আগস্ট এলেই সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার ভয়াবহ স্মৃতি আমাদের মর্মাহত করে। একইসঙ্গে ঘাতকদের প্রতি প্রবল ঘৃণাও জাগিয়ে তোলে। একথা আজ কে না জানে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুধু একজন রাষ্ট্রপ্রধানকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার স্থপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহিদের রক্তভেজা একটি নবীন রাষ্ট্রের প্রগতিশীল অস্তিত্বকেই। যে কারণে জাতির পিতার হত্যাকারীরা ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা দিয়ে পরিচয় পাল্টে দিয়েছিল। যদিও শহিদের রক্তভেজা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ তা মেনে নেয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক দর্শনে বিশ্বাসী ঘাতকরা একাত্তরের ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করে দিয়ে গেল, তার বিষফল আজও ভোগ করতে হচ্ছে জাতিকে। যে কারণে আগস্ট আমাদের কাছে এক অবিস্মরণীয় শোক আর লজ্জার গ্লাণিতে নিমজ্জিত একটি মাস।
শুধু পনেরোই আগস্টের কারণে নয়, কী করে ভুলে যাব একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় বহু মানুষের প্রাণনাশের সেই ভযয়ংকর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কথা!
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই মনে পড়ে ( ৬ ও ১১ আগস্ট) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর পারমাণবিক বোমায় মানব ইতিহাসের ভয়ংকরতম হত্যাযজ্ঞ আর বিপর্যয়ের স্মৃতি! এই আগস্টেই মনে পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মহাপ্রয়াণের স্মৃতি।
কেমন করে ভুলে যাব বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে জঙ্গিগোষ্ঠীর ভয়ংকর উত্থানের স্মৃতিবহ ১৭ আগস্টের কথা? সেদিন মুন্সিগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী! বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হয়ে তারা জানান দিতে চেয়েছিল তাদের শক্তি কতখানি!
এরকম অনেক দুর্যোগময় ঘটনা জড়িয়ে আছে শোকাবহ আগস্টের সঙ্গে। কিন্তু এতো শোক-দুঃখের মধ্যেও জীবন সতত বহমান। এ মাসেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ( ৮ আগস্ট ১৯৩০) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। এ মাসেই তাদের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের জন্মদিন (৫ আগস্ট ১৯৪৯)। কিন্তু তাদের দুজনের জন্মের আনন্দময় স্মৃতি আমাদেরকে আলোড়িত করে না, বরং আগস্টের ১৫ তারিখ জাতির পিতার পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাদের নৃশংসভাবে নিহত হবার স্মৃতিই আমাদেরকে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তোলে।
তারপরও জন্মদিন বলে কথা। প্রতিবছর তাদের অবর্তমানেই আমরা তাদের জন্মদিনে স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। শেখ কামালের জন্মদিন ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত। দেশের সংবাদপত্র টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশ এবং প্রচারিত হয়েছে। তার সহপাঠীরা জানিয়েছেন কী অমায়িক আর সহজ মানুষ ছিলেন তিনি। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর কী জঘন্য মিথ্যাচার আর অপপ্রচার চালানো হয়েছিল শেখ কামালকে নিয়ে! জাসদের পত্রিকা দৈনিক গণকণ্ঠ আর মওলানা ভাসানী ন্যাপের মুখপত্র ‘হক কথা’ যে কী ভয়ংকর না হক কথার মিথ্যাচার করেছে, তা আজ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। এখনও পুরানো পত্রিকা ঘাটলে সেই ভয়াবহ মিথ্যাচারের প্রমাণ মিলবে।
স্কুলজীবন থেকেই শেখ কামাল একজন প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ, নাট্যাভিনেতা, সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক হিসেবে মেধার স্বাক্ষর রেখে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর কারা-জীবনকালে কৈশোর থেকে কীভাবে সংসারে মাকে সহযোগিতার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন, তার বিশদ বিবরণ পড়ে আমরা চমকে উঠি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি অর্জন শেষে এমএ ফাইনাল পরীক্ষার ভাইভাও দিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ শেখ কামাল তার রেজাল্ট দেখে যেতে পারলেন না। উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল বলেই সেনাবাহিনী কমিশন্ড অফিসার (ক্যাপ্টেন) এর চমৎকার সম্ভাবনাময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরে আবার ফিরে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। লেখাপড়া খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তিনি।
বিয়ে করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল খুকীকে। বিয়ের মাস পূর্ণ হতে না হতেই ১৫ আগস্ট! হাতের মেহেদি ঢাকা পড়ে গেল রক্তে! মুছে গেল প্রিয় যুগলের জীবনবাস্তবতা!
এরকম মর্মান্তিক স্মৃতি নিয়েই ফিরে আসে স্নেহময়ী বঙ্গমাতা এবং তার প্রিয়পুত্র শেখ কামালের জন্মদিন।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে বেগম ফজিলাতুন নেছা ওরফে রেণু অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। শিশু বয়সে পিতৃহারা ফজিলাতুন নেছা রেণু লালিত-পালিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহময়ী মায়ের কাছে। তাদের বিয়ে হয়েছিল শিশু বয়সেই। দাম্পত্য জীবন আরও বেশ কয়েকবছর পরে।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তার বিশদ বর্ণনা আছে। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর জীবনের ছায়াসঙ্গী এই মহীয়সী নারী জাতির পিতার উত্থান-পতনে তোলপাড় রাজনৈতিক জীবনের কত যে দুঃখ আর দুর্যোগ সহ্য করে গেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বিভাগ পূর্ব কাল থেকে বঙ্গবন্ধুর সুখদুঃখের নিত্যসঙ্গী ছিলেন বঙ্গমাতা। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে তার কারাগারে। শুধু কারাগারে বন্দিই রাখা হয়নি, তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার চেষ্টাও হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত নিরন্তর তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে।
এসব চরম দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী সহযোদ্ধা পত্নী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন অবিচল সংগ্রামী। স্বামীকে শক্তি সাহস জুগিয়েছেন আবার তার অবর্তমানে তার হয়ে করণীয় কাজ সম্পাদন করেছেন।
আইনি লড়াইয়ের জন্য উকিল খুঁজে বের করা, মামলার খরচ জোগানো--কত কষ্টই না তিনি করেছেন! নিজের সোনার অলংকার বিক্রি করে মামলার খরচ চালিয়েছেন। মামলার কাগজপত্র নিয়ে উকিল কোর্টকাচারি সামাল দেয়াসহ কতইনা ছোটাছুটি তার!
বৈরী পরিবেশে ছুটে বেড়িয়েছেন ঢাকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত! পুলিশ গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছুটে গেছেন বিভিন্ন নেতাকর্মীদের সুখ-দুঃখ দেখতে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখার জন্য কত কী-ইনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হয়ে তার নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন নেতাকর্মীদের কাছে। কর্মীরা ছুটে এসেছেন তার কাছে। তাদের আপ্যায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা জানিয়ে সেভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর তো সংসারের দিকে ফিরে তাকাবার সুযোগই পাননি। ঝড়ঝাপটা সব গেছে প্রিয়তমা স্ত্রীর ওপর দিয়ে।
এমনও হয়েছে সংসারে বাজার করার টাকা নেই। সন্তানদের শুধু খিচুড়ি খাইয়েছেন। এমন উৎসাহ দিয়েছেন যাতে সন্তানদের মনোবল ভেঙে না যায়। স্বামীর কারাবন্দি জীবনের বাস্তবতায় কখনও ভেঙে পড়েননি তিনি। বরং তিনপুত্র, দুই কন্যাকে নিয়ে চরম বৈরী পরিবেশেও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা করেছেন। অপরদিকে অর্থনৈতিক সংকট অতিক্রম করে হাসি মুখে সংসারে সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে বয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে সংসার নিয়ে কখনও্র কোনো অভিযোগ করেননি। কোনোরকম উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়ও রাখেননি। বরং সব সময় দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রাণিত করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন।
জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র মতো অসাধারণ ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ হয়তো জাতি কখনও পেত না, যদি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রেণু তাকে আত্মজীবনী লিখতে অনুপ্রেরণা না দিতেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী শুরু হয়েছে তার প্রিয় সহধর্মিণীর সেই অনুপ্রেরণার উল্লেখের মধ্যে দিয়ে।
প্রথম পৃষ্ঠাতেই তিনি লিখছেন “... আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” বললাম “লিখতে যে পারি না; আর এমনকি করেছি যা লেখা যায়।... আমার স্ত্রীর ডাকনাম রেণু … আমাকে কয়েকটা খাতা কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেনু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।”
বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন তথা কৈশোর থেকে নিরন্তর সংগ্রামে দুঃখকষ্ট, হাসিকান্নায় পরম ধৈর্যে ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত তার প্রিয় সহধর্মিণী। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বহু জায়গায় তার প্রিয়তমা স্ত্রীর সেবা, ভালোবাসা, পরিচর্যা আর নিরন্তর অনুপ্রেরণার কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। তরুণ ছাত্রনেতা ভাষাসংগ্রামী শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের নেতা হওয়া থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা পর্যন্ত যে বিশাল কণ্টকিত পথ, সে পথের নিত্যসঙ্গী ছিলেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর সকল সংগ্রামের নেপথ্য শক্তি জুগিয়েছেন এই সর্বংসহা মহীয়সী নারী।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গবন্ধুকে আইয়ুব সরকার আন্দোলনের মুখে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিল না তখন আপস আলোচনার জন্য গোলটেবিল বৈঠকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যোগ দেবার প্রস্তাব দেয়। বঙ্গবন্ধুকে রাজি করানোর জন্য একটি চক্র পাচার করতে থাকে। এই কঠিন ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে বের না হওয়ার জন্য কঠোর অবস্থান নেন বঙ্গমাতা। সেদিন বঙ্গমাতার এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভূমিকায় রক্ষা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে, রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। আইয়ুব খানের চক্রান্ত ভেস্তে গেছে বঙ্গমাতার সচেতন ভূমিকার কারণে।
শুধুই একটি ঘটনা নয়, এমন বহু যুগান্তকারী ঘটনার কেন্দ্রে ছিলেন বঙ্গমাতা।
এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের কথা বলা যায়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিতে যাবেন। ভীষণ উদ্বিগ্ন তিনি। একদিকে ছাত্র ও যুবসমাজের প্রবল চাপ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার, অপরদিকে সরাসরি ঘোষণা দিলে সামরিক হামলার চরম বিপর্যয়ের শঙ্কা বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশে যাত্রালগ্নে সেই উৎকণ্ঠার মধ্যে বঙ্গমাতার কী অসাধারণ অনুপ্রেরণামূলক পরামর্শ!
“সারা জীবন তুমি সংগ্রাম করেছ, তুমি জেলজুলুম অত্যাচার সহ্য করেছ, তুমি জানো যে, দেশের মানুষের জন্য কী চাই, তোমার থেকে বেশি তা কেউ জানে না। তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি শুধু সে কথাটাই বলবে।”
সেই অসামান্য প্রেরণা আজ ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকের মতো তিনি দলের নেতা-কর্মী এবং কারারুদ্ধকর্মীদের স্বজন-পরিজনদের যেভাবে আপ্যায়ন করেছেন, সহমর্মিতা জানিয়েছেন, তা দুঃসময়ে দলকে সংগঠিত রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার চরণ যেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতার জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য!
“কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়ালক্ষ্মী নারী”
কিংবা
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”
বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ এই পরস্পর নির্ভরতার উজ্জ্বল চিত্রই তুলে ধরেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পর বার বার কারাবন্দি হন বঙ্গবন্ধু। তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও অনেকেই কারাগারে। সেই চরম দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের সাহস জুগিয়ে অনুপ্রাণিত করে রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সঙ্গে সহযোগী ভূমিকায় ছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল। কর্মীরাও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বঙ্গমাতার কাছেই ছুটে আসত। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নির্দেশনা এ নেতা-কর্মী এবং কারারুদ্ধদের স্বজনদের যেভাবে আপন বিবেচনা করেছেন, আপ্যায়ন করেছেন, বিপদে সহমর্মিতা জানিয়েছেন, তা দলকে সংগঠিত রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৬৬ সালের ৬ জুলাইয়ের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে। নিজহাতে রান্না করে তিনি কর্মীদের খাইয়েছেন। যেন সহধর্মিণীর চেয়ে রাজনৈতিক সহকর্মীর ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন এই মহীয়সী নারী।
দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, তখনো তার সরল-সহজ জীবনের বৃত্ত থেকে তিনি সরে যাননি। সেই মমতাময়ী রূপ সর্বত্রই ছিল দৃশ্যমান। ১৯৭২-এর জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু যখন ফিরে এলেন তখন অনেক সমস্যার মধ্যে একটি সমস্যা ছিল যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর হাতে লাঞ্ছনার শিকার বীরাঙ্গনা নারীদের পুনর্বাসন এবং যুদ্ধশিশুদের পরিচয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পিতার নাম লিখে দিও শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গমাতা নিজেও বীরাঙ্গনাদের বলেছিলেন, আমি তোমাদের মা।
মাতৃস্নেহে তিনি অনেক বীরাঙ্গনা কন্যার বিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সারাজীবন একটাই আরাধ্য ছিল, বাঙালির স্বাধীনতা আর শোষণ থেকে মুক্তি। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছাও দেশের কথাই ভাবতেন। বঙ্গবন্ধুর মতো রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো ভোগ-বিলাসের প্রতি সামান্য দৃষ্টিও ছিল না তাঁর। তিনি বরাবরই সাধারণ সুতি শাড়ি পরতেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে স্বাধীনতার পরও তিনি সেই সহজ-সরল সাধারণ অনাড়ম্বর জীবনই যাপন করে গেছেন!
রাসেলের জন্মদিনের ঘরোয়া অনুষ্ঠানের একটি ফটোগ্রাফ, সম্ভবত ১৯৭৪ কি ৭৫ সালের, ফেসবুক দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। কত ছোট্ট একটি কেক! অতি সাধারণ অনাড়ম্বর আয়োজন। সাধারণ পোশাকে তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা- শেখ রেহানা, পুত্র রাসেলসহ পরিবারের সব সদস্য মিলে জন্মদিন পালন করছেন কাঠের ডাইনিং টেবিলে। একটি দেশের রাষ্ট্রপতির সন্তানের জন্মদিন এত সাদামাটা হয়! কল্পনাই করা যায় না।
এই সাধারণ জীবনই বঙ্গবন্ধু যাপন করেছেন,তার প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও ততধিক সাধারণ জীবনই যাপন করে গেছেন। যে কারণে তার সন্তানরাও ভোগবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হননি। দেশপ্রেম, সততা আর সহজ মানুষ হিসেবে বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে বঙ্গমাতা এবং তাদের সন্তানেরা জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
জীবনে যেমন মরণেও বঙ্গমাতা স্বামী-সন্তানদের সঙ্গে একই রক্তশয্যায় মমতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বড় অকালে চির বিদায় নিয়েছেন। এমনই মহীয়সী নারী জন্ম দিয়েছিল এই বাংলার পলিমাটি।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক (বার্তা), বাংলাদেশ টেলিভিশন।