বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বদ্ধবুদ্ধির ইতিহাসচর্চা ও ঐতিহ্য রক্ষার সংকট

  •    
  • ৩১ জুলাই, ২০২১ ১১:৫০

ইতিহাস থেকে মুসলমান নেতা খুঁজতে গিয়ে আর বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করতে বিএনপির নেতারা খুঁজে পেলেন বখতিয়ার খলজিকে। আর পাশাপাশি প্রমাণ করলেন নিজেদের ইতিহাসবোধহীন মূর্খতাকে। ইতিহাস বলছে বখতিয়ার আজকের বাংলাদেশের সীমারেখায় প্রবেশ করেননি। তার অধিকৃত অঞ্চল ছিল পশ্চিম বাংলার নদিয়া, লখনৌতি (মালদহ) এবং দিনাজপুরের দেবকোট। বখতিয়ারের জীবদ্দশায় পূর্ব বাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ শাসন করেন সেন রাজারা। তাই বখতিয়ারকে জাতীয় বীর হিসেবে গর্ব করতে পারে পশ্চিম বাংলার বদ্ধবুদ্ধির মুসলমান। বোঝা গেল এত আয়োজন করে বিএনপি ভুল দরোজায় নক করেছিল।

বলা হয় ইতিহাসচর্চা জীবন্ত জাতির পরিচায়ক। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, একটি উজ্জ্বল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যেদেশের রয়েছে, যে মাটির রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সেদেশেরই শিক্ষিত বলে দাবিদার অধিকাংশ মানুষ ইতিহাস ও ঐতিহ্যচর্চা-বিমুখ। আর সে সুযোগ নিয়ে কিছুসংখ্যক ইতিহাস ও রাজনীতির বণিক আধিপত্যবাদী মানসিকতায় ইতিহাসের বিভ্রান্ত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ঐতিহ্য বিনাশ করে যাচ্ছেন প্রায় বিনা প্রতিরোধে। একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষা করা রাষ্ট্র ও জনগণের শুধু দায়িত্ব নয় কর্তব্যও। কারণ বর্তমানকে সাজাতে-ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ করতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টি করা প্রয়োজন দেশাত্মবোধ ও এগিয়ে চলার উদ্দীপনা।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ- যেখানে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হওয়ার পরও দারিদ্র্য, বেকার সমস্যা আর রাজনৈতিক নৈরাজ্য এড়াতে পারছি না সেখানে প্রজন্মের বিভ্রান্ত হওয়ার হাজারটি পথ খোলা থাকে। অনেক মমতায়, সামর্থ্য, আর নিপুণ দক্ষতায় পূর্বসূরিদের গড়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভ্রান্ত প্রজন্মের কাছে সামনে তুলে ধরে তাদের আলোর পথে আনা সম্ভব। ইতিহাসের সোনালি পাতা যখন উন্মোচিত হবে তখন নতুন করে নিজেদের আবিষ্কার করবে প্রজন্ম। নতুন শক্তি তাকে প্রাণিত করবে। সমৃদ্ধ দেশ গড়ায় নিজেদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। এ কারণে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা প্রত্নসম্পদ বুক দিয়ে আগলে রাখে সভ্য দেশের মানুষ, আর রাষ্ট্রীয় বিধায়করা তা সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করেন এবং সর্বাধিক জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় তা প্রয়োগ করেন পবিত্র দায়িত্ব বিবেচনায়। কিন্তু উল্টো পথে হাঁটছি আমরা। এই প্রসঙ্গটিকে স্পষ্ট করার জন্য আমি নিকট অতীত থেকে কয়েকটি উদাহরণ দাঁড় করাতে চাই।

এক.

ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তে বিশ্ব ঐতিহ্য বলে ঘোষিত পাহাড়পুর বিহারের শিল্পকৃতি ধ্বংসের মহাযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছিল সম্ভবত ২০০২ সালে ইউনেস্কোর অর্থ সহযোগিতায় এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায়। পাহাড়পুর বিহারের অন্যতম ঐশ্বর্য এর গায়ে সাঁটা প্রায় আড়াই হাজারের মতো অলংকরণসমৃদ্ধ পোড়ামাটির ফলক। কী এক অদ্ভুত সিদ্ধান্তে সংরক্ষণের নামে দেয়ালের গা থেকে তুলে ফেলা হলো অধিকাংশ ফলক। এর বদলে লাখ লাখ টাকার টেন্ডারে কুমোরদের দিয়ে রেপ্লিকা বানিয়ে তা লাগানো হয়েছিল দেয়ালে। তুলে ফেলা ফলকের সংরক্ষণ বা স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা কী তা অজ্ঞাত। ভবিষ্যৎ গবেষক বা দর্শক দেয়ালের রেপ্লিকাগুলোকে আট শতকের শিল্পকর্ম ভেবে বিভ্রান্ত হবেন। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তোলায় এক সময় সব কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

এখন বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে এক ধরনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পরও যা সত্য তা হচ্ছে পাহাড়পুর বিহার তার অহংকারের ফলক হারিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্ধনগ্ন অবস্থায়। একইভাবে আরেক বিশ্বঐতিহ্য বলে ঘোষিত বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের অভ্যন্তরও বিকৃত করা হয় ইউনেস্কোর অর্থ সহযোগিতায় এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায়। পনেরো শতকের এই সুলতানি মসজিদটির অভ্যন্তরে সুলতানি বৈশিষ্ট্যের লাল ইটের দেয়ালে পুরু পলেস্তারা করা হয়েছিল। নষ্ট হয়েছিল পোড়ামাটির ফলক। এর অন্যতম ঐশ্বর্য সারি সারি পাথরের স্তম্ভ ইটের কেসিংয়ে বন্দি করা হয়। অর্থাৎ বিকৃত করা হয়েছিল সুলতানি যুগের বৈশিষ্ট্য। এখন চেষ্টা করা হয়েছে আদিরূপে কিছুটা ফিরিয়ে আনার।

দুই.

২০০৭ সালে এক অদ্ভুত ঐতিহ্যবিনাশী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ফ্রান্সের একটি বেসরকারি জাদুঘর গিমে মিউজিয়ামে বাংলাদেশের প্রত্ন-ঐতিহ্যের ছয় মাসব্যাপী প্রদর্শনী হবে। প্রদর্শনীর জন্য সেখানে উড়িয়ে নেয়া হবে আমাদের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত ১৮৯টি প্রত্ননিদর্শন। যে সে প্রত্নবস্তু নয়, সবই মাস্টার পিস। শুধু মাস্টার পিসই নয়, এর মধ্যে বেশকিছু অনন্য। অর্থাৎ এসবের আর দ্বিতীয়টি নেই। সরকারিপর্যায়ের লোকজন এবং সাংস্কৃতিক অঞ্চলের কিছুসংখ্যক বণিক মানসিকতার মানুষ এই ঐতিহ্যবিনাশী সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছিলেন ও সমর্থন দিয়েছিলেন লোভ অথবা ঐতিহ্য মূর্খতার কারণে। আমাদের অনেককেই তখন প্রতিবাদ করে মাঠে নামতে হয়েছিল।

কয়েকটি কারণে এই সরকারি সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে ধোঁয়াটে মনে হয়েছিল। প্রথমত, অনুকৃতি বা রেপ্লিকা নয়, এত বিপুলসংখ্যক মূল এবং মাস্টার পিস প্রত্নবস্তু বিশ্বের কোনো দেশ থেকে প্রদর্শনীর জন্য দেশান্তরী হয়েছে এমন তথ্য আমার জানা নেই। অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জনসম্মুখে জানানোর প্রায় দুই বছর আগে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ফরাসি সরকারের পক্ষে (?) বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত। দ্বিতীয়ত, সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং প্রত্নবস্তু নির্বাচন ও বাছাইয়ে কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়নি বা বিষয় বিশেষজ্ঞদের কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়নি। তৃতীয়ত, প্রত্নবস্তু-সংক্রান্ত আইনকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাশ কাটানো হয়েছে।

চতুর্থত, ফরাসি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে প্রচারিত হলেও ফরাসি সরকার এই চুক্তি স্বাক্ষরের কোনো পক্ষ নয়। রাষ্ট্রদূত চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন গিমে জাদুঘরের পক্ষে। শেষত, এমন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুবছর ধরে প্রায় গোপন রাখা হয়। অনেকটা নীরবে কয়েকজন ফরাসির তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, ময়নামতি জাদুঘর এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংগ্রহ থেকে ভাস্কর্যসহ সমস্ত প্রত্নবস্তু নিয়ে ফ্রান্সে পাঠানোর জন্য প্যাকেট করা হয়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত প্রবল প্রতিবাদ-আন্দোলনের মুখে সরকারকে পিছু হটতে হয়।

তিন.

অপূর্ণ ইতিহাসচর্চার কারণে নতুন প্রজন্মের সামনে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের চর্যাপদচর্চা বা স্বাধীন সুলতানি যুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার উজ্জ্বল দিনের কথা অস্পষ্ট। একুশেই তাদের প্রেরণার প্রথম উৎস। তাই একুশের আবেগ বিচ্ছিন্ন হলে প্রজন্ম প্রাণিত হওয়ার এই শেষ সূত্র হারিয়ে ফেলবে।

মানতেই হবে একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে- তার সংস্কৃতিভাবনায় ভিন্ন আবেগ যুক্ত করেছে। নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে তাই মৌলিক আবেগ থেকে একুশে তর্পণের বিকল্প নেই। কিন্তু নাগরিক জীবনে একুশের আবেগকে খণ্ডিত করে ফেলা হয়েছে। প্রায় দেড় দশক আগে সামরিক শাসক নিজের নিরাপত্তার দিক বিচারে একুশের প্রথম প্রহর নাম দিয়ে রাত ১২ টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের রেওয়াজ চালু করে। একে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয় নগরবাসী সংস্কৃতিকর্মীসহ সবশ্রেণির মানুষ। আর সেইসঙ্গে একুশের চেতনায় জড়িয়ে থাকা প্রভাতফেরি নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা হয়ে যায়। বাঙালি সংস্কৃতি রাত ১২টা ১ মিনিটকে দিনের প্রথম প্রহর বিবেচনা করে না।

আবহমান বাংলার দিনের শুরু প্রত্যুষে আর দিনের অবসান সন্ধ্যায়। পাশ্চাত্যের চব্বিশ ঘণ্টা গণনায় দিনের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিট। পাশ্চাত্যের অনুসরণেই যেন মাঝরাতে চলে গেল একুশে তর্পণ এবং প্রায় বিনা প্রতিবাদেই। ভাবা প্রয়োজন ছিল যে একুশের গানের মূর্ছনায় প্রভাতফেরির যাত্রা নতুন প্রজন্মকে কৌতূহলী ও আবেগ আপ্লুত করে তুলবে। নতুন করে ভাববে আমাদের ভাষাপ্রেম আর দেশপ্রেমের কথা। এভাবেই প্রাণিত হবে তারা। এখন একুশে শুধু বাংলাদেশের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে বিশ্ববাসী।

এই ভাষা দিবসে একবার বিশ্ববাসী ফিরে তাকাবে ভাষা-আন্দোলনের সূতিকাগার এদেশটির দিকে। অনুকরণ করবে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলির রেওয়াজকে। প্রভাতফেরি শব্দটির জন্মই হয়েছে যেন একুশে প্রভাতের মিছিলকে বোঝাতে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে উৎসভূমির অনুকরণে বিশ্ববাসীও প্রভাতফেরিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। অথচ আমরাই হঠকারী সিদ্ধান্তে প্রভাতফেরিকে বিসর্জন দিয়ে মধ্যরাতে একুশের চেতনা খুঁজে ফিরছি। সংস্কৃতি ভাবনার সুস্থ ধারা বলবে আমরা প্রভাতফেরিকে হারাতে চাই না। হারাতে চাই না একুশের আবেগকে। রাত ১২টা ১-এর বৈরী সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে আবার প্রভাতফেরির একুশে উদযাপনে ফিরে যেতে চাই। কারণ একুশকে তার স্বমহিমায় পুনঃস্থাপন না করে প্রজন্মকে ভাষাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না। আর কে না জানে দেশপ্রেমের জন্ম তার ভাষা প্রেমের মধ্য থেকেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য এদেশে সাংস্কৃতিক অঞ্চলের দিকপালরা এ ব্যাপারে নীরব। প্রভাতফেরি বিসর্জন দিয়ে বিনা প্রতিবাদে মধ্যরাতে শহীদমিনার উজালা করে ফিরছেন।

চার.

১৯৯৭ সালের জানুয়ারির শুরুতে বিএনপির সাংস্কৃতিক অঙ্গ সংগঠন ঢাকঢোল পিটিয়ে বখতিয়ার খলজির (ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি) ‘বঙ্গ বিজয় বার্ষিকী’ পালন করেছিল। এ উপলক্ষে একটি জমকালো অনুষ্ঠান হয়েছিল। বোঝা গেল পাকিস্তানি শাসকদের রাজনৈতিক কূটচিন্তায় ইতিহাস থেকে এক সময় খুঁজতে হয়েছিল মুসলমান নেতা। নায়ক হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন নবাব সিরাজ উ দৌলা। তেমনিভাবে ইতিহাস থেকে মুসলমান নেতা খুঁজতে গিয়ে আর বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করতে বিএনপির নেতারা খুঁজে পেলেন বখতিয়ার খলজিকে। আর পাশাপাশি প্রমাণ করলেন নিজেদের ইতিহাসবোধহীন মূর্খতাকে। ইতিহাস বলছে বখতিয়ার আজকের বাংলাদেশের সীমারেখায় প্রবেশ করেননি। তার অধিকৃত অঞ্চল ছিল পশ্চিম বাংলার নদিয়া, লখনৌতি (মালদহ) এবং দিনাজপুরের দেবকোট।

বখতিয়ারের জীবদ্দশায় পূর্ব বাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ শাসন করেন সেন রাজারা। তাই বখতিয়ারকে জাতীয় বীর হিসেবে গর্ব করতে পারে পশ্চিম বাংলার বদ্ধবুদ্ধির মুসলমান। বোঝা গেল এত আয়োজন করে বিএনপি ভুল দরোজায় নক করেছিল। অবশ্য আমাদের কোনো কোনো ইতিহাস লেখকের অসতর্কতাও বিএনপিকে বিভ্রান্ত করেছে। বাংলার ইতিহাসের পাঠক মাত্রই পড়ে ফেলেন ‘বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়’। অথচ বখতিয়ার কোনো অর্থেই বঙ্গবিজেতা হতে পারেন না। এনিয়ে প্রতিবাদ করে আমি সেসময় নিবন্ধ লিখেছিলাম পত্রিকায়। অনেক বাদানুবাদও হয়েছিল।

একইভাবে ২০০৭-এর ২২ জানুয়ারি ইতিহাস গবেষণার প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে ঘটেছিল আরেকটি ইতিহাস সংকটের ঘটনা। ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঢাকা নগরীর ৪০০ বছর পূর্তি উদযাপনের ৩ বছর মেয়াদি উৎসবের উদ্বোধন হয়েছিল সেদিন। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সেসময় পত্রিকায় লিখে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম আমি। তারপর এক সময় কিছুটা সরে আসেন আয়োজকরা। নগরীর ৪০০ বছর না বলে এবার বলতে থাকেন ‘রাজধানী ঢাকার’ ৪০০ বছর। তখনও ইতিহাসের তথ্য সূত্র দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম।

সাম্রাজ্যবাদী মোগলরা ৪০০ বছর আগে বাংলার প্রায় আড়াই শ’ বছরের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে এদেশকে দিল্লির প্রদেশে পরিণত করে। ঢাকা হয় প্রদেশ অর্থাৎ বাংলা সুবার রাজধানী। তারপরেও অদ্ভুত গর্বে ঢাকা পড়ে গেল অতীত গৌরব। অন্তত ৬০০ বছর আগে ঢাকা ছিল স্বাধীন সুলতানি বাংলার অন্যতম প্রদেশ অর্থাৎ ইকলিম মুবারকাবাদের রাজধানী। সেসব তথ্য গবেষণা প্রবন্ধে ও গ্রন্থে একযুগ আগেই মুদ্রিত হয়েছে। খোদ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাপিডিয়াতে মধ্যযুগের বাংলার অনন্যসাধারণ বিশেষজ্ঞ আবদুল করিম ঢাকার ইতিহাস লিখতে গিয়ে নগর ঢাকার এই প্রাচীনত্বের কথা উল্লেখ করছেন।

৪০০ বছরের প্রাচীন জেনেই আমরা ঢাকা নগরীকে নিয়ে গর্ব করি। কারণ এই হিসেবেই ঢাকা প্রাচ্যের প্রাচীনতম নগরী। আর এ হিসেব যদি আরও কয়েকশ বছর পিছিয়ে যায় তবে ঐতিহ্যের অহংকার আরও কত উজ্জ্বল হয়! সাম্প্রতিক গবেষণায় এই ঐতিহাসিকতা আরও স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসচর্চা বিচ্ছিন্ন আধিপত্যবাদী ইতিহাস বণিকরা নিজেদের গড়া অচলায়তন থেকে নামতে চান না। দ্বিধা করেননি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে।

এতসব অস্বস্তি ও বিভ্রান্তির মূলে রয়েছে নীতিনির্ধারকদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যচর্চায় দুর্বল অবস্থান। ইতিহাসচর্চা করতে বা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে অবদান রাখার আগে ভুলে যাই ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় ও কালভেদে বিশেষজ্ঞ বা গবেষকের রকমভেদ আছে। ইতিহাস বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যে চিকিৎসাবিদ্যার বিশেষজ্ঞের একটি মিল আছে তা আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। চিকিৎসাবিদ্যায় যেমন একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ হার্ট বা কিডনি বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালন করতে পারেন না তেমনি ইতিহাসবিদ্যায়ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বিশেষজ্ঞদের সেই সেই অঞ্চলে ভূমিকা রাখার কথা। মোটা দাগে বলা যায় কেউ প্রাচীন বাংলার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ, কেউ মধ্যযুগের আবার কেউ ঔপনিবেশিক যুগের। সূক্ষ্ম দাগে বিশেষজ্ঞপর্যায়ে যুক্ত হয় বিভিন্ন যুগপর্বের শিল্প ইতিহাস, সমাজ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, স্থাপত্যকলা বা ভাস্কর্য শিল্পের বিশেষজ্ঞ। এর ব্যতিক্রম হলেই বাধে অনর্থ। যেমনটি স্পষ্ট করার প্রয়াস রয়েছে বর্ণিত খণ্ডচিত্রগুলোতে।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর