শ্রমিকের জীবন নিয়ে এক অমানবিক দৃশ্যের অবতারণা হলো আবার। ঢাকায় প্রবেশ করার প্রতিটি পথেই মানুষ আর মানুষ। লঞ্চে, ফেরিতে তিলধারণের ঠাঁই নেই। বাসে দ্বিগুণ তিনগুণ ভাড়া। মানুষ উঠে পড়েছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানে। আসছে রিকশাভ্যান, ইজি বাইক, সিএনজি-চালিত অটোরিশায়। কী এক অজানা আতঙ্কে মানুষ ছুটে আসছে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জের দিকে।
টাকা বেশি লাগে লাগুক, যত কষ্টই হোক তাদেরকে আসতেই হবে। কোথায় স্বাস্থ্যবিধি আর কোথায় শারীরিক দূরত্ব! জীবন বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবিকার তাগিদে মানুষ আসছে। কিন্তু তাদেরকে আনছে যারা তারা কেন এই সিদ্ধান্ত নিল? ব্যবসা, মুনাফা, টাকা এই শব্দগুলো যে কত শক্তিশালী তা মানুষ দেখছে এবং বুঝছে বার বার। ক্ষমতা যে আসলে টাকার ক্ষমতা, টাকাওয়ালারা সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে ভালোভাবেই।
করোনার সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছে, গ্রাম এবং শহরের পার্থক্য আর নেই বললেই চলে। মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ। হাসপাতালে ঠাঁই নেই, অক্সিজেন নেই, আইসিইউ বেড খালি নেই। যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এতদিন স্বাস্থ্য খাতে সক্ষমতার বিবরণ দিতেন এখন তিনি বলছেন সংক্রমণ আরও বাড়লে করার আর কিছুই থাকবে না। কষ্টকর মৃত্যুই যেন শেষ পরিণতি। বাঁচতে হলে ঘরে থাকুন!
এ যাবৎকালের সবচেয়ে কড়া লকডাউন চলছে। রাস্তায় সামরিক বাহিনীও আছে মানুষকে ঠেকাতে। ৫ আগস্ট পর্যন্ত সমস্ত ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধ। এ পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা এল গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী কারখানা ১ আগস্ট থেকে চালু করা হবে।
ঘোষণা তো এমনি এমনি আসেনি! মালিকদের পক্ষ থেকে প্রথমে আবদার, তারপর দাবি এরপর মৃদু হুমকির মুখে চলমান কঠোর ও সর্বাত্মক লকডাউন এবং বিধিনিষেধের মধ্যেই তৈরি পোশাকসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা রোববার খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পোশাক কারখানার মালিক তথা রপ্তানিকারকদের মুখে এখন তৃপ্তির হাসি সঙ্গে একটু গর্বের ঝিলিক। মুখের ভাষায় না হলেও ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে তাদের মনের কথা। বলেছিলাম না আমাদের কথা সরকারকে শুনতেই হবে।
রোববার সকাল ছয়টা থেকে পোশাকসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানাকে বিধিনিষেধের আওতামুক্ত ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ শুক্রবার বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল ব্যবসায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে যত দ্রুত সম্ভব শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার অনুরোধ জানান। তাদের অনুরোধ ফেলতে পারেনি সরকার।
এর আগে শ্রম প্রতিমন্ত্রী আবেদন জানিয়েছিলেন, যেন মালিকরা কারখানা লে-অফ না করেন। তিনি কিন্তু বলেননি যে বেআইনি লে-অফ করলে শ্রম আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে। বরং শ্রমিকদেরকে ভয়ের ইঙ্গিত দেখালেন। এখন সিদ্ধান্ত নাও, করোনার ভয় না কাজ হারানোর ভয় কোনটা বড়? সব জটিলতার অবসান ঘটিয়ে শেষে রপ্তানিমুখী সব শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা দিল সরকার। যাক! শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেঁচে গেলেন লে-অফ জনিত দুশ্চিন্তা থেকে আর মালিক নেতারা দেখালেন তাদের ক্ষমতা। কিন্তু শ্রমিকেরা? এই চলমান বিধিনিষেধে শ্রমিকেরা দূর দূরান্ত থেকে কীভাবে কর্মস্থলে আসবেন তার কোনো ব্যবস্থা করা হবে কি না তা বলা হয়নি।
করোনা সংক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী ২৩ জুলাই থেকে জারি করা কঠোরতম বিধিনিষেধের মধ্যে গত ২৭ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক সভায় হয়। তাতে সিদ্ধান্ত হয়, চলমান বিধিনিষেধে শিল্পকারখানা খোলার জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ থাকলেও তা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। তার মানে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা বন্ধই থাকছে। কিন্তু ৩০ জুলাই সিদ্ধান্ত হলো ১ আগস্ট থেকে কারখানা খুলছে।
ঈদের ছুটি এবং ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে মানুষ কীভাবে যে গ্রামের দিকে ছুটেছে তা যমুনা সেতুতে গাড়ির ভিড়, সদরঘাটে লঞ্চে যাত্রীর ভিড়, দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে মানুষ আর গাড়ির ভিড় দেখে বুঝা গেছে। এরা কারা? কেন এরা ঈদ এলে বাড়ির দিকে ছোটে? এরকম কথা বলেন অনেকেই। তারা কি ভেবেছিলেন যখন সব বন্ধ তখন এই মানুষগুলো থাকবে কীভাবে?
এই মানুষগুলো বাড়ি গিয়েছিল স্বজনের প্রতি মায়ার টানে আর খরচ বাঁচাতে। কারণ কারখানা বন্ধ এখানে থেকে কী করবে? এখন আবার হুড়মুড় করে আসছে, কারণ না এলে চাকরি থাকবে না। তাই সে আসছে তিনগুণ চারগুণ বেশি খরচ, অবর্ণনীয় কষ্ট আর সময় ব্যয় করে। কোথায় থাকবে স্বাস্থ্যবিধি আর কোথায় কী? এসব দেখে অনেকেই হয়তো বলবে- বুঝলেন, আসলে বাঙালি কথা শোনে না, নিয়ম মানে না। কিন্তু যারা ঘন ঘন নিয়ম পালটান, বাধ্য করেন শ্রমজীবী মানুষদেরকে তাদের হুকুম মানতে, তাদের কি কোনো দায় নেই?
মালিক দেখছে উৎপাদন, অর্ডার, মুনাফা। সরকার দেখছে রপ্তানি আয়। একদিকে ৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়, অপরদিকে ৪০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক। অর্ডার বাতিল হলে আর পাওয়া যাবে না, মুনাফা হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু শ্রমিক তো যথেষ্টই আছে। আর শ্রমিক দেখছে তার চাকরি। এটা না থাকলে সে বাঁচবে কীভাবে? করোনার চাইতে ক্ষুধার যন্ত্রণা যে বেশি! তাই সে ঝুঁকি নিতে পরোয়া করে না। ফলে মুনাফার জন্য এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়ে গেল।
হুকুম তামিল করতে এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকা মানুষটিও যখন ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পাল্টানোর সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না আর সে কারণে শাস্তির মুখোমুখি হয় তখন তার একটিমাত্র জবাব থাকে, এত কিছু কেমনে সামলাই বলেন, আমিও তো মানুষ! কিন্তু চাকরি বাঁচানোর জন্যে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বলছে, করোনা ফরনা বাদ দেন, আমরা কি মানুষ যে আমাদের করোনা হবে?
আর সরকার কিংবা মালিক! তারা তো বলেন, শ্রমিকরাই আমাদের শক্তি। তারা পরিশ্রম করে বলেই উৎপাদন হয়, রপ্তানি বাড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ঘোষণা দিলেন ১ আগস্ট থেকে কারখানা চলবে, শ্রমিকদের আসার জন্য কোনো ব্যবস্থা কি করলেন? শ্রমিকরা এলে করোনা টেস্ট করা, সংক্রমিতদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা, চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়া, মৃত্যুবরণ করলে সরকারি কর্মচারীদের মতো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা, করোনাকালীন কাজে ঝুঁকিভাতা দেয়া, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগের গাইড লাইন অনুযায়ী সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শ্রমিকদেরকে কাজে যোগদান করতে বললে তবুও বুঝা যেত শ্রমিকদের প্রতি কিছুটা দায় পালন করেছেন। কিন্তু মালিকদের মনোভাবটা তো এরকম যে, এরা হলো সস্তা মানুষের দেশের শ্রমিক। তাদের আবার কষ্ট!
কষ্ট করার অভ্যাস আছে ওদের। ওরা ঠিকই চলে আসবে। আসলেই, আসবেই তো। না-হলে চাকরি যে থাকবে না। ত্রিপলঢাকা মালবাহী ট্রাকে করে আসছে নারী শ্রমিকেরা। একজন গরমে, অন্ধকারে হাঁসফাঁস করতে করতে বলছে, ত্রিপলটা একটু তুলে ধরুন। একটু আলো আর বাতাস আসুক! অসহায় মুখটা বের করে বাইরে তাকিয়ে থাকার এই ছবি যেন দেশের শ্রমিকের জীবনের প্রতীক। জীবনে একটু আলো আর বাতাসের জন্য আর কত অন্ধকারে থাকতে হবে শ্রমিকদের?
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।