“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু,/ বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ,/ তবু অনন্ত জাগে।” বেঁচে থাকার আনন্দময় উপলব্ধির মাঝেও মৃত্যুকে স্মরণ করেছেন। জীবনের জয়গানের মাঝেই মৃত্যুচিন্তায় নান্দনিকতার সফল উপস্থিতির বয়ান করেছেন...“মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান।”গত দেড় শতক ধরে বাঙালির মানসপটে দিকনির্দেশক এই আলোকবর্তিকার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রোজকার বাঙালি জীবনে সবকিছুর সঙ্গে বিপুলভাবেই মিশে আছেন তিনি। বর্ষা তার প্রিয় ঋতু। অযুত রচনায় বাংলার বর্ষাকে তিনি অনিন্দ্য সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। শ্রাবণের ধারার মতো জলধারায় পরিপুষ্ট তার বিচিত্র রচনাসম্ভার। তাই তো বর্ষাকে সঙ্গে করেই ইতি টেনেছেন বাহ্যিক জীবনের। তবুও নশ্বর এ পৃথিবীতে আজও তিনি অবিনশ্বর।সৃজনের নন্দন কাননকে রাঙা আলোয় আলোকিত করেছেন আপন সৃষ্টি দিয়ে। তার সৃষ্টিকর্মের পরতে পরতে যেমন উৎসারিত হয়েছে যাপিত জীবনের সুখ দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না; তেমনি প্রকৃতির সঙ্গে মানব হৃদয়েরও এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। আমরা প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পাই ভালোবাসা ও প্রেমের এক অবিমিশ্র উপাদান । কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রকর্ম, সংগীত... প্রতিটি বিষয় দিয়েই তিনি সুনিপুণভাবে জীবনের মালা গেঁথেছেন, মানব হৃদয়কে ভালোবাসায় আর্দ্র করেছেন । এমন সৃষ্টিশীল মানুষ আর দেখেনি বাংলা সাহিত্য। বাঙালির হৃদয়ানুভূতি ও অভিব্যক্তির সার্থক প্রকাশ ঘটেছে তার বিপুল রচনায়। তার বৈচিত্র্যময় রচনাসম্ভার মহৎ মানবিক আবেদনের মহিমায় হয়ে উঠেছে কালজয়ী।সামাজিক অচলায়তন ভাঙার কারিগররূপে সাহিত্যপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালির অন্তরাত্মায় বেঁচে থাকবেন কাল থেকে কালান্তরে । তার দর্শন আর জীবনবোধের উপলব্ধি বাঙালির রোজকার জীবনে অহর্নিশ জোগায় সীমাহীন প্রেরণা।জীবনে আনন্দিতভাবে বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ খুঁজে পাই তার সৃষ্টিকর্মের মাঝে, জীবনকে মনে হয় বর্ণিল, সুমধুর, স্বপ্নময়। প্রেম, প্রকৃতি ও জীবনবোধকে তিনি রোমান্টিক আধুনিকতার পরশে বর্ণময় করেছেন; ভরিয়ে দিয়েছেন বহুমাত্রিকতায়। সুখ-দুঃখের প্রতিটি সময়ে তার গান প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে নিজের অন্তরকে, ব্যথিত করে, আলোকিত করে, স্বস্তি দেয়, শান্তি দেয়। কখনো আনন্দাশ্রু বয়ে যায় দুচোখ বেয়ে, কখনওবা দুঃখের জল। আমাদের আটপৌরে জীবন যাপনে চেতন-অবচেতনে তার উপস্থিতি প্রবলভাবে দৃশ্যমান। তার সাহিত্যকর্ম, সংগীত, জীবনদর্শন, মানবতা— সবকিছুই সত্যিকারের বাঙালি হতে অনুপ্রেরণা জোগায়। তিনি জেগে আছেন নিশিদিনে, মন ও মননে, হৃদয়েরও গহীনে।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্যবাদের মধ্যেও তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্ব দরবারে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা এখনও পর্যন্ত সাহিত্যে কোনো বাঙালির প্রথম অর্জন। আবার দেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ থেকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দমননীতির পৈশাচিক বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদস্বরূপ ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া নাইটহুড উপাধি বর্জন করেন।রবীন্দ্রচর্চাই পারে মানুষে মানুষে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি বন্ধ করে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে। তিনি চলে গেছেন কিন্তু উজার করে দিয়ে গেছেন তার সৃষ্টির সবকিছু। সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। তার দর্শন চেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে।বর্তমানে মহামারির প্রেক্ষাপটেও কবিগুরু সামনে এসে দাঁড়ালেন। কবিগুরুর কালেও মহামারি হানা দিয়েছিল। এখনকার মতো তিনিও মহামারির ভয়ংকর রূপ দেখেছিলেন। আজ যখন গোটা বিশ্ব ভীতসন্ত্রস্ত, করোনা তাণ্ডবে দিক দিশাহীন, নিত্যদিনই বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা; সেই সময়ের ইতিহাসও আমাদের জানিয়ে দেয় মহামারির বীভৎসতার রূপ কতটা ভয়ংকর।আজকের এই শত নৈরাশ্যের যাপিত জীবনে একখণ্ড প্রত্যয় আর প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে তিনি আমাদের হৃদয়ে সাহস জোগান। বাঙালির মন-মানসে তার উপস্থিতি প্রতিনিয়তই দীপ্তিমান ও অনিবার্য হয়ে উঠছে। মহাকাশের বিশাল এই নক্ষত্রের এক বিন্দুও যদি ধারণ করা যায়, তাহলে জীবনের বোধ বদলে যাবে। তার সৃষ্টির বৈচিত্র্য আর প্রাচুর্যে বিমূর্ত হয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতির মূল পরিচয় আর শেকড়ের অস্তিত্ব। তাই এই বোধহীন সমাজকে বিবেকবান করতে হলে তার লেখাকে পৌঁছে দিতে হবে সর্ব সাধারণের কাছে।মৃত্যুর মাত্র এক মাস আগে শান্তিনিকেতন ছেড়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে ফিরে যান। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণের বেলা ১২ বেজে ১০ মিনিট। আজ থেকে ৮০ বছর আগে এই মর্ত্যলোক ছেড়ে চলে গেলেন অসীমের অমৃতলোকে। মানব মন কলুষমুক্ত করতে যে আলোকবর্তিকা তিনি জ্বালিয়েছেন, বাঙালি জাতিসত্ত্বা যতদিন থাকবে ততদিনই সে আলো ছড়িয়ে যাবে সবখানে। কীর্তিমান এ মানবের মহাপ্রয়াণ দিবসে সশ্রদ্ধ প্রণতি।
লেখক: প্রাবন্ধিক-শিক্ষক।