বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বঙ্গমাতা: মমতাময়ী বিজয়লক্ষ্মী নারী

  • খায়রুল আলম   
  • ৭ আগস্ট, ২০২১ ২৩:১৭

বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। আর সেটা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন দক্ষ নারী সংগঠক হিসেবে। যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছেন।

খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং সবশেষে বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যে নারীর অবদান অনস্বীকার্য, তিনি আর কেউ নন; তিনি আমাদের নারী জাতির অহংকার শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। যিনি সোনার বাংলা বিনির্মাণে আড়ালে অন্তরালে থেকে রেখেছেন অসামান্য অবদান। যিনি কখনো নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগবিলাসের কথা ভাবেনি। ভেবেছেন দেশ, দেশের মানুষ আর নেতা-কর্মীদের কথা। বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবনে দক্ষ হাতে সামলিয়েছেন ছেলেমেয়ে, সংসার এবং ভেবেছেন নেতা-কর্মীদের কথা। সেই দক্ষ সংগঠক মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

তিনি এক মহীয়সী নারীর অনন্য উদহারণ। যিনি নিজের ও পরিবারের স্বার্থ ত্যাগ করে কাজ করেছেন বাঙালি জাতির জন্য। যেমন বলা যায় এই লেখাটির অংশবিশেষে: ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন, দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ, আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান, আমার জন্য চিন্তা করবেন না।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকাকালে তার স্ত্রীর লেখা একটি চিঠির অংশ এটা। এভাবেই স্বামীর পাশে থেকে সারা জীবন উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন বিজয়লক্ষ্মী নারী জাতির পিতার অর্ধাঙ্গিনী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। স্বাধীনতার জন্য বঙ্গমাতার মহান ত্যাগ ইতিহাসে চিরভাস্মর হয়ে আছে। পিতৃ-মাতৃহারা এক অনাথ শিশুজীবন শুরু করেছিলেন শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। নিজের আন্তরিকতা, প্রচেষ্টা ও মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে এগিয়ে গেছেন তিনি।

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট। শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হক এবং হোসেন আরা বেগমের কোল আলো করে শ্রাবণের দুপুরে জন্ম নিল এক মহীয়সী নারী ফজিলাতুন নেছা, যার ডাকনাম রেনু। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি তার পিতাকে হারান। তারপরে দুই বছরের মাথায় তার মাকেও হারান। বড় বোন জিনাতুন্নেছা, ডাকনাম জিন্নি ও ছোট বোন ফজিলাতুন নেছা- এই দুই অনাথ শিশুর দায়িত্ব নেন বঙ্গমাতার দাদা শেখ মো. আবুল কাসেম। দাদার ইচ্ছায় মাত্র তিন বছর বয়সের ফজিলাতুন নেছা সঙ্গে দশ বছরের শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয়। শাশুড়ি সায়রা খাতুন এবং শ্বশুর শেখ লুৎফর রহমানের কাছে তিনি বাড়ির বউ হয়ে থাকেননি, থেকেছেন নিজের সন্তান হয়ে। শিশু অবস্থায় বিয়ে হলেও বঙ্গমাতার সংসার শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর এন্ট্রান্স পাসের পর ১৯৪২ সালে।

ফজিলাতুন নেছা মুজিব স্থানীয় একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হলেও তার স্কুলজীবনের পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। তিনি ঘরে বসেই পড়ালেখা শিখেছেন। তারা যখন সংসার শুরু করেন, তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স ১৯ বছর আর ফজিলাতুন নেছার বয়স ১০ বছর। স্বামী বাইরে থাকাকালীন ফজিলাতুন নেছা অবসর সময়ে বিভিন্ন রকমের বই পড়তেন, গান শুনতেন।

বাংলাদেশের মুক্তির দীর্ঘ সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও দেশ গঠনে উচ্চারিত নাম মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার নামের সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত নামটি শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। যখনই আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলি, তখনই বঙ্গমাতার নাম চলে আসে।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের সঙ্গে বঙ্গমাতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জন বাঙালি নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্য এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। বঙ্গবন্ধু এ মামলায় বিচলিত না হয়ে আইনিভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আইনজীবীদের অর্থ জোগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হলে বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দাবিতে বাঙালি রাস্তায় নামে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজপথ বিক্ষোভে জনসমুদ্রে পরিণত হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকেও গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। আন্দোলনের বেগবানতায় কার্যত তখন সরকার পিছু হটে। পাকিস্তান সরকার এ সময় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্যারোলে মুক্তির সিদ্ধান্তে বেঁকে বসেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে জোরালো আপত্তি জানান।

পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে প্যারোলে নয়, নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। তিনি কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোর বৈঠকে যেতে নিষেধ করেন। তিনি আরও বুঝতে পেরেছিলেন, শেখ মুজিবের ব্যাপারে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে। ফজিলাতুন নেছা পরামর্শে শেখ মুজিব অনড় থাকেন।

প্যারোলে মুক্তির ক্ষেত্রে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করেন। ইতোমধ্যে শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভ করেন। পরদিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার শেখ ফজিলাতুন নেছা এই সিদ্ধান্ত যেকোনো মাপকাঠিতে অনন্য হিসেবে স্বীকৃত।

বঙ্গবন্ধু কলকাতায় লেখাপড়া ও রাজনীতি করতেন, দফায় দফায় কারাবরণ করেছেন। এই নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না তার। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘রেনু খুব কষ্ট করত কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখত। যাতে আমার কষ্ট না হয়।’

১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের প্রথম সন্তান জন্মের সময় মারা যায়। দুই কন্যা ও তিন পুত্রসন্তানের মধ্যে ’৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৯ সালে পুত্র শেখ কামাল, ১৯৫৩ সালে শেখ জামাল, ১৯৫৭ সালে কন্যা শেখ রেহানা, ১৯৬৪ সালে পুত্র রাসেল জন্মগ্রহণ করেন।

অনন্য মানবিক গুণাবলি ছিল তার। ঘরে বসে নিজেই স্কুল খুলে মেয়েদের লেখাপড়া ও সেলাই শেখাতেন। গরিব ছেলেমেয়ে, এতিম, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতাকে অর্থসাহায্য করতেন। দলের নেতা-কর্মীদের চিকিৎসার খরচ জোগাতেন। সংগঠন ও আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন মেটাতে নিজের সম্পদ বিলিয়ে দিতেন। তার কাছ থেকে কেউ কোনো দিন রিক্ত হস্তে ফেরেনি।

পূর্ব বাংলার নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু অহরহ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরেছেন, জীবনের সোনালি সময়ের চৌদ্দ বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ছিলেন। বঙ্গমাতা সন্তান প্রতিপালন ও লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলে আইনজীবী নিয়োগ, মামলা চালানোর খরচ, কোর্টে যাওয়া, নিজে রান্না করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া, সাক্ষাতের সময় সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কাছে পৌঁছে দিয়ে তা কার্যকর করতেন। বাড়িতে দলের সভা পরিচালনা, দলের খরচ জোগানো, রান্না করে নেতা-কর্মীদের খাওয়ানো সবকিছু সুনিপুণভাবে সম্পাদন করতেন। মামলার খরচ ও সংগঠনের খরচ জোগাতে নিজের গহনা, ঘরের ফ্রিজ বিক্রয় করেছেন তিনি।

১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ, প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়, বঙ্গবন্ধু সদস্য নির্বাচিত হন। টুঙ্গিপাড়া থেকে বঙ্গমাতা ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় এলেন, রজনী বোস লেনে একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করলেন। ১৫ মে বঙ্গবন্ধু কৃষি উন্নয়ন, বন ও সমবায়মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ৩০ মে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলা মন্ত্রিসভা বাতিল করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে।

১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, বঙ্গবন্ধু শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও ভিলেজ এইডমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মন্ত্রীর চেয়ে দলের দায়িত্বকে প্রাধান্য দিয়ে স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দল গোছাতে মনোযোগ দিলেন বঙ্গবন্ধু। এই নিয়ে কোনো অনুযোগ ছিল না বঙ্গমাতার। হাসিমুখে স্বামীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে সংসদ ভেঙে দেয়। ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন। শুরু হলো বঙ্গমাতার কষ্টের আরেক অধ্যায়। স্বামী কারাগারে, কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইল না। তিন দিনের নোটিশে সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হলেও তিনি অটল থেকেছেন হিমালয়ের মতো।

এ প্রসঙ্গে কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, লড়াই, সংগ্রামে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু কখনো মাকে ভেঙে পড়তে দেখিনি। যত কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনোই বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার করো বা খরচ দাও। আব্বা যে পদক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি।’

নিজের জমানো টাকা ও আবাসন ঋণ নিয়ে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি নির্মাণ করেন। এ প্রসঙ্গে বেবী মওদুদ ‘মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘সব কাজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতেন। খরচ বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে পানি দেয়া, ইট ভেজানোসহ বহু শ্রম, যত্ন ও মমতা দিয়ে বত্রিশ নম্বরের বাড়িটি নির্মাণ করেন।’

জাতির এক সন্ধিক্ষণে বঙ্গমাতা মুজিবের একটি সিদ্ধান্ত বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্যারোলে মুক্তি নিতে চাপ দেয়া হয়। মাকে ভয় দেখানো হয়েছিল ‘পাকিস্তানিদের শর্ত না মানলে তিনি বিধবা হবেন।’ কিন্তু মা কোনো শর্তে মুক্তিতে রাজি হননি। আব্বাও প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মায়ের মেসেজ ঠিক সময়ে বাবাকে জানাতে পারায় এবং বাবা পাকিস্তানিদের প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সে সময় অনেক আওয়ামী লীগ নেতাই আমাকে বলেন- তুমি কেমন মেয়ে হে, বাবার মুক্তি চাও না।’

১৯৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জে ছয় দফার সমর্থনে জনসভা করে ঘরে ফেরার পর গভীর রাতে গ্রেপ্তার হন। ওই সময় ছয় দফা না আট দফা বিভ্রান্তিতে অনেক নেতাও আট দফার পক্ষে কথা বলেন। ছয় দফা থেকে একচুলও নড়া যাবে না- বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ বাস্তবায়নে বঙ্গমাতা ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখেন। ছয় দফার সমর্থনে বোরকা পরে জনসংযোগ করেন।

১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবকে। তখন বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কি না, এই খবর প্রায় পাঁচ মাস অজানা ছিল। সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন যখন বঙ্গমাতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এলো, তখন জানা গেল তিনি ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসের একটি কক্ষে বন্দি। সেখানে কোনো বাতাস নেই, একটি বাল্ব জ্বলে, দিন-রাত বোঝা যায় না। জিজ্ঞাসাবাদে কোনো তথ্য না পেয়ে ক্যাপ্টেন হুমকি দেয় প্রয়োজনে বঙ্গমাতাকে গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি ভয় পাওয়ার মানুষ নন। ওই সময় প্রতিটি বন্দি পরিবারের নিয়মিত খোঁজখবর নেন ও সহযোগিতা করেন, মামলা পরিচালনার জন্য প্রবাসী বাঙালিদের সহায়তায় লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বঙ্গমাতার বুদ্ধিমত্তার ছাপ। ওই দিনের ঘটনার স্মৃতিচারণা করে বঙ্গমাতার জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭ মার্চ ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে! সবাই এসেছে- এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আব্বাকে সোজা বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, তুমি জেল খেটেছ। তুমি জান কী বলতে হবে? তোমার মনে যে কথা আসবে, সে কথাই বলবা।’

এরপর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে তর্জনী উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার সেই ডাকেই স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ডাকে ছিল বঙ্গমাতার সমর্থন। আর এই সমর্থন বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছিল। আজ এই ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনেও বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যায় শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে।

’৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বত্রিশ নম্বর বাড়ি আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। বঙ্গমাতা ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রথমে পাশের বাসায় আশ্রয় নেন। বত্রিশ নম্বর বাড়ি তছনছ করে, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার সামনে বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। বড় ছেলে শেখ কামাল ২৫ মার্চ রাতেই মুক্তিযুদ্ধে যান, আটক অবস্থায় শেখ জামালও যান। উনিশবার জায়গা বদল করেও রেহাই পেলেন না, একদিন মগবাজারের বাড়ি থেকে ছেলেমেয়েসহ বঙ্গমাতাকে গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে রাখে পাকসেনারা। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কি না জানতেন না তিনি। বন্দি অবস্থায় কন্যা শেখ হাসিনার সন্তান জন্ম নেয়ার সময় তাকে একবারের জন্যও ঢাকা মেডিক্যালে যেতে দেয়া হয়নি।

কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা ‘একজন আদর্শ মায়ের প্রতিকৃতি’ লেখায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “জুলাই মাসের শেষ দিকে হাসু আপা হাসপাতালে গেল। মা যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েও যেতে পারলেন না। সৈন্যরা তাকে যেতে দিল না। বলল, ‘তুমি কি নার্স, না ডাক্তার যে সেখানে যাবে?’ মা খুব কষ্ট পেয়ে সারা রাত কেঁদেছিলেন।” বন্দি অবস্থায় তিনি অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়ির চিকিৎসার ব্যবস্থা করান তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়), সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, খবরাখবর আদান-প্রদান করতেন।

তাদের যুদ্ধদিনের বন্দিদশার অবসান ঘটে ১৭ ডিসেম্বর। মুক্তি পেয়ে বঙ্গমাতা বাড়ির ছাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে টুকরো টুকরো করে আগুন ধরিয়ে দেন। জয় বাংলা স্লোগান দেন। এ সময় হাজার হাজার জনতা ছুটে আসে।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর সেখান থেকেই লন্ডনে যান। লন্ডন থেকেই বেগম মুজিবের সঙ্গে তার প্রথম কথা হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ান তিনি। অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবন দেন।

স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশে বঙ্গমাতা বলেন, ‘আমি তোমাদের মা।’ তিনি বলেন, ‘এই বীরাঙ্গনা রমণীদের জন্য জাতি গর্বিত। তাদের লজ্জা কিংবা গ্লানিবোধের কোনো কারণ নেই। কেননা তারাই প্রথম প্রমাণ করেছেন যে, কেবল বাংলাদেশের ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও আত্মমর্যাদাবোধে কী অসম্ভব বলীয়ান। (দৈনিক বাংলার বাণী, ১৭ ফাল্গুন, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)।’

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা অবিচ্ছিন্ন সত্তা ছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থে মযহারুল ইসলাম লিখেছেন, “আমি বঙ্গবন্ধুর অনাবিল সাক্ষাৎকার লাভ করেছি। একবার তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে দুটো বৃহৎ অবলম্বন আছে- একটি আমার আত্মবিশ্বাস, অপরটি- তিনি একটু থেমে আমাকে বললেন, অপরটি বলুন তো কী?’ হঠাৎ এ রকম একটি প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি একটু মৃদু হেসে বললেন, ‘অপরটি আমার স্ত্রী, আমার আকৈশোর গৃহিণী’।”

তিনি বঙ্গবন্ধুকে শক্তি, সাহস, মনোবল, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বলেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, বঙ্গবন্ধু ‘জাতির পিতা’ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জীবনে যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন, সবটাতেই বঙ্গমাতা তাকে ছায়ার মতো সাহায্য করেছেন। ড. নীলিমা ইব্রাহিম বলেন, ‘রেনু ছিলেন নেতা মুজিবের Friend, Philosopher and Guide।’

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে নিকষ কালো অধ্যায়। খুনি মোশতাক, খুনি জিয়া বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গমাতা সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে ঘাতকদের বলেন, ‘তোমরা আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’ জীবনের মতো মরণেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী হলেন এই মহাপ্রাণ নারী।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় মানবী। বিশ শতকের প্রথমার্ধে নারীর অবরোধের বেড়াজাল উপেক্ষা করে সাহসী পদক্ষেপে বেরিয়ে আসেন তিনি। সহধর্মিণী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক শেখ মুজিবের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে পাশে ছিলেন।

বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। আর সেটা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন দক্ষ নারী সংগঠক হিসেবে। যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছেন।

লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)

এ বিভাগের আরো খবর