বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বদলে যাওয়া বাংলাদেশের গল্প

  • মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল   
  • ৭ আগস্ট, ২০২১ ১০:৩৬

পররাষ্টমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গা-সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রেসক্রিপশনের বিষয়টিও উঠে এল। মন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন আমাদের সরকার বিশ্বব্যাংককে তাদের এ ধরনের প্রস্তাবে আপত্তির বিষয়টি। এখন লাইনে পড়েছে বিশ্বসংস্থাটি। আমাদের সরকারের পছন্দ অনুযায়ী এখন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে বিশ্বব্যাংক, সরে এসেছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ক্রমশ একীভূত করার দীর্ঘমেয়াদি প্রেসক্রিপশন থেকে।

পঞ্চাশ বছরের জীবনে জীবনের খোলনলচে বদলে যাওয়ার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ কম মানুষেরই আসে। আমার তেমনটা হয়েছে একবার নয়, দুবার নয়, তিন-তিনবার। ’৭১-এ বুঝিনি সংগত কারণেই, তবে বোঝার চেষ্টাটা চালিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয়বারের অভিজ্ঞতাটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে। বিশ্বব্যাংকের ডিকটেশনে চলা বাংলাদেশকে বিশ্ব ব্যাংককে ডিকটেট করা বাংলাদেশের রূপান্তরের মূল কারিগর তিনি। আর তৃতীয়বার অবশ্য সার্স-কোভ-২ নামক এক অদৃশ্য ভাইরাসের কারণে।

দুই.

বিভিন্ন মন্ত্রীদের প্রেস ব্রিফিংগুলো ইদানিং ডিজিটালাইজেশনের কল্যাণে নিয়মিতই লাইভ স্ট্রিমিং হয়। সেদিনও হচ্ছিল। জাতীয় অতিথি ভবনে সংবাদমাধ্যমকর্মীদের নানা বিষয়ে ব্রিফ করছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তার বড় ভাই সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের অসুস্থতা থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি, রোহিঙ্গা, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি নানা বিষয় উঠে আসছিল মন্ত্রীর ব্রিফিংয়ে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি নতুন এক প্রেসক্রিপশন দিয়েছে। আমাদের জন্য ‘গোদের উপর বিষ ফোড়া’ দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাদের নাকি আমাদের ‘জাতীয়করণ’ করতে হবে। তাদের ধীরে ধীরে আমাদের মূল জনস্রোতে সম্পৃক্ত করে নেয়ার পরাশর্ম দিচ্ছে বিশ্বসংস্থাটি। এজন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তার মুলাও ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে যথারীতি তাদের এই প্রেসক্রিপশনে। বিশ্বব্যাংকের এমন অভিনব তবে প্রত্যাশিত সমাধানে যারপরনাই পুলকিত এদেশের কিছু সুশীল নাগরিক। এরই মধ্যে যথারীতি এই প্রস্তাবের পক্ষে ঢাকঢোল নিয়ে বাদ্য বাজাতে কাছা বেঁধে পথেও নেমে পড়েছেন তাদের অনেকেই।

তিন.

আমার প্রয়াত পিতা প্রকৌশলী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। জেনারেল এরশাদের মার্শাল ল’র সময় একজন ক্ষমতাধর জেনারেলের অন্যায় আবদারে সম্মত না হওয়ায় তাকে এমএলও নাইন নামের এক অদ্ভুত আইনে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ‘আজব রাজার ধন্যি দেশে’ সে সময়ে মহারাজ চাইলেই যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকে কোনো কারণ না দর্শিয়েই সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারতেন।

পরবর্তী সময়ে আমার বাবা সুপ্রিমকোর্টে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে মামলায় জিতে চাকরি ফিরে পান। কিন্তু ততদিনে দেশে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব জেনারেল এরশাদ-পরবর্তী রাজন্যবর্গের নির্দেশে তাকে পদায়ন করা হয়েছিল বগুড়ায় বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট একটি রুগ্ণ মহাসড়ক প্রকল্পে সময় কাটানোর জন্য। ফলাফলটা অবশ্য একটু অপ্রত্যাশিতই হয়েছিল এবং যমুনার ওপার থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের যে সে সময়কার আধুনিক মহাসড়ক তার পুরো কর্মযজ্ঞে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমার প্রয়াত পিতা।

এটা সেই জমানার বাংলাদেশের কথা যখন পুরো জাতি দেশের বার্ষিক বাজেটের জন্য তাকিয়ে থাকত ‘প্যারিস কনসোর্টিয়াম’ বৈঠকের দিকে, যেখানে দাতারা প্রতিবছর মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত দিতেন তারা পরবর্তী অর্থবছরে বাংলাদেশকে কী পরিমাণ খয়রাতি সাহায্য প্রদান করবে। এটা বাংলাদেশের সেই জমানার কথা যখন ইংল্যান্ড থেকে উচ্চশিক্ষিত আমাদের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান আমাদের এলডিসিতে থাকার পক্ষে ওকালতি করতেন যাতে আামদের খয়রাত পাওয়ায় সুবিধা হয়।

চার.

সেই জমানায় একদিন আমার বাবাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল কৈফিয়ত তলব করার জন্য। তার অপরাধ ছিল মারাত্মক! প্রজেক্টের একজন মার্কিন কনসালটেন্ট আমার বাবার ওপর কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে খবরদারি করছিল। প্রজেক্ট ডাইরেক্টর হিসেবে সাদা চামড়ার এই ঔদ্ধত্যে আপত্তি খয়রাতি সরকারের সড়ক কর্মকর্তা আমার প্রয়াত পিতার। তিনি শুধু এই মার্কিন কনসালটেন্টকে তার অফিস থেকেই বের করে দেননি, ওই ভদ্রলোকের নিয়োগকর্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা কনসালটিং ফার্ম লুইস বার্জারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে বাংলাদেশ থেকেও প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরেই রাজদরবারে ডাক পড়েছিল আমার বাবার। এমন ‘দেশবিরোধী, আত্মঘাতী’ কাজ ভবিষ্যতে পুনরায় করলে অতীতের পরিণতি বরণ করার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছিল তাকে।

পাঁচ.

পররাষ্টমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গা-সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রেসক্রিপশনের বিষয়টিও উঠে এল। মন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন আমাদের সরকার বিশ্বব্যাংককে তাদের এ ধরনের প্রস্তাবে আপত্তির বিষয়টি। এখন লাইনে পড়েছে বিশ্বসংস্থাটি। আমাদের সরকারের পছন্দ অনুযায়ী এখন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে বিশ্বব্যাংক, সরে এসেছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ক্রমশ একীভূত করার দীর্ঘমেয়াদি প্রেসক্রিপশন থেকে। দাতাদের তথাকথিত আর্থিক সহায়তার বিষয়েও মুখ খুলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জানিয়েছেন ‘লাভের গুড় খাচ্ছে পিঁপড়াতেই’। রোহিঙ্গাদের জন্য দেয়া দাতা দেশগুলোর যাবতীয় অর্থ সাহায্য ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে তাদের নিজস্ব সংস্থাগুলোর মধ্যেই। এই পয়সার চেহারা না দেখছে বাংলাদেশ সরকার, না এতে এতটুকুও লাভ হচ্ছে বাংলাদেশের বা বাংলাদেশের মানুষের। একই প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আমাদের দেশের সেসব তথাকথিত ভদ্রলোকগুলোর মুখোশও উন্মোচন করেছেন, যারা অল্প কিছু পেলেই সস্তায় বিক্রি করে দেয় দেশের স্বার্থকে।

ছয়.

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আমার পৈতৃক ভিটা একই শহরে এবং যোগাযোগটাও অনেক বেশি পারিবারিক। বয়সে তিনি আমার প্রয়াত বাবার বছরখানেকের ছোট হলেও তাদের মধ্যে ছিল চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ছিলেন এক অপরের ‘পেনফ্রেন্ড’ও। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের দুই জমানার এই দুই তুলনামূলক ছবি তুলে ধরতে যেয়ে তাই এই দুই বন্ধুর প্রসঙ্গ টেনে আনলাম। সেদিন তার ঔদ্ধত্যের জন্য আমার প্রয়াত বাবার ডাক পড়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সে সময়কার মুখ্যসচিব তাকে সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু আমি জানি আজ পররাষ্টমন্ত্রীর এ কারণে কোনো জায়গা থেকে ডাক পড়বে না। আর এটাই আজকের বদলে যাওয়া বাংলাদেশের গল্প।

লেখক: অধ্যাপক-চিকিৎসক। বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য সচিব: সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এ বিভাগের আরো খবর