বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনার থাবা ও অন্তঃসত্ত্বা মায়ের ঝুঁকি

  •    
  • ৭ আগস্ট, ২০২১ ১৪:৫১

মধ্যবিত্তদের একটি অংশ কাজ হারিয়ে দরিদ্র হয়ে গেছে। দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এসব পরিবারে যারা গর্ভবতী নারী আছেন, তাদের মাতৃত্ব এমনিতেই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অভাব-অনটনে গর্ভবতী নারীর জন্য সেবাযত্ন, চিকিৎসা-সুবিধা সবই হ্রাস পেয়েছে।

জীবন এখন খুব অদ্ভুত। করোনা এসে মানুষের স্বাভাবিক দুঃখ-কষ্ট, সমস্যা, ভয় সবকিছুকে বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ। যেটুকু আনন্দ আসে মনে বা পরিবারে, এক ধাক্কায় তা ধূলিসাৎ হয়ে যেতেও সময় লাগে না। যেমনটা ঘটেছে রিনাদের পরিবারে। বিয়ের ৬/৭ বছর পরে রিনা মা হতে যাচ্ছিল। পরিবারে সুখের কমতি ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে গত জুলাইতে রিনাসহ পরিবারের দুজন করোনা আক্রান্ত হলো। বাকিরা সুস্থ হয়ে গেলেও রিনা বাঁচল না। যমে মানুষে টানাটানি শেষে যম জয়ী হলো। পরিবারটির স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেল।

এটা যেমন একধরণের সমস্যা করোনাকালে, তেমনি অন্তঃসত্ত্বা মায়ের জন্য অন্যধরনের সমস্যাও রয়েছে। গতবছর আমার অন্তঃসত্ত্বা বোন সুবর্ণার হঠাৎ খুব পেটব্যথা শুরু হয়েছিল রাতের বেলা। লকডাউনের কারণে স্বভাবতই কোথাও কোনো গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। যাহোক একজন প্রতিবেশীর গাড়িতে ওরা এল ধানমন্ডির এক হাসপাতালে। হাসপাতাল জানাল তাদের হাসপাতালে গাইনি টিমের কেউ নেই এখন, কাজেই রোগীকে তারা দেখবে না।

অগত্যা আরেক ডাক্তারের পরামর্শমতো ওরা গেল পাঁচতারকা হাসপাতালে। সেখানেও হাসপাতাল লকডাউনে আছে উপরের নির্দেশে। নিজেদের রোগী ছাড়া আর কাউকে তারা দেখবে না করোনার কারণে। একজন রোগীকে আগে করোনা টেস্ট করতে হবে। নানা জটিলতায় সেখানেও ডাক্তার দেখানো হলো না। ততক্ষণে আমার বোনের ব্যথা অনেকটাই বেড়ে গেছে। ওর শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছিল ব্যথায় এবং ভয়ে।

পরে অন্য একটি হাসপাতালে রাত ১২:৩০ থেকে ২:৩০ পর্যন্ত পরীক্ষা করে বোঝা গেল গর্ভস্থ বাচ্চা এবং মা ভালো আছে। ব্যথাটি ছিল ইউরিন ইনফেকশনের। তবে হ্যাঁ এই ব্যথা বাড়তে থাকলে বাচ্চা ও মায়ের অসুবিধা হতো। করোনার ভয়ে পাঁচতারকা হাসপাতাল রোগী নেয়নি। আরেক হাসপাতাল তাদের নিয়মিত রোগীকে না দেখে রীতিমতো অপরাধ করেছে। ভোগান্তির শিকার হলো অন্তঃসত্ত্বা মা ও তার পরিবার।

আমার ভাইটা বলল, বিশ্বাস করো এত অসহায় আমি কোনোদিন বোধ করিনি। বার বার মনে হতে থাকল আমরা যদি কোনো হাসপাতালে যেতে না পারি, তাহলেতো আমার বাচ্চা, আমার স্ত্রী কাউকে বাঁচাতে পারব না। এই গর্ভবতী মায়ের মতো করোনাকালে অনেক মায়েরই অবস্থা হয়েছে। সময়মতো ওষুধ, ইনজেকশন, চেকআপ করানো কিছুই হচ্ছে না। করোনার ভয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে না অনেকে, অনেকে ভর্তি হওয়ার সুয়োগ পাচ্ছে না।

পত্রিকায় দেখলাম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সন্তানসম্ভবা মায়েদের মারা যাওয়ার হার বেশ উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। সংক্রমণ যত বাড়ছে, অন্তঃসত্ত্বা নারীর মৃত্যুও তত বাড়ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ৩৫ শতাংশই করোনা আক্রান্ত। ঢামেকের পরিচালক জানিয়েছেন ১ থেকে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে ১৪ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪৫ জন সন্তান সম্ভবা মা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন।

২৫ জুলাই, যুক্তরাজ্যের অবস্টেট্রিক সার্ভিলিয়েন্স সিস্টেম থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, মে মাসে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে মাঝারি থেকে জটিল ধরনের সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তার চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক হচ্ছে, অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা শুধু ভাইরাসের বিরুদ্ধেই দুর্বল নন, গর্ভধারণের শেষের দিকে আরও নানা রকমের সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে।

এছাড়া তাদের অনেকেই অনাগত সন্তানের ক্ষতি হবে ভেবে ভ্যাকসিন নিতে চান না। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মায়েদের ভ্যাকসিন দেয়ার পক্ষে। তারা বলেছে ভ্যাকসিন নিলে সম্ভাব্য ঝুঁকির তুলনায় উপকার বেশি। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাও অন্য নারীদের চাইতে গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে বেশি।

করোনার ধাক্কা সামলানো যেকোনো বয়সের, যেকোনো মানুষের পক্ষেই কষ্টকর। সেখানে গর্ভবতী মায়ের জন্য যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। একদিকে গর্ভাবস্থার বাড়তি যত্ন, অপরদিকে করোনার জন্য সাবধানতা। গর্ভাবস্থায় মাকে সব ধরনের ওষুধও প্রয়োগ করা যায় না। এইসময় এমনি মায়ের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হতে পারে, সেখানে করোনায় আক্রান্ত হলে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় রুচি চলে যায়, খেতে ইচ্ছা করে না। তাছাড়া করোনা চিকিৎসার জন্য রোগীকে হাসপাতালে যেতে হলে খরচও অনেক বেশি।

দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে গর্ভবতী নারীর নিত্যদিনের খাওয়া-বিশ্রাম, মানসিক শান্তির চিন্তা মাথায় উঠেছে, সেখানে করোনা এসে সমস্যাকে আরও অনেক জটিল করে তুলেছে। কারণ মধ্যবিত্তদের একটি অংশ কাজ হারিয়ে দরিদ্র হয়ে গেছে। দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এসব পরিবারে যারা গর্ভবতী নারী আছেন, তাদের মাতৃত্ব এমনিতেই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অভাব-অনটনে গর্ভবতী নারীর জন্য সেবাযত্ন, চিকিৎসা-সুবিধা সবই হ্রাস পেয়েছে।

বেলা বেগম ঠিক সেরকমই একজন, যিনি মা হতে চলেছেন। বেলা আমাদের এলাকায় একটা খুব ছোট দোকান চালাতেন। সেখানে তিনি পেটিকোট, ব্লাউজ সেলাই করতেন। কিন্তু করোনার কারণে দোকান বন্ধ করে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ চলে গেছেন। গ্রামে যাওয়ার সময় বেলা ছিল ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। সেদিন ফোন করে বললেন, কদিন ধরে জ্বর। শরীরে শক্তি নেই। বললাম দ্রুত করোনা পরীক্ষা করো। বললেন, আপা টাকার দরকার। বিকাশে টাকা পাঠানোর পর সদরে গিয়ে পরীক্ষা করালেন, ফলাফল পজিটিভ। এরপর অনেকবার ফোন করেও বেলাকে পাচ্ছি না, ফোন বন্ধ। জানি না এভাবে কজন অনাগত মা শুধু দারিদ্র্যের কারণে বিপদের মধ্যে পড়েছেন বা পড়তে যাচ্ছেন।

চিকিৎসকরা বলছেন এমনকি সদ্য বাচ্চা হওয়া মায়ের জন্যও সময়টা খারাপ। এমনিতেইতো ডায়াবেটিক রোগীরা করোনার কারণে অনেকটাই বিপদে আছেন, সেখানে গর্ভবতী নারী হলে সমস্যা অনেকেটাই প্রকট আকার ধারণ করে। এমনকি প্রিম্যাচিউর সন্তান জন্ম দেয়ারও আশঙ্কা থাকে। তাই কোনো গর্ভবতী নারী যদি করোনা আক্রান্ত হন বা উপসর্গ দেখা দেয়, তখন সঙ্গে সঙ্গেই কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কারণ একজন অনাগত শিশুর মায়ের দরকার দ্রুত চিকিৎসা, ওষুধ, সঠিক পরামর্শ, তরল পানীয় এবং বিশ্রাম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বলা হচ্ছে গর্ভবতী নারীকে সন্তান জন্ম দেয়ার পরেও খুব যত্নের সঙ্গে রাখতে হবে। কারণ মা যদি করোনা আক্রান্ত হন, তাহলে তার জন্য খুব দ্রুত হাসপাতাল, ইনটেনসিভ কেয়ার এবং ভেনটিলেটরের ব্যবস্থা করতে হবে। মহামারির ঠিক এই অবস্থায় গর্ভবতী নারীর জন্য এসবের ব্যবস্থা করা খুবই কঠিন।

বিশেষ করে জেলা-উপজেলা ও গ্রামগঞ্জে করোনাকালে হাসপাতাল সুবিধাদির অবস্থা খুবই শোচনীয়। কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কর্মরত একজন ডাক্তার বললেন, এখানে করোনার কথা বাদ দেন। অন্য সময়েইতো অন্তঃসত্ত্বা নারীকে চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে যায়। এখানে অনেক উপজেলা আছে, অনেক ইউনিয়ন আছে, যেখানে বিপদের সময় গর্ভবতী মাকে নিয়ে আর হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। নৌকা ও ভ্যানগাড়িতে চড়ে, ভাঙা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অন্তঃসত্ত্বা মা পথেই মারা যান। অবশ্য অন্য রোগীর ক্ষেত্রেও অবস্থা সেরকমই। সেখানে করোনাকালে কী অবস্থা হতে পারে তা বুঝে নেন। তিনি বললেন, দেশের চারদিকে এখন করোনা ছড়িয়ে গেছে। ফলে গ্রামগঞ্জে গর্ভবতী নারী করোনার হাত থেকে বিপৎমুক্ততো নয়ই, বরং আরও ঝুঁকির মধ্যে আছেন।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রচার করতে হবে গর্ভবতী নারী ভ্যাকসিন নিলে সম্ভাব্য ঝুঁকির তুলনায় উপকার বেশি। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাও অন্য নারীদের চাইতে গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে বেশি। এই তথ্যগুলো অনেক বেশি করে প্রচার করতে হবে তৃণমূল পর্যায়ে। কারণ গর্ভবতী নারী অনেকেই টিকা নিতে ভয় পাচ্ছেন। অনেক প্রচারণা চালিয়ে সবাইকে বুঝাতে হবে ভ্যাকসিন নিলে তাদের অথবা তাদের অনাগত সন্তানের কোনো ধরনের ক্ষতি হবে না, বরং সন্তানের নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব হবে। সেইকারণেই সরকারকে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

এ বিভাগের আরো খবর