বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভূমধ্যসাগরে স্বপ্নের সলিল সমাধি 

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ৩০ জুলাই, ২০২১ ১৫:৩৮

এর আগে থাইল্যান্ডের এক জঙ্গলে অবৈধভাবে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের গণকবর পাওয়া গিয়েছিল। মালিকরা দাসের মতো ব্যবহার করে একসময় তাদের গণকবর দিয়ে রেখেছিল। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ কাজের আশায় নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে সাগরে ডুবে মরছে। কতটা বিপন্ন হলে যুদ্ধবিধস্ত সিরিয়ার মানুষের সঙ্গে এক হয়ে ইউরোপে একজন মানুষ কাজের সন্ধানে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা পোষণ করে?

করোনা ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কারণে বর্তমানে অন্য সব খবর গৌণ হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমজুড়ে আপাতত করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে সৃষ্ট দুর্যোগের খবর। এর মধ্যে ঈদের দিন ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে অন্তত ১৭ বাংলাদেশি অভিবাসীর মৃত্যুর খবরটি খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। অথচ এটিও আমাদের দেশের জন্য আরেকটি বিয়োগান্ত ঘটনা।

মূলত এই অভিবাসীরা ভাগ্যের অন্বেষণে অবৈধভাবে নৌকায় করে লিবিয়ার জুয়ারা থেকে ইউরোপের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। প্রশ্ন হলো, উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ খেতাব পাওয়া একটি দেশের নাগরিকরা কেন অবৈধভাবে পাড়ি দিতে গিয়ে ভিনদেশের সাগরে ডুবে মরবে? সেকি কেবলই প্রলোভন? টাকা বানানোর নেশা? উন্নত জীবনের স্বপ্ন? নাকি দেশে কোনো কিছু করতে না পেরে ভিনদেশে কিছু একটা করার তাড়নায়? এ প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজা দরকার।

বাংলাদেশের শত শত নাগরিক টাকা উপার্জনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপ-আমেরিকা পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে। আর তাদের কাউকে কাউকে ভূমধ্যসাগরের জলে ডুবে মরতে হচ্ছে! ইউরোপ-আমেরিকা তো নয়, এ যেন এক ভয়ংকর মৃত্যুপথযাত্রা! গহিন অরণ্য, গভীর সমুদ্র, তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ভয়ংকর স্বপ্নযাত্রায় পা রাখছে অনেক বেকার যুবক। ভয়ংকর এই স্বপ্নযাত্রায় সর্বস্ব বিক্রি করে দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছে টাকা-পয়সাসহ পরিবারের শেষ সম্বল।

কেউ কেউ অবৈধ পথে স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছাতে পারলেও অধিকাংশই হয় ভাগ্যাহত। ভাগ্য সহায় হলে অনেকের জায়গা হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। বাকিদের কারো কারো সলিল সমাধি হয় নৌকাডুবিতে। কেউ প্রাণ হারায় অনাহারে অর্ধাহারে, নানা রোগ-শোকে। তারপরও জীবনবাজি রেখে মৃত্যুকে হাতে নিয়ে এক মরীচিকার পেছনে ছুটছে হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ। তারা যেতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশে। তবে যে উন্নত জীবনের টানে তারা ধাবিত হয় সেসব দেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই নেশা পাওয়া এই যুবকদের। তারা যা শোনে তা সবই লোকমুখে এবং দালালদের কাছ থেকে।

উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপ যেতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়া ট্রানজিট দেশ লিবিয়া। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পথ আরও কঠিন। কিন্তু জীবনের সর্বস্ব বাজি রাখা এই বেকার তরুণরা উন্নত জীবনের জন্য মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে অবৈধ পথে পৌঁছাতে চায় স্বপ্নের দেশে। এ জন্য তাদের পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ কয়েক হাজার মাইল পথ। প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাই। দুবাই থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ব্রাজিল।

এরপর বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা সিটি, মেক্সিকো হয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে, সমুদ্রপথ পেরিয়ে, পায়ে হেঁটে শেষ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের স্যান সিদ্রো বর্ডার দিয়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে। তবে অধিকাংশই সেখানে গিয়ে ধরা পড়ে। এই দীর্ঘ যাত্রার পর মার্কিন মুলুকের জেল থেকে শূন্যহাতে তাদের ফিরতে হয়। তবে যারা প্রাণে বেঁচে যায় কেবল তারাই ফিরে আসে। অন্যদের পথেই মৃত্যু হয়।

প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষ। কেউ যাচ্ছে বৈধ পথে, কেউবা অবৈধ উপায়ে। অবৈধ উপায়ে দালাল ধরে যারা বিদেশে যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যায়। গত ২৪ জুন ভূমধ্যসাগর থেকে বাংলাদেশি, মিসরীয়সহ মোট ২৬৭ জনকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। তাদের মধ্যে ২৬৪ জনই ছিলেন বাংলাদেশি। বাকি তিনজন মিসরের নাগরিক। তারা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালির পথে রওনা হয়েছিলেন।

এর আগে ১০ জুন ১৬৪ বাংলাদেশিকে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করে দেশটির কোস্টগার্ড। তারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তার আগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় গত ১৮ মে ৩৬ এবং ২৭ ও ২৮ মে উপকূল থেকে ২৪৩ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। এ ছাড়া মে মাসে লিবিয়ার অবৈধ অভিবাসন দমন বিভাগের (ডিসিআইএম) কর্মকর্তারা আলজেরিয়ার সীমান্তবর্তী মরু এলাকা দারাসে অপহরণকারীদের কবল থেকে ৮৬ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেন। তারা বেনগাজি হয়ে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার পথে অপহরণকারীদের কবলে পড়েছিলেন।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) তথ্য মতে, গত ১০ বছরে সমুদ্রপথে বিদেশ যেতে বাংলাদেশি নিহত বা নিখোঁজ হয়েছে ১০ হাজার। পাচার হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ। আর বিদেশি কারাগারে বাংলাদেশি বন্দি রয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি। তবুও বিদেশ যাত্রা ‘নাহি মানে পরাভব!’

বাংলাদেশে অবৈধভাবে বিদেশ যাত্রার হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রশ্ন হলো টাকা রোজগার করতে গিয়ে বিদেশে ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার পরও কেন বাংলাদেশিরা এভাবে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ইউরোপ পাড়ি দিতে চাচ্ছে? বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। শুধু উন্নত জীবনের নেশা, বড়লোক হওয়ার বাসনা, টাকা কামাই করার মোহ থেকেই যে সবাই বিদেশ যায় বা যেতে চায় তা সম্ভবত সবটুকু সত্য নয়।

এর জন্য দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও কম দায়ী নয়। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নানা চটকদার কথায় দেশের শনৈঃ শনৈঃ উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অনেক উন্নত দেশকে ছুঁয়ে ফেলবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। প্রশ্ন হলো, গরিব ও বেকারদের তাতে কী লাভ? দেশে কি উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে? কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে? মানুষের জীবিকা নির্বাহের ন্যূনতম সুযোগের প্রসার ঘটছে? তা যদি না হয়, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের সমান হলেই কী? কাজ ও উপার্জনের আশায় যদি বিদেশযাত্রা না কমে, যদি কাজের স্বপ্নকে ধরতে করুণ অপমৃত্যুতেই লেখা হয় জীবনের শেষ অধ্যায়, তাহলে আর কীসের উন্নয়ন?

এর আগে থাইল্যান্ডের এক জঙ্গলে অবৈধভাবে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের গণকবর পাওয়া গিয়েছিল। মালিকরা দাসের মতো ব্যবহার করে একসময় তাদের গণকবর দিয়ে রেখেছিল। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ কাজের আশায় নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে সাগরে ডুবে মরছে। কতটা বিপন্ন হলে যুদ্ধবিধস্ত সিরিয়ার মানুষের সঙ্গে এক হয়ে ইউরোপে একজন মানুষ কাজের সন্ধানে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা পোষণ করে?

মনে রাখতে হবে যে, মানুষ খুব একটা দায়ে না পড়লে নিজস্ব বাড়িঘর, পরিবেশ, আত্মীয়-স্বজন, ভাষা-সংস্কৃতি ছেড়ে বিদেশ যেতে চায় না। যারা যায়, নিতান্ত দায়ে পড়েই যায়। দেশে কাজ থাকলে কেউ কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে কিংবা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় না। অভিবাসী কর্মজীবীদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়।

বিদেশে উপযুক্ত ও পছন্দনীয় চাকরি পাওয়া কঠিন; চাকরির নিরাপত্তা থাকে না; কর্মজীবন কষ্টদায়ক, অনেক ক্ষেত্রে অমর্যাদাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়; মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়; বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতনের শিকারও হতে হয়; বৈধ কাগজপত্রের অভাবে বিবেকহীন নিয়োগকারীরা সুযোগ নেয়; কম বেতনে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে নিয়োগকারীরা জবরদস্তি করে এবং যেকোনো অজুহাতে কর্মচ্যুত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। এর পরও বেশি উপার্জনের আশায় মানুষ নিজদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।

সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে কাজ নেই। আয়-রোজগারের ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের চাকরির বাজার এখনও সংকীর্ণ। লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার কাজের আশায় পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাজার হাজার তরুণ নিজেদের শেষ সম্বলটুকু দালালের হাতে দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে?

জীবিকার সন্ধানে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে সাগরে, মরুভূমিতে বা জঙ্গলে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আর যারা বেঁচে আছে তারা বিভিন্ন দেশে ফেরারি আসামি হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। হয়ত এক জীবনে তাদের মা-বাবা বা প্রিয় মানুষের মুখটি আর দেখা হবে না। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রচুর শিক্ষিত তরুণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেট্রল পাম্প, দোকান এবং বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে শত কষ্ট সহ্য করেও কাজ করে যাচ্ছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও কি জাতি হিসেবে আমরা পশ্চাৎপদ রয়ে গেলাম? দেশের তরুণদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়, বাংলাদেশে কোনো ভবিষ্যৎ নেই, সুযোগ পেলেই দেশের বাইরে চলে যাব। এখন সরকারের দায়িত্ব দেশে চাকরির বাজার সৃষ্টি করা এবং কর্মসংস্থান বাড়ানো। এ জন্য দরকার পরিকল্পিত উদ্যোগ। শুধু প্রবৃদ্ধি আর অবকাঠামোগত ‘কসমেটিক উন্নয়ন’ নয়, প্রকৃতপক্ষে দেশের বেকার যুবাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ। সিঙ্গাপুর যদি ‘জেলেদের গ্রাম’ থেকে আজ সেরা মেগা-সিটি এবং পুঁজি বিনিয়োগের জন্য বিশ্বের সেরা দেশগুলোর একটি হতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারবে না?

আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে গরিব মানুষকে বিদেশে মজুরি খাটতে পাঠানো, আর নামমাত্র পারিশ্রমিকে মেয়েদের গার্মেন্টসে খাটানো। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের দেশে এখন বেঁচে থাকাটাই বড় পাওয়া। ভালোভাবে বেঁচে থাকাটা বিলাসিতা। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? বালুতে মুখ গুঁজে আর উন্নয়নের ফাঁপা আওয়াজ শুনিয়ে দেশের মানুষকে আর কতদিন ভুলিয়ে রাখা যাবে?

লেখক: প্রাবন্ধিক-কলাম লেখক, সাবেক ছাত্রনেতা

এ বিভাগের আরো খবর