বোধোদয়ের আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তার জীবন। জ্ঞান হওয়ার পর জেনেছেন তার জীবনে জড়িয়ে থাকা মানুষটি, মানুষের কল্যাণে, অধিকার আদায়ে প্রতিকূলের বিরুদ্ধে দাঁড়ান বুক চিতিয়ে। ভালোবেসে জীবনসঙ্গীর লড়াই সংগ্রাম নিজের করে নিয়েছেন। ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত রাাষ্ট্র পাকিস্তানের স্বরূপ তখন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে স্পষ্ট। নিজেকে তিনি তৈরি করছেন আরও বড় লড়াইয়ের জন্য।
১৯৫৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ থেকে প্রদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলে তিন সন্তানের জননী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব স্বামীর কর্মকাণ্ডে পূর্ণ সহযোগিতা, তার সামনে অপেক্ষমাণ বৃহত্তর লড়াই সংগ্রামে পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় আসেন। ওঠেন গেন্ডারিয়া রজনী চৌধুরী লেনের ছোট্ট একটি ভাড়া করা বাসায়। সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় বঙ্গমাতা নিজেই তখন অর্থ জমিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দিতেন। এমন অবস্থায়ও দেশমাতৃকার প্রয়োজনে জীবনসঙ্গীর পাশে থেকে সাহসের সঙ্গে তাকে সামনে এগিয়ে দিতে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। চিরচেনা, বেড়ে ওঠা পরিবেশ ছেড়ে একজন গৃহবধূর পক্ষে এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া সে সময়ের বাস্তবতায় সহজ ছিল না মোটেও। তিনি পেরেছিলেন, তিনি যে হতে যাচ্ছেন ইতিহাস নির্মাতার প্রেরণার উৎস!
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির প্রতিবাদে ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করা হয়। এ সময় বেগম ফজিলাতুন নেছা ও তার পরিবারের প্রতি চালানো হয় নির্যাতন। ধৈর্যশীল বঙ্গমাতা সমস্ত নির্যাতন সহ্য করেও বঙ্গবন্ধুকে জেল হতে ছাড়ানোর জন্য উকিল ঠিক করা, উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা, মামলার কাগজপত্র গোছানো এর সবই করেছেন তিনি একা। একা গোপনে লড়ে গেছেন বাংলার মুক্তিদাতাকে জেলের তালা ভেঙে বের করে আনার জন্য। যা এক দৃঢ়চেতা রাজনীতিবিদের পক্ষেই সম্ভব।
১৯৬২ সনে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলন, ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জনগণের পক্ষে ও সরকারবিরোধী বক্তব্য দানের অভিযোগে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলে ফজিলাতুন নেছা নিজে মামলার কাজ ও দল পরিচালনা করতেন। গহনা বিক্রি করে ছাত্র সংগঠন ও আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। একদিকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে অভাবের সময়েও পরম মমতায় সন্তানদের নিয়ে সংসার সামলেছেন, অন্যদিকে প্রখর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সঙ্গে দল পরিচালনা করেছেন।
এছাড়াও কারাগারে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে দেশের অবস্থা বর্ণনা, সংগঠনের অবস্থা অবহিত করা এবং বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পার্টি ও কর্মীদের প্রতি নির্দেশ জেনে তা হুবহু নেতা কর্মীদের প্রদান করে তিনি নেতা ও কর্মীদের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করেন। কারাগারে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল করেছেন দৃঢ়। যা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া এক রাজনীতিবিদের পক্ষেই সম্ভব। আর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে এসে দলের নেতাকর্মীদের কাছে তা হুবহু পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন বেগম মুজিব। আর এ কারণেই বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘জীবন্ত ডায়েরি’ বলতেন।
স্বামীর আদর্শ, দেশপ্রেম ও সংগঠনের জন্য তিনি নিজের সম্বল প্রায় সবই বিলিয়ে দিয়েছিলেন। টাকার অভাব, একদিকে সংসার চালাতে হচ্ছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতাদের সাহায্য দরকার, অসুস্থ কাউকে টাকা দিতে হচ্ছে। কিন্তু কখনোই এসব কথা কাউকে বলতেন না। নীরবে কষ্ট করে সমস্যার সমাধান করেছেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পদে পদে তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতার আগে আন্দোলন বেগবান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে সেই সংগঠনের আন্দোলন এবং সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে আপসহীন ভূমিকা রেখেছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন কখনো আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের মধ্যে সংকটের কালোছায়া নেমে এলে, তখনই বেগম মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে দৃঢ়, কৌশলী এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে বেগম মুজিব যতটুকু অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তার পুরোটাই ব্যয় করেছেন নিঃস্বার্থভাবে সংসার এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত রাজনীতির পিছনে।
১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার মুক্তি সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য বঙ্গবন্ধু সারা দেশে জনসভা করেন এবং প্রথম তিন মাসে গ্রেপ্তার হন ৮ বার। ৬ দফার আন্দোলনকে চাপা দিয়ে তথাকথিত ৮ দফা দাবি কার্যকর করার জন্য ষড়যন্ত্র চলছিল। ১৯ মে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা হয়। বেগম মুজিব নিজহাতে রান্না করে তিন দিন সবাইকে খাইয়েছেন। সেই সঙ্গে বিভক্ত নেতাদের দিয়েছেন নানা পরামর্শ, সাবধান করেছেন যেন ছয় দফা থেকে আট দফার দিকে চলে না যায়। তাঁর মানসিক দৃঢ়তা সেই সময়ের রাজনৈতিক জাতীয় সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত কার্যকর ছিল। নেতাদের নানামুখী পরামর্শে তিনি শুধু বলতেন-
‘লেখাপড়া জানি না কী বুঝব, খালি এটুকু বুঝি যে ছয় দফা আমাদের মুক্তির সনদ, এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’ ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন আদায় ও জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করতে লিফলেট হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন বঙ্গমাতা। ৬ দফা আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ৭ জুনের সফল হরতাল। ফজিলাতুন নেছা মুজিবের দূরদর্শিতা, সাহসী পদক্ষেপে আর একান্ত প্রচেষ্টায় ৭ জুনের হরতাল সফল হয় এবং ৬ দফা আওয়ামী লীগের একমাত্র দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এখানেই একজন সফল রাজনীতিকের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে।
“তিনি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি এড়িয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তাঁদের ছোট ফুফুর ফ্ল্যাট বাসায় চলে যেতেন। ওখানে গিয়ে নিজের স্যান্ডেল, কাপড় বদলে, বোরকা পরে একটা স্কুটার ভাড়া করে ঢাকায় পড়ুয়া ছোট ভাইকে নিয়ে ছাত্রনেতা আর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। আন্দোলন চালাবে কিভাবে তার পরামর্শ, নির্দেশনা নিজেই দিতেন। আবার ওই বাসায় ফিরে এসে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতেন।” (সূত্র: আহমেদ রিয়াজ, কালের কণ্ঠ ৮ আগস্ট ২০২০)।
১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়, তার বিরুদ্ধে গঠন করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ, যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এ কঠিন মুহূর্তেও তিনি বিচলিত না হয়ে, ন্যায় ও নীতির প্রতি অবিচল ও অটল থেকে সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর গোয়েন্দা সংস্থা তাকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। কিন্তু তিনি ভয় পেয়ে নীতির কাছে নতিস্বীকার করেননি। বিপদে হাল না ছাড়া ফজিলাতুন নেছা মুজিব মামলা পরিচালনার জন্য প্রবাসী বাঙালিদের সহযোগিতায় লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী স্যার টমাস উলিয়ামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। রাজনীতির নেপথ্য নিয়ন্ত্রণ রাশ তখন তার হাতে।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করার কাজে তাঁর অবদান অপরিসীম। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখের অন্তরালে সংগঠনকে সংগঠিত করতেন, বিচক্ষনতার সঙ্গে ছাত্রদের নির্দেশ দিতেন এবং অর্থ সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন।
বঙ্গমাতা কতটা দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ছিলেন সেটি বোঝা যায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন-
“মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন কিন্তু আম্মা মনোবল হারাননি।”
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাবার বাড়ি পাকিস্তানি হানাদারেরা সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়। অক্টোবরের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর মা-বাবা ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে ড. নুরুল ইসলামের সহায়তায় তাঁদেরকে পি.জি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় অস্ত্রসহ পাহারা দিয়ে বেগম মুজিবকে তাদের কাছে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। তখন ওই কেবিনে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎ হতো। তিনি বাসার কাজের লোকের মাধ্যমেও মুক্তিযোদ্ধাদের খবর আদান-প্রদান করতেন। এভাবেই কেবিনটি হয়ে ওঠে তথ্য আদান-প্রদানের কেন্দ্র। (স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার নারী, পৃ. ৩৪)
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা লে. জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। বন্দি ফজিলাতুন নেছা ও তার সন্তানেরা আনন্দে আত্মহারা, তৎক্ষণাৎ তিনি হাবিলদারদের ডেকে বলেন, “তোমাদের নিয়াজী সারেন্ডার করেছে, তোমরাও সারেন্ডার কর।” (স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার নারী, পৃ. ৩৪)
দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু স্বাধীনতার আনন্দ এলো না বেগম মুজিবের জীবনে। বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলার মুক্তির মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বপ্নে স্বাধীন সোনার বাংলায় ফিরলেন সগৌরবে। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে দেশ গড়ার নতুন যাত্রা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। এ যাত্রায়ও বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা। স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশে বঙ্গমাতা বলেন, ‘আমি তোমাদের মা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই বীরাঙ্গনা রমণীদের জন্য জাতি গর্বিত। তাদের লজ্জা কিংবা গ্লানিবোধের কোনো কারণ নেই। কেননা তারাই প্রথম প্রমাণ করেছেন যে, কেবল বাংলাদেশের ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও আত্মমর্যাদাবোধে কী অসম্ভব বলীয়ান।” (দৈনিক বাংলার বাণী, ১৭ ফাল্গুন, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)।
বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। ছিলেন দক্ষ সংগঠক। একাহাতে সামলেছেন সংসার। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যায় তার বিরল আত্মমর্যাদাবোধ। তাই তো ঘাতকের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছেন অবলীলায়। সারাজীবন আগলে রাখা মানুষটির অবর্তমানে বেঁচে থাকতে চাননি একপলও। সহধর্মিণী থেকে মৃত্যুতেও সহযাত্রী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব।
লেখক: গবেষক, প্রেস ইনস্টটিউট বাংলাদেশ