দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগোষ্ঠীর বড় অংশই এখন ৩০-এর মধ্যে। অর্থাৎ জনগোষ্ঠীর বয়স ধরে হিসাব করলে তারুণ্যই সেখানে বড় গোষ্ঠী। তাই স্বভাবতই সেখানে একশ্রেণির তরুণের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা তরুণদের চিন্তাধারার সঙ্গে যায় এমন রাজনৈতিক দল গঠনের একটি আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি, প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান ও নৃতাত্ত্বিক ধারা সব মিলিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। কর্মক্ষম থাকছে মানুষ বেশি বয়স অবধি। যার ফলে মোট জনসংখ্যার কমসংখ্যক হলেও সেখানে বয়স্করাই বেশিসংখ্যক রাজনৈতিক নেতৃত্বে। তরুণরা ওইভাবে নীতিনির্ধারণের পর্যায়ে যেতে পারছে না। তাদের ভিন্ন চিন্তা, বর্তমান সময়ের চিন্তা, তারা তাদের নিজ দেশের রাজনীতিতে খুঁজে পাচ্ছে না।
যে কারণে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে তরুণরা রাজনৈতিক দল তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে পাঁচ-সাত বছর ধরে। এ কাজে তারা যে খুব সফল হচ্ছে তা অবশ্য নয়। প্রথমত, এসব তরুণ শহরবাসী। তাই তারা শহর এলাকা ছাড়া তাদের সমর্থন গ্রাম অবধি নিতে পারছে না। তা ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার মতোই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তরুণ জনগোষ্ঠীতে প্রযুক্তি একটি বড় ধরনের বিভক্তি এনে দিয়েছে। অধিক প্রযুক্তির সুবিধা পাওয়ায় শহরের সংগতিপূর্ণ তরুণরা পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ অনেক অগ্রগতির সঙ্গে পরিচিত। তারা তাদের চিন্তাভাবনাকে ওই পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
অপরদিকে গ্রামের তরুণরা প্রযুক্তি শিক্ষাসহ সব ধরনের শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকায় স্বভাবতই পিছিয়ে পড়েছে শহরের তরুণদের থেকে। যে কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শহরবাসী যেসব তরুণ রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে বা করছে, তারা শহরের বাইরে গ্রামের তরুণদের কাছে ওইভাবে পৌঁছাতে পারছে না। তবে তারপরেও এ মুহূর্তে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে বেশ কিছু দিক সামনে আসে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সে দেশের সরকার কোভিড-১৯ ম্যানেজমেন্টে ব্যর্থ হচ্ছে।
আর এর ফলে ওই সব দেশের তরুণসমাজসহ সব মানুষের ভেতর হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। তাতে কোভিড-উত্তর রাজনীতিতে এই তরুণদের দলগুলো ভালো ফল দেখাতে পারে। তা ওই সব দেশের সরকারও বুঝতে পারছে। তা ছাড়া এসব দেশের সরকারগুলো শুরু থেকেই তরুণদের রাজনৈতিক দল গঠনের পথে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে আসছে। যেমন শুরু থেকেই কোভিড-১৯ ম্যানেজমেন্ট নিয়ে বারবার ব্যর্থ ও সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা মালয়েশিয়া সরকার সবকিছুতে ভয় পাচ্ছে। যার ফলে তাদের দেশে তরুণদের সৃষ্ট রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘মালয়েশিয়ান ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স’ (এমইউডিএ)-এর রাজনৈতিক দল গঠনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। তারা নীতি অনুযায়ী সে দেশের হোম মিনিস্ট্রিতে এ আবেদন করেছিল। তবে তারপরেও এমইউডিএর নেতা সৈয়দ আবদুল রহমান মোটেই আশাহত নন। তারা মনে করছেন, রাজনীতিতে এগিয়ে যাবে।
কারণ, মালয়েশিয়ার সরকার ও বড় রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয়েস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) সব সময়ই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেয়। এর বদলে এমইউডিএ ধর্মও গোত্রের ভেদ না করে সব জনগোষ্ঠীকে সমান প্রাধান্য দেবে; এবং এই তরুণ মনে করে মালয়েশিয়ায় বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির বিপরীতে তারা সৎ রাজনীতি দাঁড় করাতে পারবে।
মালয়েশিয়ার মতো ইন্দোনেশিয়াতে ৩৯ বছর বয়স্ক সাবেক সাংবাদিক গ্রেস ন্যাটালি ২০১৪ সালে ইন্দোনেশিয়া সলিডারিটি পার্টি (পিআইএস) গঠন করেন।
২০১৯ সালে তার দল ভোটে অংশ নিয়ে ১ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পায়। তবে বর্তমানে তার দল রাজধানী জার্কাতায় ইন্দোনেশিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ স্ট্রাগলের (পিডিআই) পরেই জনপ্রিয়। উল্লেখ্য, পিডিআইয়ের দীর্ঘদিন নেতৃত্বে ছিলেন সে দেশের জাতির জনক সুকর্ণের কন্যা মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী। অবশ্য এ মুহূর্তে পিআইএসের নেতা গ্রেস মনে করছেন, ইন্দোনেশিয়ার কোভিড ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতা এবং অন্যান্য দলের নেতৃত্বের ধরনের কারণে তারা আগামী নির্বাচনে আরও ভালো করবেন। কারণ, অন্যান্য দলে দলীয় সবার কথা শুনে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে তার দল তরুণদের দল হলেও তরুণ ও বয়স্ক সব নেতৃত্ব ও কর্মীর মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ইন্দোনেশিয়ায় গ্রেস নির্বিঘ্নে রাজনীতি করতে পারলেও মালয়েশিয়ার এমইউডিয়ের মতো থাইল্যান্ডের মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির (এমএফপি) ৪০ বছর বয়স্ক নেতা পিটা লিমজারোনরটের রাজনীতিতে বাধা দিচ্ছে সে দেশের সরকার। তার দল ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি নামে ২০১৯-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৫০০ সিটের মধ্যে ৮১টি সিট পেয়েছিল। ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি সে দেশের সরকার বিলুপ্ত করে দেয়। এখন এমএফপি ওই ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টির উত্তরাধিকার হিসেবে ৫৩টি আসন এবং সত্যিকার অর্থে থাই পার্লামেন্টে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিতে পেরেছে। সাউথ ইস্ট এশিয়া নিয়ে কাজ করেন সিডনি ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক মনে করেন, থাই তরুণদের মধ্যে এ রাজনৈতিক দল অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। এমএফপি নেতারাও হতাশ নন। তারা তাদের দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করেই এগোতে চান। তারা শহর থেকে তাদের সমর্থন গ্রামেও নিয়ে যেতে চান।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠীতেও তারুণ্যের সংখ্যা বেশি। তবে এখানে নেপালে একটা সময়ে কমিউনিস্টদের মধ্যে তরুণ নেতা থাকলেও এখন সব দলই বয়স্ক নেতৃত্বভারে ন্যুব্জ। শ্রীলঙ্কায় দুই ভাই-ই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেখানে তারুণ্য বা বয়সকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। পাকিস্তানে নেওয়াজের মুসলিম লীগে তার মেয়ে তরুণী এবং পিপলস পার্টি নেতা বিলাওয়েল ভুট্টোও তরুণ। তবে সে দেশের রাজনীতিতে আধুনিকতা ও তারুণ্য কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। গুরুত্ব পাচ্ছে ধর্ম। এই তরুণ নেতারা বয়সভারে ন্যুব্জ এক ধর্মীয় নেতার নেতৃত্বেই রাজনীতি করছে।
অপরদিকে ইমরান সে দেশের সামরিক বাহিনীর একজন পুতুলমাত্র। দক্ষিণ এশিয়ার বড় দেশ ভারত বিজেপির ধর্মীয় রাজনীতি দিয়ে শাসিত। তারা তারুণ্যর আধুনিক উদার চিন্তাও ভারতের সব ধর্ম-বর্ণের মধ্যে যে বৈচিত্র্যের মিলনের ঐতিহ্য তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে না। অপরদিকে এর বিপরীতে কোনো তারুণ্যের দল নেই। পরিবর্তনের জন্য যে জোটের কথা শোনা যাচ্ছে তার নেতৃত্বে মুখ হিসেবে তিনজনের নাম এসেছে।
এক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই, শারদ পাওয়ার। তিন, মায়াবতী। বাস্তবে তিনজনের কেউই পরিবর্তন ও আধুনিক রাজনীতির কেউ নন। মমতা নিজ প্রদেশ ১০ বছর শাসন করে উপহার দিয়েছেন দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিল্প-কলকারখানাশূন্যতা ও সন্ত্রাস। তিনি ভারতের মুখ হলে ভারতের যে অধোগতিই হবে, তার প্রমাণ ইতোমধ্যে স্পষ্ট। অপরদিকে, শারদ পাওয়ার এখন বয়সের ভারে পীড়িত। মায়াবতীর রাজনীতি নিম্নবর্ণের সুবিধা আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই ভারতেও মূল জনসংখ্যার বেশি তরুণ হলেও সেখানে তারুণ্যের কোনো মুখপত্র নেই।
বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক দল বলতে সব থেকে বড় অবস্থানে আছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে গত ১০ বছর ধরে তরুণদের আনা হচ্ছে। যদিও এই নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে পছন্দের ভিত্তিতে, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়। অবশ্য এখানে দলের মূল নেতা প্রধানমন্ত্রীর সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় প্রযুক্তিনির্ভর দেশ গড়ার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তারপরেও ভোটের রাজনীতির কারণে গত পাঁচ বছর দলটি হেফাজতের মতো একটি মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে নানান ক্ষেত্রে বারবার আপস করছে। যার ফলে আধুনিকতা ও তারুণ্যের চিন্তা সেখানে কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে বিএনপি একসময়ে বড় রাজনৈতিক দল ছিল ঠিকই। কিন্তু সামরিক বাহিনী থেকে আসা এই দলটি সত্যিকার অর্থে রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেনি কখনও। সব সময়ই মৌলবাদ ও স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এখন দলটি স্থবির।
একসময়ের বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি এখন অনেকটা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ফেসবুকনির্ভর দল। একসময়ে যে দলটিতে অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলের থেকে বইচর্চা সব থেকে বেশি ছিল, সেই দল এখন বুকচর্চার বদলে ফেসবুকচর্চাতেই চলছে। আর মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ফেসবুকে প্রায়ই দেখা যায় প্রবীণ কোনো কমিউনিস্ট নেতার প্রয়াণের জন্য শোক প্রকাশ। এই কোভিডে মাস্ক বিতরণের কর্মসূচিও সেখানে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের এ অবস্থার ভেতরে যদি জনসংখ্যার বয়স অনুযায়ী সারণির দিকে তাকানো হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে দেশের ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১০ হাজার মানুষের ৫৪ দশমিক ৯ শতাংশ ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও তারুণ্যনির্ভর একটি দেশ। তাই স্বভাবতই এই তারুণ্যের একটি শ্রেণি অবশ্যই আধুনিক ও সব ধরনের ধর্মীয় ও গোত্রের কূপমণ্ডূকতার বাইরে আসবে; এবং তারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল স্প্রিট, অর্থাৎ আধুনিকতা ও জয় বাংলার তেজস্বীতায় বলীয়ান। তাই স্বাভাবিকভাবে এই তরুণদের একটি প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ দাবি করে।
বাংলাদেশের সরকারি দলের চরিত্র থেকে বোঝা যায়, তারা মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের মতো কখনোই এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠতে গেলে বাধা দেবে না। বাংলাদেশের আধুনিক তরুণরা যখন ২০১২ সালে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে গোটা দেশের মানুষের একটি বড় অংশের মুখে জয় বাংলা ধ্বনি তুলে দিয়েছিল। তখন কিন্তু এ সরকার তাদের স্বাগতই জানিয়েছিল।
আর আজ যে সময়ে ভোটের রাজনীতি ও ক্ষমতার রাজনীতির কারণে সরকারকে মৌলবাদীদের সঙ্গে, ধর্মের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে, সে সময়ে একটি আধুনিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে ওঠা দেশের আধুনিকতার জন্য জরুরি।
তারা থাইল্যান্ডের পার্লামেন্টের মতো বাংলাদেশের পার্লামেন্টে ৫৩টি না হোক ৩০টি সিট নিয়ে যাক। তাতেও ক্ষতি নেই। তারপরেও দেশের পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র আধুনিকতার একটি ধ্বনি এ মুহূর্তে একান্ত প্রয়োজন। আর তরুণদের এ ধরনের একটি আধুনিক দল হলে অবশ্যই দেশে তরুণরা বর্তমানে যে মৌলবাদের দিকে বেশি ঝুঁকছে, এটা কমে যাবে। দেশকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিতে যা হবে একটি বড় পদক্ষেপ।