বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মানুষের নামে পশুর নাম ও গণমাধ্যমের দায়

  •    
  • ৬ আগস্ট, ২০২১ ১২:৪০

যুক্তি যা-ই থাকুক না কেন, ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ বলা হয় যে মানুষকে, সেই মানুষের নামে কোনো পশুর নাম রাখা মানুষের জন্য সম্মানজনক কি না—সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে গরুর নাম রাখা হলেও গণমাধ্যম সেই খবর কীভাবে পরিবেশন করবে; হিরো আলমের ওজন ৩১ মণ; বিক্রি হয়নি শাকিব খান ও ডিপজল—এ জাতীয় সংবাদ শিরোনাম করবে কি না; এখানে গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি কী হওয়া উচিত—সেটিও বিবেচনা করা দরকার।

কোরবানির ঈদের দুদিন পরে দেশের একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম: ‘টাঙ্গাইলের শাকিব খান, ডিপজল ও মানিক বিক্রি হয়নি।’

পাঠক জানেন, শাকিব খান ও ডিপজল বাংলাদেশের দুজন পরিচিত চলচ্চিত্র তারকা। আর বাংলাদেশের মানুষের নাম হিসেবে মানিকও খুব কমন। কিন্তু এখানে শাকিব খান, ডিপজল ও মানিক কোনো মানুষের নাম নয়, বরং গরুর নাম। যাদেরকে কোরবানির হাটে আনা হয়েছিল, কিন্তু বিক্রি হয়নি।

মানুষের, বিশেষ করে তারকা বা আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিদের নামে কোরবানির পশুর নাম রাখা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর কোরবানির হাটেই এরকম মানুষের নামওয়ালা গরু দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঠিক কী কারণে মানুষের নামে পশুর নাম রাখা হয়? একজন সাধারণ মানুষ রসিকতা করে কিংবা হয়তো ভালোবেসেই তার প্রিয় গরুটির নাম তার প্রিয় কোনো মানুষ বা তারকার নামে রাখলেও মূলধারার গণমাধ্যম কি সেভাবেই পশুগুলোকে দর্শক-পাঠকের সামনে হাজির করবে? এখানে গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি ও নীতি-নৈতিকতা কোথায়? সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এ বছর কোরবানির হাটে আসা মানুষের নামওয়ালা গরুদের নিয়ে আরও কিছু সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক।

১. হিরো আলমের ওজন ৩১ মণ

২. গরুর নাম ‘রাজবাড়ীর রাজা-১’, দাম ২৫ লাখ

৩. গরুর নাম ‘হামাস’ রাখল কিশোরী

৪. জনসিনার দাম উঠেছিলো ১০ লাখ, বিক্রি ৫ লাখে

৫. শেরখান ও বাহাদুরকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় খামারি।

ইন্টারনেটে সার্চ দিলে এরকম আরও অনেক সংবাদ শিরোনাম পাওয়া যাবে। দেখা যাচ্ছে, হালের বিতর্কিত ব্যক্তি, যাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সব সময়ই রসিকতা চলে, সেই হিরো আলমের নামেও এবার কোরবানির পশুর হাটে গরু উঠেছে। খবরে বলা হয়, ৩১ মণ ওজনের সেই গরুটি লোকসানে বিক্রি করেছেন বিক্রেতা। ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়টি ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর গাবতলীর হাটে নিয়ে আসেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বটতলা গ্রামের কামরুজ্জামান ও তার স্ত্রী জয়নব বেগম। হাটে এর দাম হাঁকানো হয় ১২ লাখ টাকা। কিন্তু বিশালাকার ষাঁড়টির কাঙ্ক্ষিত দাম বলছিলেন না কেউ। অবশেষে ঈদের আগের দিন রাতে ৪ লাখ টাকায় ষাঁড়টিকে বিক্রি করে দেন কামরুজ্জামান। তিনি দুই লাখ ৭৬ হাজার টাকায় গরুটি কিনেছিলেন।

টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার মিরিকপুর গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা জোবায়ের ইসলামের শাকিব খান ও ডিপজল বিক্রিই হয়নি। কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ায় তিনি এগুলো বিক্রি করেননি। সাদা রঙের ষাঁড়টিকে তিনি আদর করে নাম দেন ‘শাকিব খান’। আর কালো রঙের ষাঁড়টির নাম রাখা হয় ‘ডিপজল’। দেখা যাচ্ছে, গরুর নাম রাখার ক্ষেত্রেও মানুষের মনের ভেতরে যে ‘নিষ্পাপ’ বর্ণবাদ লুকিয়ে আছে, তারই বহিঃপ্রকাশ। সাদা গরুটির নাম রাখা হয় সুন্দর চেহারার নায়ক শাকিব খানের নামে, আর কালো গরুটির নাম রাখা হয় সিনেমায় মূলত ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করা ডিপজলের নামে।

অপরদিকে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের ভেঙ্গুলিয়া গ্রামের কলেজছাত্রী হামিদা আক্তার তার ৩৮ মণ ওজনের একটি গরুর নাম রেখেছিলেন মানিক। দাম চেয়েছিলেন ১৪ লাখ টাকা। ঈদের আগে এ দুটিকে ঢাকার গাবতলী পশুর হাটে নিয়ে যান। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় মানিককে বিক্রি করেননি। খবরে বলা হচ্ছে, হামিদা আক্তার আদর করেই গরুর নাম রেখেছিলেন মানিক।

একই সময়ে আরেকটি সংবাদপত্রের শিরোনাম: জনসিনার দাম উঠেছিল ১০ লাখ, বিক্রি ৫ লাখে। অর্থাৎ জনসিনাও একটি গরুর নাম, যাকে রাজধানীর গাবতলীর হাটে এনেছিলেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার মো. বোরহান। প্রসঙ্গত, জন ফিলিক্স অ্যান্থনিও সিনা একজন মার্কিন পেশাদার কুস্তিগীর, র‍্যাপার ও অভিনেতা। তিনি ডাব্লিউ ডাব্লিউ ই-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। তিনি ১৬ বারের ডাব্লিউ ডাব্লিউই চ্যাম্পিয়ন, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বার। এখন প্রশ্ন হলো, বিক্রেতা তার গরুর নাম জনসিনা কেন রাখলেন? একজন গরু-বিক্রেতার কি মার্কিন কুস্তিগীর জন ফিলিক্স অ্যান্থনিও সিনার নাম জানার কথা?

এবার কোরবানির হাটে মানুষের নামওয়ালা আরও যেসব গরুর সংবাদ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়, এর মধ্যে ছিল ‘রাজবাড়ীর রাজা’। ষাঁড়টিকে গোসল করানো হচ্ছে— এমন সংবাদও পত্রিকায় ছাপা হয়। এই ষাঁড়টির মালিক পেশায় স্বাস্থ্যকর্মী। তিনি সরাসরি কোনো মানুষের নামে না রেখে তার গরুটির নাম রেখেছেন ‘রাজবাড়ীর রাজা’। মূলত ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণই ছিলো তার মূল উদ্দেশ্য—যাতে করে অন্য ষাঁড়গুলোর চেয়ে এটিকে আলাদা করা যায়।

মানুষের নাম ছাপিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনকারী সংগঠন হামাসের নামওয়ালা একটি গরু। গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামের একটি খামারে বড় হয় বিশাল আকারের এই গরুটি। গরুর নাম হামাস রাখার কারণ জানতে চাইলে জাহিদের বোনের মেয়ে তাসমিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘টিভিতে দেখেছি, খবরে শুনেছি, দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের জয় এনে দিয়েছে হামাস সংগঠন। ইসরাইল যেমন মুসলিম সংগঠন হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে জয় লাভ করতে পারেনি, তেমনি আমাদের এই গরুর সঙ্গেও আর কোনো গরু প্রতিযোগিতায় পারবে না। তাই এই নাম রেখেছি।’ এ বিষয়ে জাহিদ হাসান বলেছেন, গরুর নাম দেয়া এখন একটা ট্রেন্ডে পরিণত। কিন্তু দেখা গেছে, একই নামের অনেক গরু। যেমন আমার উপজেলাতেই বাহাদুর নামে পাঁচটি গরু এবারের হাটে উঠবে। তাই ভাগনির দেয়া হামাস নামটি আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। এই নামে গোটা বাংলাদেশে আর কোনো গরু নেই।

বিক্রেতা এবং তার আত্মীয়ার এই যুক্তি বেশ মজার। সবাই যেখানে মানুষের নামে গরুর নাম রাখেন, সেখানে তারা হামাসের মতো একটি সংগঠনের নামে নিজেদের প্রিয় পশুর নাম রাখলেন।

শুধু এ বছরই নয়, এর আগেও কোরবানির হাটে সুলতান, নবাব, কালা তুফান ইত্যাদি নামে গরু উঠেছে। নিহত আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন, লিবিয়ার নিহত প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, ইরাকের নিহত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনর নামেও বাংলাদেশের বাজারে গরু উঠেছে। বাদ যাননি রেসলিং তারকা রক ও আন্ডারটেকারও। রক ও আন্ডারটেকার নামওয়ালা গরু দুটির মালিকের যুক্তিও দারুণ। বলেছেন, গরু দুটি দেখতে এবং শক্তিতে রেসলিং তারকার মতো। তাই এই নাম। মানুষের নামে পশুর নাম রাখা হলে যে সেটি মানুষকে অসম্মানিত করা হয়, এই ভাবনাটি তার মাথায় নেই।

মানুষের নামে গরুর নাম রাখার এই প্রবণতা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং বিদেশেও আছে। কিম কার্দাশিয়ান নামে একজন মডেল-অভিনেত্রী ও রিয়েলিটি তারকার নামে একটি গরুর নাম রেখেছে পিপল ফর দি এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অফ অ্যানিম্যালস (PETA) সংস্থা। এমন একজন তারকার নামে গরুর নামকরণের ব্যাখ্যায় সংস্থাটি বলেছে, দুধবর্জিত প্ল্যান্ট বেসড ডায়েট নিয়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্যই কিম কার্দাশিয়ানকে PETA ধন্যবাদ জানিয়েছে। তার এই উদ্যোগকে সম্মান জানাতেই তারা গরুর নাম রেখেছেন তারকার সঙ্গে নাম মিলিয়ে।

কোরবানির হাটে আসা গরু বা ষাঁড়দের ক্ষেত্রে মানুষের নাম লক্ষ করা যায় তুলনামূলকভাবে বড় গরুদের। যাতে করে ক্রেতারা নাম দেখেই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু যখন শাকিব খান বা ডিপজল অথবা হিরো আলমের নামে কোনো গরুর নাম রাখা হয় এবং সেটি সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়, তখন তারা বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন? শাকিব খান, হিরো আলম বা ডিপজলকে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, তাদের নামে কোরবানির পশুর নাম রাখার বিষয়টিকে তারা কীভাবে দেখছেন? তারা নিজেদের নামে গরুর নাম রাখার বিষয়টিকে যে খারাপভাবে নেননি, সেটি বোঝা যায় এ বিষয়ে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকায়। তারা বিষয়টিকে নেতিবাচকভাব দেখলে নিশ্চয়ই এর প্রতিবাদ করতেন। অন্তত মানহানির অভিযোগে সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠাতেন। তা যেহেতু করেননি, ফলে এটি ধরে নেয়াই সংগত যে, তারাও হয়তো বিষয়টা এনজয় করছেন অথবা বিষয়টিকে হয়তো পাত্তা দিচ্ছেন না।

যেসব কারণে কোরবানির হাটে আসা বিশেষ কিছু গরুর নাম মানুষের নামে রাখা হয়, তার মূল কারণ ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ এটি যেমন ঠিক, তেমনি যখন কোনো খামারে অনেক গরুর ভেতরে দুয়েকটি খুব ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের হয়ে ওঠে, বা তুলনামূলকভাবে বড় ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, তখনও অনেক সময় খামারের মালিক আদর করে বা অন্য গরুদের সঙ্গে আলাদা করার জন্য তাদের নাম দেন। সেই নাম দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই তার মাথায় আসে তারকাদের কথা। কখনও তার প্রিয় তারকার নাম, আবার কখনও বিতর্কিত বা সমালোচিত কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত কারো নাম। অনেক সময় খামার মালিকের পরিচিত অন্য কেউও হয়তো রসিকতা করে কোনো একটি গরুর নাম বলেন; দেখা যায় সেই নাম বলতে বলতে গরুটি সেই নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে।

কিন্তু যুক্তি যা-ই থাকুক না কেন, ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ বলা হয় যে মানুষকে, সেই মানুষের নামে কোনো পশুর নাম রাখা মানুষের জন্য সম্মানজনক কি না—সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে গরুর নাম রাখা হলেও গণমাধ্যম সেই খবর কীভাবে পরিবেশন করবে; হিরো আলমের ওজন ৩১ মণ; বিক্রি হয়নি শাকিব খান ও ডিপজল—এ জাতীয় সংবাদ শিরোনাম করবে কি না; এখানে গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি কী হওয়া উচিত—সেটিও বিবেচনা করা দরকার। কারণ মানুষের নামে গরুর নাম রাখার এই বিষয়টিকে গণমাধ্যম যদি অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যায়, তাহলে একসময় হয়তো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি বা সিুশীল সমাজের কারো নামেও গরুর নাম রাখা শুরু হবে—যে খবর প্রকাশ করতে গিয়ে গণমাধ্যম বিব্রত হবে।

লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর