ভাতা পান না। এদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত। তাহলে সংকট উত্তরণের কী উপায়? করোনা সংক্রমণজনিত এ সংকটকালে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সার্বিক সুরক্ষা ও জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য উন্নয়ন কার্যক্রম এবং জনবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এ সকল পদক্ষেপ প্রায় স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতির চাকা চলমান রাখতে কিছুটা হলেও অবদান রাখছে।
করোনা মহামারির কারণে বর্তমান বাংলাদেশের সমাজচিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। করোনার করাল থাবায় অর্থনীতির স্বাভাবিক চাকা আপন গতিতে ঘুরতে পারছে না। সচলতার পরিবর্তে প্রবল হয়ে উঠছে স্থবিরতা। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনিশ্চয়তার প্রহর ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। দিশেহারা হয়ে অনেক মানুষ গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন ও এখনও হচ্ছেন। সেখানেও কি শান্তি আছে, বসবাসের নিশ্চয়তা আছে? কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা কি আছে? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না।
পেশাজীবীদের জীবিকা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। বেসরকারি অফিস প্রতিষ্ঠানে বেতন-ভাতা অনিয়মিত। কাজ করলেও বেতন-ভাতা মিলছে না। পোশাক খাতের কর্মীরাও বরাবরের মতোই সংকটের মুখে। অনেক কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়েছে বা বন্ধ হবার পথে। প্রবাসী শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে যাচ্ছেন। অনেকে দেশে এসে আটকা পড়েছেন। কবে ফিরে গিয়ে কাজে যোগ দিতে পারবেন, সেটাও অনিশ্চিত। কোথাও আশার আলো নেই।
পেশা বদলের প্রতিযোগিতা এখন নিয়মিত বিষয়। চাকরিহারা কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন সেখানেও কি সুবিধা পাচ্ছেন? জীবনযুদ্ধের এক কঠিন সময় যাচ্ছে এখন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় নানা সেক্টরে কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৮২ লাখ। করোনার বিষাক্ত ছোবলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। পরিস্থিতি কতটা বিপজ্জনক ও আশঙ্কার, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত কর্মহীন লোকের সংখ্যা ১৪ লাখ। এই সংকট শুধু বাংলাদেশেরই নয় গোটা বিশ্বেরই। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা আইএলওর সর্বশেষ রিপোর্টে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে তো সংকট আরও বাড়বে। আইএলও বলেছে, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী ৩৪ কোটি মানুষ কাজ হারাতে পারেন। বিপর্যস্ত দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে আমাদের বাংলাদেশও।
করোনা সংকটে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই বিপদগ্রস্ত। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ অংশ সরকারই দেয়, তবে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী আবার সরকারি সুবিধা পান না। কিন্তু বেশি সমস্যায় আছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন না নিলে তারা শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন দিতে পারে না। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায় করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন থাকছে। তাই শিক্ষক-কর্মচারীরা বিপদেই আছেন।
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বড় বড় এবং কম প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো থেকে টাকা সরিয়ে তা করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় করবে। এর অধিকাংশই ব্যয় করা হবে সেসব ব্যবসায়ীদের জন্য যারা এ সময়ে পুঁজি হারিয়েছেন। এতে করে তারা ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবেন। সরকার সময়োপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
করোনার কারণে রপ্তানিবাজার পড়ে গেছে। এজন্য আমাদের এখন নতুন নতুন চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরি করতে হবে। একদিকে যেমন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হবে চলমান প্রকল্পগুলো শেষ করা, অপরদিকে খাদ্য নিরাপত্তাসহ দেশের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন অব্যাহত রেখে কর্মসংস্থান ধরে রাখা, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা, বিকল্প আমদানি ও রপ্তানি বাজারের ব্যবস্থা করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি।
সুতরাং, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের কষ্টের সময়ে তাদের সহায়তা করার জন্য কৌশলগুলো চিহ্নিত করার বিষয়ে সরকারের আরও চিন্তা করা উচিত এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এই শ্রেণির মানুষ এমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন যে, তারা তাদের দুর্দশার চিত্রগুলো অন্যদের কাছে কিংবা সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে উপস্থাপন করতে চাইবেন না। তারা জীবন দেবেন কিন্তু অন্যের কাছে সাহায্য চাইবেন না। কভিড-১৯ মহামারির সময়ে এসব মানুষকে জীবন সংগ্রামে সহায়তা প্রদান করা সরকারসহ প্রত্যেক নাগরিকের একটি সামাজিক কর্তব্য। আমরা সবাই জানি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই সংকটের সময়ে মানুষকে সাহায্য করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও উচিত এসব মানুষকে চাকরিতে রেখে তাদের সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসা।
দেশের অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব এবং তা থেকে উত্তরণে মোট পাঁচটি প্যাকেজে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা হয়েছে। যা জিডিপির প্রায় ২.৫২ শতাংশ। এর আগে তৈরি পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ও উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত এসব কর্মপরিকল্পনায় আর্থিক সহায়তার প্যাকেজে ছিল সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি; সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি কার্যক্রম। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, যেমন- কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, পথশিশু, বিধবা নারী এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাছাড়াও ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত সারা দেশে দেড় কোটির বেশি পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে। প্রধানমত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন এই সংকট যতদিন থাকবে ততদিন তার সরকারের এ পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে। ঈদুল আজহায় সরকার ১ কোটি দরিদ্র পরিবারকে চাল দিয়েছে। এখন আমাদের টেকসই মানবকল্যাণমূলক স্বনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে হবে-যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। একমাত্র তিনিই পারবেন ১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এদেশের ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণকে একত্র করে আর একটি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে করোনাকালীন সংকট মোকাবিলা করে এবং পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধার করতে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।