বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সামনে দেখা যাচ্ছে, পেছনে কী

  • রাজেকুজ্জামান রতন   
  • ৩ আগস্ট, ২০২১ ১৪:৫৪

দুই শ টাকা পকেটমার হওয়ার পর পকেটমার ধরা পড়লে তার হাড়-মাংস এক করে দেবার মতো মারধোর করার লোকের অভাব হয় না। আবার ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, দুর্নীতি করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে এরকম লোককে সালাম দেবার মানুষের অভাব হয় না। দুক্ষেত্রেই হাত খুব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কোথাও মারতে আর কোথাও বা সালাম দিতে। পার্থক্য হয়ে যায় টাকার পরিমাণের কারণে।

সময়টা এখন এমনই। কয়েকদিন আগেই যিনি হেঁটে কিংবা রিকশায় চলাচল করতেন তাকে বিশাল ঝকঝকে গাড়ি থেকে নামতে দেখলে পরিচিতজনেরা এখন আর অবাক হন না। অথবা মেসে থাকা মানুষটাকে অভিজাত এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে দেখেও তাক লেগে যায় না কারো। অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কপাল! কেউ আবার অতটা কপালের ওপর নির্ভর করেন না, তারা বলেন, বেশ করিৎকর্মা ও বুদ্ধিমান। কয়েক বছরে কী রকম উন্নতি করেছে দেখেছেন? কপাল বলুক আর করিৎকর্মা বলে স্বীকৃতি দিক, যা-ই করুক না কেন এই দ্রুত সম্পদশালী হয়ে ওঠার কারণ সবাই জানে। কিন্তু বলতে চায় না। কেউ বলে না ভয়ে, আর কেউ বলে না কারণ, তার মনেও গোপন বাসনা। সেও এরকম হয়ে উঠতে চায়।

কিছু সহজ প্রশ্ন কখনও মাথা ঘুরিয়ে দেয়। উত্তর দেয়ার পরিবর্তে চিন্তা করতে হয় পরবর্তী প্রশ্নটা কী হতে পারে। যেমন, কত টাকায় এক কোটি টাকা হয়? কতদিন লাগে এক কোটি টাকা জমাতে। সম্রাট আকবরের প্রশ্নে বীরবল যে পদ্ধতিতে উত্তর দিয়েছিলেন সেই পদ্ধতি অবলম্বন করে বললে উত্তর দাঁড়াবে, যদি মাসে এক লাখ টাকা করে জমায় তাহলে ব্যাংকের লাভসহ কমপক্ষে ৮৪ মাস। কিন্তু প্রশ্ন হলো কতজন মানুষ সংসার খরচের পর মাসে এক লাখ টাকা জমাতে পারেন?

তাহলে ৩৫/ ৪০ বছর বয়সে একজন নারী বা পুরুষ কীভাবে কয়েক কোটি টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স, কয়েক কোটি টাকার বাড়ি এবং কোটি টাকার গাড়ির মালিক হয়ে যেতে পারেন? সবচেয়ে সঠিক উত্তরটা হবে, অসৎ পথে উপার্জন করে অর্থাৎ দুর্নীতি করে। দুর্নীতি কি সবাই করতে পারে? সহজ উত্তর হবে, না। কারণ, দুর্নীতি করতে ক্ষমতা লাগে। দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতা আর ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি তাই যুগলবন্দি। দুজনে দুজনার।

দেশের মানুষের জীবনে কত সমস্যা! আর কত ঘটনাই না ঘটে চলেছে প্রতিদিন। কিছু ঘটনা নিয়মিতভাবে দীর্ঘদিন ধরেই ঘটে চলছে, কিছু ঘটনা হঠাৎ করে ঘটছে। কোনো কোনো ঘটনায় শুধু চমকে ওঠা নয় আঁতকে উঠছে মানুষ। কী হচ্ছে এবং কী ঘটছে দেশে। যারা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হচ্ছেন। গ্রেপ্তারদের আত্মবিশ্বাসভরা হাসিমুখ দেখে এই প্রশ্ন ওঠা একেবারেই অস্বাভাবিক নয় যে, তাদের হাত লম্বা এবং শিকড় গভীর ছিল। দীর্ঘদিন পরে বেচারা কোনো কারণে ধরা পড়েছেন কিন্তু যারা ধরা পড়েননি তাদের সংখ্যা এবং শক্তিও হয়তো যে কম নয়, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

কয়েকদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে কয়েকটি নাম। রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন সদ্য আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সদস্যপদ হারানো ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর। তার বাসায় অভিযান শেষে র‍্যাব জানিয়েছে, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মদ, বিয়ার, বিদেশি মুদ্রা, চাকু, মোবাইল সেট, ক্যাসিনো সরঞ্জাম, এটিএম কার্ড ও হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে।

র‍্যাবের তদন্তে হেলেনা জাহাঙ্গীরের মালিকানায় রাজধানীতে ১৫টি ফ্ল্যাটের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে পাঁচটি ফ্ল্যাট, গুলশান ৩৬ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িতে পাঁচটি ফ্ল্যাট, গুলশান ২ নম্বরের ৮৬ নম্বর সড়কের ৭/বি নম্বর বাড়িতে আট হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, গুলশান এভিনিউ ও নিকেতনে দুটি ফ্ল্যাট, মিরপুর ১১ নম্বরে একটি ফ্ল্যাট এবং কাজীপাড়ায় একটি ফ্ল্যাট।

র‍্যাবের তদন্তে আরও জানা যাচ্ছে, হেলেনা পাঁচটি গার্মেন্টের মালিক। এগুলো হলো মিরপুর ১১ নম্বরের নিউ কনসার্ন প্রিন্টিং ইউনিট, নারায়ণগঞ্জের জয় অটো গার্মেন্টস, জেসি এমব্রয়ডারি, প্যাক কনসার্ন (যৌথ মালিকানা) ও হুমায়ারা স্টিকার। এছাড়া সাতটি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে হেলেনার সম্পৃক্ততার কথাও উঠে এসেছে। সেগুলো হলো জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন, আর্চারি ফেডারেশন ক্লাব, নোটারি ডোনেশনস, টেনিস ফেডারেশন, ইনারহিল ক্লাব, জন্টা ইন্টারন্যাশনাল লেডিস ক্লাব ও ক্যারম ফেডারেশন।

এখানেই শেষ নয়, র‍্যাব কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, হেলেনা মোট ১২টি ক্লাবের সদস্য। সেগুলো হলো গুলশান ক্লাব, গুলশান ক্যাপিটাল ক্লাব, গুলশান নর্থ ক্লাব, ঢাকা বোর্ড ক্লাব, গুলশান সোসাইটি ক্লাব, কুমিল্লা ক্লাব, গুলশান জগার সোসাইটি, ফিল্ম ক্লাব, গুলশান হেলথ ক্লাব, গুলশান লেডিস ক্লাব, ঢাকা রাইফেলস ক্লাব ও ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলার্স ক্লাব। আবার র‍্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে কখনও ছয়টি গাড়ি, কখনও আটটি গাড়ির মালিকানার কথা বলেছেন হেলেনা।

আবার পিয়াসা ও মৌ নামে আরও দুই নারীকে আটক করা হয়েছে, যারা নাকি বেশ পরিচিত মডেল বা অভিনেত্রী। আটকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফ করতে গিয়ে ডিবি কর্মকর্তা বলেন, তারা দুজন একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে অনেক ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ ছিল। সেসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। দুজনের বাসায় বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সিসা পাওয়া গেছে। মৌয়ের বাড়িতে মদের বারও ছিল।

ডিবির কর্মকর্তা আরও বলেছেন, আটক দুই মডেল হচ্ছেন রাতের রানি। তারা দিনের বেলায় ঘুমান এবং রাতে এসব কর্মকাণ্ড করেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে এনে তাদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ধারণ করে রাখতেন। পরে তারা সেসব ভিডিও ও ছবি পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতেন।

আর একটি ঘটনাও নিশ্চয়ই আড়াল হয়ে যাবে না। গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে একসময়ের চিত্রনায়িকা একাকে আটক করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে শনিবার (৩১ জুলাই) বিকালে তাকে রাজধানীর উলনের বাসা থেকে আটক করা হয়। থানার ওসি জানিয়েছেন, একার বাসা থেকে পাঁচ পিস ইয়াবা, ৫০ গ্রাম গাঁজা ও মদ উদ্ধার করা হয়েছে। এর কয়েকদিন আগে একটি নামকরা স্কুলের অধ্যক্ষের একটি টেলিফোন কথোপকথন প্রচার মাধ্যমে এসেছে। কীভাবে এসব প্রচার মাধ্যমে আসে সেটা একটা প্রশ্ন। এটা কতটা অশ্লীল, অসৌজন্যমূলক, পদের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ তা আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তিনি যা বলেছেন তাতে এই ক্ষমতার ভিত্তি কোথায় তার কিছুটা উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো চিন্তা করি না। কারণ, আমি নিজেই শক্তিশালী। আমি যে দলের প্রেসিডেন্ট ছিলাম সেই দলটা এখন সরকারে। যতদিন এই দলটা আছে ততদিন আমার পাওয়ার আছে। আমি কিন্তু ... বাচ্চাদের লেংটা করে রাস্তার মধ্যে পিটাইতে পারব।’

একটা বিষয় লক্ষ করার মতো যে, কোনো অপকর্ম করে কেউ ধরা পড়লেই দেখা যায় তিনি ক্ষমতাসীন দলের কোনো না কোনো পদে আছেন বা ক্ষমতাসীন দলের বড় বড় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। ছবি তাদের একটা প্রমাণপত্রের মতো। বাসার ড্রইং রুমে বড় করে বাঁধাই করে রাখা, নিজের সঙ্গে রাখা, পোস্টার ছাপিয়ে লাগানো, রাস্তায় বড় করে বিলবোর্ড লাগানো এসব হলো ক্ষমতা দেখানোর আরেক কৌশল। ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা সর্বত্র। কোনো কাজ পেতে, টেন্ডার পেতে, সুবিধা পেতে গিয়ে কত বড় মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক এটা এখন অন্যতম যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা টিভি বিজ্ঞাপন আছে না! যেখানে ধমকের সুরে একজন বলছেন , ‘তুমি জানো আমি কে? এটা ভদ্র ভাষায় বলা হয়েছে। কিন্তু, তুই আমারে চিনস? এই সংস্কৃতি চলছে সর্বত্র। দাপট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠা পাবার মানসিকতার পেছনে মূল কারণ অবৈধ সুবিধা। সেটা সংসদ সদস্য মনোনয়ন থেকে শিক্ষক নিয়োগ, ব্যবসা থেকে বদলি, স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করা থেকে মসজিদ কমিটির সভাপতি পর্যন্ত সর্বত্র টাকার প্রভাব।

দুই শ টাকা পকেটমার হওয়ার পর পকেটমার ধরা পড়লে তার হাড়-মাংস এক করে দেবার মতো মারধোর করার লোকের অভাব হয় না। আবার ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, দুর্নীতি করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে এরকম লোককে সালাম দেবার মানুষের অভাব হয় না। দুক্ষেত্রেই হাত খুব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কোথাও মারতে আর কোথাও বা সালাম দিতে। পার্থক্য হয়ে যায় টাকার পরিমাণের কারণে।

প্রথমে ভিকারুন্নিসা স্কুলের অধ্যক্ষ, তারপর একে একে হেলেনা জাহাঙ্গীর, মডেল পিয়াসা, মৌ, চিত্রনায়িকা একা, চিকিৎসক ডা. ঈশিতা। ঘটনা প্রবাহ প্রায় একই রকম, তাদের ব্যবহারও প্রায় একই ধরনের। বড় বড় মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, গালাগাল করা, দেখে নেয়ার হুমকি দেয়া। কারো বাসায় দেয়ালে শোভা পায় বন্যপ্রাণীর চামড়া। কারো বাসায় ড্রাগস মেলে, আবার কারো বাসায় মদ। কেউবা ভুয়া ডিগ্রি দেখিয়ে করে প্রতারণা। অর্থাৎ এরা সবাই সমাজের জন্য ক্ষতিকর, ক্ষমতাধর, ভয়ংকর মানুষ। অনেকদিন বহাল তবিয়তে ছিলেন। ভোগ করেছেন প্রচুর, অনেকের জীবনে দুর্ভোগ এনেছেন। ধরা পড়ার পর ভুক্তভোগীদের অনেকেই মুখ খুলেছেন, কেউ কেউ মুখ খোলার কথা ভাবছেন আর কেউ হয়তো কখনই মুখ খুলবেন না, তাদেরও কিছু বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ তৎপরতা চালিয়ে এদেরকে ধরেছে, প্রেস কনফারেন্স করে তাদের অপরাধের বর্ণনা দিয়েছে, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যমে তার রসালো প্রচার হচ্ছে। এরা নারী হওয়ার কারণে মানুষ সম্ভবত তার একঘেয়ে জীবনে কিছুটা বিনোদন পাচ্ছেন। কিন্তু যে প্রশ্ন তারা উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না তা হলো, মাঝে মাঝে এসব ঘটছে কেন? এসব নারীর যে পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্ক তারা কারা?

এদের প্রায় সবার বাড়ি থেকেই মাদক উদ্ধার হচ্ছে কেন? বর্তমানের আলোড়ন হেলেনা বা অধুনা বিস্মৃত পাপিয়া কিংবা আরও যত নাম শুনছি বা দেখছি তারাই কি সব? এসব কি দুর্নীতির বিশাল আইসবার্গের ওপরের সামান্য অংশ? এদের পিছনে, পাশে এবং সামনে যারা ছিলেন তারা কি বহাল তবিয়তে থাকবেন? এরা ক্ষমতাসীনদের ব্যবহার করেন, নিজেরা ব্যবহৃত হন, মানুষকে কষ্ট দেন এটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের রুচির মানটা যে নেমে যাচ্ছে এবং মানুষ এসব মুখরোচক খবর নিয়েই ব্যস্ত থাকছে সেটাও কিন্তু কম কষ্টের নয়।

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর