নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত শত নদীর প্রায় সবই কোনো না কোনোভাবে ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ওপর নির্ভরশীল। ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের নির্ভর করতে হয় উজান দেশের ওপর। কারণ এসব আন্তঃসীমান্ত নদীর উৎস বাংলাদেশের বাইরে। সেখানে যেকোনো ধরনের স্থাপনা প্রকল্প কিংবা ইন্টারভেনশন আমাদের দেশের নদীগুলোর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ভাটির দেশ হিসেবে যে কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব সময় নদীভিত্তিক সহযোগিতার কথা বলে আসছে। নদী বা পানিবিষয়ক চুক্তি, কনভেনশন কিংবা প্রটোকল রয়েছে। বাংলাদেশ সব সময় দেশগুলোর আন্তঃপানি চুক্তি কার্যকর বাস্তবায়নের পক্ষে। আমরা চাই এ অঞ্চলে পানিভিত্তিক বৃহত্তর সহযোগিতার ক্ষেত্র গড়ে উঠুক। বাংলাদেশের উচিত পানিভিত্তিক কার্যকর সহযোগিতা গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক এই আবহ কাজে লাগানো। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। কারণ টেকসই উন্নয়নে নদীগুলোর ভূমিকা অনেক।
পানিভিত্তিক সহযোগিতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দুই দেশের সদিচ্ছা রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত পানিবণ্টন নিয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পেরেছি আমরা। তিস্তার পানিবণ্টনে কিন্তু কোনো চুক্তিতে উপনীত হতে পারছি না। এভাবে ৫৪টি নদী নিয়ে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠতে হলে বহু বছর লেগে যাবে। মনে রাখা দরকার নদী মানে কিন্তু পানি নয়। এর প্রতিবেশ জীববৈচিত্র্য নিয়ে ভাবতে হবে। নদীর প্রতিবেশ ও প্রবহমানতা অক্ষুণ্ন রাখতে হলে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রবাহ রাখতে হবে। আর নদীর নানা ধরনের ব্যবহার রয়েছে। নৌ-চলাচল, সেচ, সুপেয় পানির আধার প্রভৃতি কারণে নদী গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। যাতে নদীর সুফল নদীকূলবর্তী দেশের সব মানুষই পায়। তাহলে পানিবণ্টন নিয়ে জটিলতা অনেকাংশে এড়ানো যাবে।
আধুনিক সভ্যতাসমূহ নদীর ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল। এ কারণে নদীগুলোর ব্যবহার এখন বহুমাতৃক। মানুষ বুঝে না বুঝে নদীকে ব্যবহার করছে। নদীর ধারে গড়ে ওঠেছে বড় বড় কলকারখানা, নদীতে এখন হাজার হাজার লঞ্চ-স্টিমার। নদীতে শত শত বাঁধ। যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেভাবে নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। উজানের দেশ পানি প্রত্যাহার করছে। স্রোতহীন নদী ভরাট করে দখল করার মহোৎসবে মেতে ওঠেছে ভূমিদস্যুরা। এই সব বহুমাত্রিক ব্যবহার কখনও নদীর জীবনের জন্য হয়ে ওঠছে বিপজ্জনক। নদীদূষণ আর নদী ভরাট বাংলাদেশের অনেক নদীকে মেরে ফেলেছে ধীরে ধীরে।
সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেও নানাবিধ কারণে সেসব নদীকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। এটা কেবল সরকারের একার পক্ষে করাটা সম্ভব নয়। এ জন্য সবাইকে বুঝতে হবে, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার প্রচেষ্টায় নদীকে বাঁচাতে হবে। সেজন্য প্রথমে দরকার একটি সম্মিলিত বোধ।
নদী দখল এক মহামারি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। যে যেভাবে পারছে নদী ও জলাশয়কে দখল করে চলেছে। দেশের প্রচলিত আইন-কানুন, ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়সহ দুই যুগের নদী আন্দোলন কিছুটা হলেও কাজে আসছে। তা সত্ত্বেও নদী দখল অব্যাহত আছে বরং ঢাকার চারপাশের নদীসমূহ বিশেষ করে তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, টঙ্গী খাল, ধলেশ্বরী নদীর জায়গা বেদখল হচ্ছে। সত্তরের দশকে অর্থাৎ স্বাধীনতার সময় চব্বিশ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল, যা বর্তমানে ৩৮০০ কিলোমিটারে নেমে এসেছিল। বাকি ২০ হাজার কি. মি. নৌপথ সব ভূমিখেকোরা দখল করে ফেলে।
দেশে নদী দখলের জন্য অসাধু ব্যবসায়ী, দূর্নীতিপরায়ণ আমলা এবং লোভী রাজনীতিকদের সিন্ডিকেট শক্তিশালী রূপে দেখা গেছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় অনেক দখল করা নদী পুনরুদ্ধার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে। ভূমিদস্যুরা নদী দখলের কৌশল হিসেবে প্রথমে বাঁশের বেড়া বা বেষ্টনী দেয়। তারপর কঠিন ও তরল বর্জ্য ফেলে। এমনকি সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী ট্রাক চুক্তি করা হয় ভরাট কাজের জন্য। তারপর কাঁচাবাড়ি, টিনের ঘর এবং সর্বশেষ অট্টালিকা তৈরি করা হয়। যারা বেপরোয়া তারা একসঙ্গেই বালি দিয়ে ভরাট করে অট্টালিকা তৈরি করে। অনেক ব্যবসায়ী ভূমি উন্নত করে প্লটের বাণিজ্য করে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন নামের সিটি। এই অবৈধ স্থাপনা রক্ষার জন্য মসজিদ-মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ক্লাব নির্মাণ করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে সরকারি স্থাপনাও গড়তে দেখা যায়।
নদীর সংস্কার ও পরিচর্যার গুরুত্ব বিবেচনা করে গত নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় বছরব্যাপী নদী খননের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক সভাপতি শেখ হাসিনা। নদীর পানিপ্রবাহ ঠিক রাখা এবং ভাঙন প্রতিরোধে বড় নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পুরো বছরের পরিকল্পনা থাকতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। নদীপ্রবাহ ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
নদীর পানি যখন কমে যায় তখন চর পড়ে বা অন্যান্য কারণে পানি বেড়ে গেলে ভাঙন শুরু হয়। তাই নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে বড় নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পুরো বছরের পরিকল্পনার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে প্রকল্পভিত্তিক নদী ড্রেজিং কার্যক্রম চলছে। সেটি থেকে বের হয়ে এসে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে যেতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারিত হওয়ার ফলে নদীর প্রবাহ তীরে আঘাত করে নদীভাঙন পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। যে রকম অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, তাতে কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বড় অংশই তলিয়ে যেতে পারে।
অপরদিকে বর্ষায় বন্যা এবং শীতকালে নদীগুলোতে পানি না থাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া ক্রমেই বাড়ছে। তাই অস্তিত্বের প্রয়োজনেই নদীগুলোকে ড্রেজিং করতে হবে।
প্রতিটি জেলায় নদী রক্ষা কমিটি নামে একটি কমিটি রয়েছে যার সভাপতি হলেন জেলা প্রশাসক। নদী ভরাট ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে কাজ করা, নদী খননের প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন ও নদী রক্ষায় নানা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজ করে এই কমিটি। কিন্তু শুধু জেলা প্রশাসন অথবা পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী বাঁচাতে পারবে না। এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
সর্বোপরি সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি যেমন ত্বরান্বিত করতে হবে। তেমনি এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। বিভিন্ন কলকারখানার মালিক-শ্রমিকদের সমিতির সঙ্গে নিয়মিত এ ব্যাপারে বৈঠক করতে হবে। চামড়া বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে এই আন্দোলনের কমিটি স্থাপন করে দিয়ে আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা যেতে পারে।
যাদের কারণে নদী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের তালিকা তৈরি করে আরোপ করা যেতে পারে নানা রকম দণ্ড। প্রয়োজনে নদী রক্ষার দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দিতে হবে প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, বিজিবিকে। তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। নদীর জমি সিএস ম্যাপ অনুযায়ী খাস জমি হিসেবে বহাল রাখতে হবে। নদীদূষণ রক্ষার্থে বেশি সংখ্যক শিল্প বর্জ্য শোধনাগার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাগার তৈরি করতে হবে। নদী দখল রোধ করতে ভূমি দপ্তরের কর্মকর্তাদের হতে হবে আরও সচেতন। নদীর জমি ভরাট করে ব্যক্তিগত মালিকানায় স্থানান্তরের কোনো সুযোগ নেই।
আমাদের নদীর চরিত্রগুলো বুঝতে হবে। সব নদীর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কিন্তু আবার এক রকম নয়। কোনো নদী বেশি পলি ধারণ করে, আবার কোনোটা কম। কোনোটা আবার বেশি খরস্রোতা, কেউ আবার সারা বছরই সমান তালে চলে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলি ধারণ করে পদ্মা, যমুনা ও তিস্তা। এককথায় বলতে দেশের বড় নদীগুলো সবারই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো পলি ধারণ করা। তাই নদীর বৈশিষ্ট্যকে সমুন্নত রেখে তাকে ব্যবহারোপযোগী করতে হবে। এ জন্য নদীশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল পরিমাণ পলি ধারণ করার কারণে তার পাড় ভাঙে। তাই আমাদের নদীশাসনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত নদীর পাড় সংরক্ষণ করা। পাড় বাঁধা। সেই পাড় বাঁধাটাও আবার এর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী করতে হবে। যে দিকটা বেশি ভাঙছে সে দিকটাকে বেশি শক্ত, মজবুত করতে হবে। আমাদের নদীগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একে শাসন করার জন্য নদীর পাড় বাঁধতে হবে।
জীবন যদি বাঁচাতে হয়, পরিবেশ যদি রক্ষা করতে হয়, উর্বরতা যদি রক্ষা করতে হয়, যদি উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে হয়, বর্ধনশীল উষ্ণতাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়; তাহলে নদী সংরক্ষণের বিকল্প নেই। আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণ, মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হতে চাই; অথচ নদীগুলোকে হত্যা করব- এই বিপরীতমুখী কর্মপ্রবণতা আমাদের দেশটাকে ভাগাড়ে পরিণত করবে। তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা শতভাগ থাকতে হবে।
নদী উন্নয়নই সব উন্নয়নের বিশেষ করে টেকসই পরিবেশ উন্নয়নের চাবিকাঠি। নদী সংরক্ষণই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া জরুরি। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অবিলম্বে খুব কম খরচে নদীশাসন, নদীভাঙন প্রতিরোধ এবং নিরাপদভাবে সারা বছর নৌ চলাচলের সুবিধার্থে নৌপরিবহন, পানিসম্পদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বুয়েট, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিআইডব্লিউটিএর নৌপথ সংরক্ষণ-পরিচালন বিভাগের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে যৌথসভা করে স্বল্পব্যয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বান্ডালিং ও ড্রেজিং কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নদীগুলো বাঁচবে এবং নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার ও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
লেখক: গবেষক- কলাম লেখক, সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি