আফগানযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মার্কিন জেনারেল অস্টিন মিলার ১২ জুলাই দায়িত্বভার ত্যাগ করেছেন। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আফগান মিশনের যবনিকাপাত ঘটল। অপরদিকে, মার্কিন বাহিনীর বাগরাম ঘাঁটি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর পরই তালেবানরা আফগান সরকারি বাহিনী কিংবা অন্যান্য গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা কব্জা করতে শুরু করেছে। ফলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো জেলা তালেবানের কব্জায় চলে যাওয়ার খবর আসছে। দেশটিতে তালেবান তৎপরতা এতটাই বেড়েছে যে, ধারণা করা হচ্ছে, জঙ্গিগোষ্ঠীটি আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক অংশের দখল নিয়েছে। এরই মধ্যে ইরান-আফগান, আফগান-পাকিস্তান, আফগান-চীন সীমান্ত ক্রসিং ও বাণিজ্যিক রুটও তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে গোষ্ঠীটি। জাতিসংঘ বলছে, তারা যেসব জেলা দখল করেছে, সেগুলো দেশটির বিভিন্ন প্রাদেশিক রাজধানীর চারপাশে অবস্থিত। অর্থাৎ, আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হলেই প্রাদেশিক রাজধানীগুলো দখল করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে তালেবান।
অনেক ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রতিরোধের চেষ্টা ছাড়াই আফগান সেনাবাহিনী তালেবানের হাতে আত্মসমর্পণ করছে। তালেবানরা মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সেনাদের আক্রমণ না করলেও আফগান সরকারি বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যে পরিণত করেছে। অপরদিকে, প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির অনুগত সেনারা অনেক জায়গায় আত্মসমর্পণ করছে এবং অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাজিকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। এসব কারণে একদিকে যেমন গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে দেশটি, তেমনই আশপাশের বহু দেশে এর আঁচ লাগার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। হুমকিতে পড়েছে পুরো দক্ষিণ এশিয়া।
এরইমধ্যে কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আফগানিস্তানের চলমান সংঘাতে তালেবানকে সহযোগিতা করার অভিযোগ তুলেছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা অনুযায়ী, তালেবানের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য গত মাসেই পাকিস্তান এবং অন্যান্য জায়গা থেকে আফগানিস্তানে ১০ হাজারের বেশি মানুষ এসেছে। প্রেসিডেন্টের পর সম্প্রতি আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মুহিবও একই অভিযোগ এনেছেন। তিনি তালেবানকে আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা দেয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছেন। হামদুল্লাহ মুহিবের দাবি, ইসলামাবাদের প্রত্যক্ষ মদদে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান থেকে প্রায় ১৫ হাজার জঙ্গি আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছে এবং আরও ১০ হাজার সশস্ত্র জঙ্গিকে আফগানিস্তানে পাঠানোর তোড়জোড় চলছে বলে তারা খবর পেয়েছেন।
এসবের পাশাপাশি, আফগানিস্তানের বর্তমান অস্থিরতার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করছে আফগান সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের একাংশ৷ তাদের মতে, পাকিস্তানের প্রচ্ছন্ন তালেবান সমর্থন মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আবহে অস্থিরতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে৷ যদিও পাকিস্তানের ওপর করা এই অভিযোগ নতুন কিছু নয়৷ দেশটির সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে সবসময়। তাছাড়া আফগানিস্তানের তালেবান ও তাদের মিত্র হাক্কানি নেটওয়ার্ককে পাকিস্তানে ‘নিভৃত আবাস’ গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে ইসলামাবাদ।
আফগান রাজনীতিক আবদুল সাত্তার হুসেইনি সম্প্রতি একটি টিভি শোতে বলেছেন, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, আমরা পাকিস্তানের হাতে আক্রান্ত। আমরা শুধু তালেবানের বিরুদ্ধে লড়ছি না, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে এই মেকি যুদ্ধেও জড়িত৷ সাত্তার হুসেইনির মন্তব্যের কারণ হচ্ছে, পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও অস্ত্রের জোরেই তালেবানরা দ্রুত শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠেছিল এবং এখনও তালেবান জঙ্গিদের শক্তির প্রধান উৎস এই দেশটি।
সরকারি নীতি যা-ই হোক, তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র যোগাযোগ বরাবরই ছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলার পর আল-কায়দাপ্রধান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয় আফগানিস্তানের তৎকালীন শাসক তালেবান সরকার। সেই বিন লাদেনকে ধরার জন্য আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী আক্রমণ শুরু করলেও বহু বছর পর বিন লাদেনকে পাওয়া গিয়েছিল পাকিস্তানে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভেতরের একটি অংশ জঙ্গিদের হয়ে কাজ করছে বলেই সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের জোর বিশ্বাস। বিশেষ করে বিন লাদেন পাকিস্তানের একটি সামরিক আবাসিক এলাকাতে বছরের পর বছর নিরাপদে বসবাস করার পর সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে।
অপরদিকে, তালেবানদেরও অবাধ যাতায়াত রয়েছে পাকিস্তানে। মোল্লা ওমরের তালেবান সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতা হারালেও বছরের পর বছর দখলে রেখেছে আফগানিস্তানের একটা বিস্তৃত এলাকা। তাছাড়া ধারণা করা হয়, আল-কায়েদার কিছু সদস্য এখন পর্যন্ত আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে লুকিয়ে আছে। পশ্চিমা বাহিনী প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই এসব জঙ্গি বাহিনীর সদস্যরা তৎপর হয়ে উঠতে পারে।
হিসাব বলছে, ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে যে সরকারই আসুক না কেন পাকিস্তান চায় তালেবান যেন তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়। কারণ, তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। ৯০-এর দশকে আফগান গৃহযুদ্ধে তালেবানকে সমর্থন দিয়েছে পাকিস্তান। ১৯৯৬ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর যে মাত্র তিনটি দেশ তাদের বৈধ সরকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের একটি ছিল পাকিস্তান। তাছাড়া, তালেবানের নেতারা পাকিস্তানের আশ্রয় পেয়েছে সবসময়। এমনকি গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের যে শান্তিচুক্তি সম্ভব হয়, তার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের। যুক্তরাষ্ট্র সেটা একবাক্যে স্বীকারও করেছে।
তাছাড়া আফগানিস্তানে তালেবানদের বিজয় কাশ্মিরেও একটি প্রভাব ফেলতে পারে। সশস্ত্র কর্মকাণ্ড বেড়ে যেতে পারে সেখানে। এর কারণ হচ্ছে, ভারত আশরাফ ঘানির নেতৃত্বাধীন বর্তমান আফগান সরকারের শক্তিশালী সমর্থক। তদুপরি, দেশটি তালেবানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেনি। আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে সোভিয়েতের পরাজয়ের পর পরই জম্মু-কাশ্মীরে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মুজাহিদীনদের যেভাবে কৌশলগত শক্তি হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছিল, ঠিক একইভাবে এখন তালেবান জঙ্গিদেরও ব্যবহার করতে পারে।
গতবছর কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানদের সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে চীনও ভূমিকা রাখে নেপথ্যে থেকে। তারা কাবুল সরকার, তালেবান আর পাকিস্তানকে এক মঞ্চে নিয়ে আসে। এর কিছুদিন পর গত বছরের ২৬ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি আফগানিস্তানে নিয়োজিত চীনের বিশেষ দূত লিউ জিয়ানকে আফগানিস্তানের যুদ্ধ শেষ করতে সাহায্য করার জন্য ইসলামাবাদে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে তালেবানদের রাজনৈতিক শাখার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বৈঠক হয়েছে কীভাবে তালেবান এবং আফগান সরকার একটা সমঝোতায় পৌঁছতে পারে তার রূপরেখা নিয়ে।
তাছাড়া আফগানিস্তানের এই নব পর্যায় আরেকটি কোয়াডেরও জন্ম দিচ্ছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের জোটবদ্ধতার মতো আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে নতুন সেই কোয়াডের শরিক চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তান।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সখ্য রাশিয়া ও ইরানকে অনেকাংশে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ফলে নতুন এই কোয়াড জোটকে চীন ও পাকিস্তান পরবর্তীকালে ভারতবিরোধিতায় ব্যবহার করতে পারে। কারণ, চীন নিশ্চিতভাবেই চাইবে, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগের পাল্টা দান হিসেবে নতুন এই কোয়াডকে সক্রিয় করে তুলতে। আর তাতে চাপ বাড়বে ভারতের। কেননা, এখানে চীনের দোসর হিসেবে পাকিস্তানও রয়েছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে মিলে সারা বিশ্বে যারা এখন জঙ্গিগোষ্ঠীর সবচেয়ে নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বিবেচিত। আর এই দেশ দুটিই বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ ‘রপ্তানি’ করে বেড়ায়।
বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনগুলোর অধিকাংশই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকেন্দ্রিক। এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী জঙ্গি অর্থায়ন তদারকি করার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স- যার দায়িত্ব হচ্ছে, কারা জঙ্গিদের অর্থায়ন করছে তা নির্ধারণ করা এবং সেসব দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
তারা ইতোমধ্যে জঙ্গিদের অর্থ সাহায্য করার কারণে পাকিস্তানকে ধূসর তালিকাভুক্ত করেছে। পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ গণমাধ্যমে প্রকাশেই বলেছিলেন যে, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পদ। তারা রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন পায়। নিজেদের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সাম্প্রদায়িক তালেবান গোষ্ঠীকেও কৌশলগত শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তান এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অসহিষ্ণু করে তোলে কি না আগামীদিনে এ প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক