বাংলাদেশ ক্রিকেটের পথচলাটা মসৃণ নয়। অনেক উপেক্ষা-অবহেলা সয়ে সয়ে আমাদের এগোতে হয়েছে। এমনও সময় এসেছে, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নেয়ার আলোচনাও উঠে এসেছিল। সেই দিন বাংলাদেশ পেছনে ফেলে এসেছে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ এখন পরীক্ষিত শক্তি। নিজেদের দিনে যে কাউকে হারানোর ক্ষমতা আছে বাংলাদেশের। টেস্টেও বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো। তবে টি-২০ ফরম্যাটের খেলাটা যেন বাংলাদেশ পারাছিলই না। টি-২০ ফরম্যাটে বলার মতো কোনো সাফল্য ছিল না। তবে আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় টি-২০ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দলকে নতুন করে সাজানো এবং আত্মবিশ্বাসী করে তোলাটা জরুরি ছিল। সেই জরুরি কাজটা দারুণভাবে করেছে এবং করছে বাংলাদেশ।
জিম্বাবুয়েতে গিয়ে তাদের ২-১ ম্যাচে সিরিজ হারিয়ে আত্মবিশ্বাসের যে বারুদ এনেছিল, তাতেই এখন জ্বলেপুড়ে ছারখার অস্ট্রেলিয়া। জিম্বাবুয়েতে সিরিজ জেতা আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জেতা এক নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সূর্য অস্ত যাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়াই বিশ্ব ক্রিকেটের মূল শাসক। সেই অস্ট্রেলিয়াকে টানা তিন ম্যাচে হারিয়ে দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আজকে যখন বাংলাদেশ বলে কয়ে যে কাউকে হারিয়ে দিচ্ছে, তখন আমার বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপ খেলতে গেল বাংলাদেশ। সেখানে গিয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ জানিয়ে দিল, আমরা আসছি।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের সাফল্যের পথ ধরেই ২০০০ সালেই বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। অভিষেক ম্যাচে ভারতের সঙ্গে হারলেও বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছিল, আমরা একেবারে ফেলনা নই। মনে আছে শুরুর দিকে একেকটি জয় বাংলাদেশে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিত। ক্রিকেটই ছিল বাংলাদেশের ঐক্যের মন্ত্র। সব দুঃখ-কষ্ট-অপ্রাপ্তি মানুষ ভুলে যেত একেকটি জয়ে। মনে আছে, আইসিসির দিনগুলোয় বাংলাদেশের মানুষ কানে রেডিও লাগিয়ে খেলা শুনত। হঠাৎ রাস্তায় চিৎকার শুনলেই বুঝতে হতো, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা চার-ছক্কা মেরেছে বা প্রতিপক্ষের উইকেট নিয়েছে।
তখন কেনিয়াকে হারালেও মধ্যরাতে বাংলাদেশে মিছিল হতো। এখন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জিতলেও আমরা ফেসবুকে অভিনন্দন জানিয়েই দায়িত্ব সারি। আমি এটাকে বলি অর্জন ক্লান্তি। ঘন ঘন সাফল্য আসলে তা ডালভাত হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যতই ক্লান্ত হই, বাংলাদেশ তো আর বসে থাকবে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে।
আগেও জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো বা ২০০৫ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো তো রূপকথারই অংশ। তবে বাংলাদেশের সাফল্যযাত্রাটা আসলে শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে। সম্মানজনক পরাজয় আর মাঝে মাঝে জয়ের ধারা থেকে বেরিয়ে জয়কে নিয়মিত বানিয়ে ফেলার শুরুটা তখনই। মাশরাফিই আসলে বদলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর একের পর এক সিরিজ জয়, বাংলাদেশকে বিশ্ব ক্রিকেটে সম্মানজনক আসনে বসিয়ে দেয়। এরপর বাংলাদেশ সব জিতেছে এমন নয়। তবে বাংলাদেশ এখন সব ম্যাচেই জয়ের জন্য খেলতে নামে। আর জয়-পরাজয় তো খেলারই অংশ।
একসময় বাংলাদেশের জয়ের কান্ডারি ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার আশরাফুল ভালো খেললেই বাংলাদেশ জিততো। আশরাফুলের দুঃখজনক বিদায়ের পর বাংলাদেশের জয়ের দায়িত্ব পরে পঞ্চপাণ্ডবের ঘাড়ে। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক আর মাহমুদুল্লাহ- এই পাঁচজনই ভাগ করে নেন জয়ের দায়িত্ব। আর একজনের দায়িত্ব পাঁচজনের কাঁধে যাওয়ায় জয়ও আসতে থাকে ঘন ঘন। তবে অনেকদিন ধরেই একটা আলোচনা ডালপালা মেলেছে, পঞ্চপাণ্ডবের পর কারা। আর কিছু না হোক বয়সের কারণেও তো একসময় ফুরাবে পঞ্চপাণ্ডবের দিন।
আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও মাশরাফি যুগের অবসান ঘটে গেছে। মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ার নিয়ে নানান টানাহ্যাচড়া চলছে। অভিমানে ১৫০ করা টেস্টেই বিদায় বলেছেন তিনি। যদিও টি-২০-এর নেতৃত্ব এখন তার কাঁধেই। একবছরের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাকিব আবার সাকিবের মতোই জ্বলে উঠছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যেকোনো ফরম্যাটে প্রথম সিরিজ জয় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমি তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানি বাংলাদেশ দলে তারুণ্যের জয়গান। পঞ্চপাণ্ডবের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের সাফল্য যাদের সয় না, এটা অস্ট্রেলিয়ার বি-টিম। মূল শক্তি নিয়ে আসেনি অস্ট্রেলিয়া। তাদের একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশও কিন্তু মূল শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে পারেনি। তামিম, মুশফিক, লিটন নেই দলে। তাই দুই দেশের জন্যই বেঞ্চের শক্তি পরীক্ষার সিরিজ ছিল এটা। সেই পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি দুটি ম্যাচ জিতলে গোল্ডেন জিপিএ ৫ হবে। আমার সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছে তামিম, মুশফিক, লিটনের অভাবটা বুঝতেই দেননি তরুণরা। জিম্বাবুয়ে থেকেই তারুণ্যের জেগে ওঠা। কখনও শামিম ম্যাচ জেতাচ্ছেন, কখনও আফিফ, কখনও নাসুম।
শরিফুল, নুরুল হাসানরাও সুযোগ পেলেই নিজেদের সক্ষমতার জানান দিচ্ছেন। সিনিয়রদের পরামর্শ তাদের সাহস দিয়েছে। তবে নিজেদের যোগ্যতা না থাকলে শুধু সাহস দিয়ে তো আর ম্যাচ জেতা যায় না। মুস্তাফিজ আর তাসকিনকে ঠিক তরুণ বলা যাবে না। তবে জিম্বাবুয়েতে যেন তাসকিনের পুনর্জন্ম হয়েছে। আর মুস্তাফিজ তো প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের কাছে চির রহস্যের নাম। দুই ওভারে দরকার ২২ রান। এসন সময়ে ১৯তম ওভারে ১ রান দেয়া আসলে যেকোনো মানদণ্ডেই সেরা। তৃতীয় ম্যাচে মুস্তাফিজ কোনো উইকেট পাননি। কিন্তু চার ওভারে ১৯ রান দিয়ে তিনিই ম্যাচের মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার।
সব খেলাই আসলে রিলে রেসের মতো। এক প্রজন্ম ব্যাটনটা দিয়ে যায় পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। তারুণ্য বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডব যুগের অবসান ঘটলেও ভয় নেই। তারা দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন তারুণ্যের জয়গান-
“তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!”
লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক