বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ক্ষুধার রাজ্যে মুখেন্দ্রদের মুখচ্ছবির আধিক্য!

  • ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল   
  • ৩০ জুলাই, ২০২১ ১২:৫৪

ট্যাক্সের টাকায় এই দেশটা চালায় সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব ও সাধারণ মানুষ। দেশের ট্যাক্স ফাঁকি দেয় বড়লোক, বড় আয়ের চাকরিজীবী আর ক্ষমতাসীনরা। আর গরিবরাই রাষ্ট্রের কোষাগার ভরে। আর সেই কোষাগার কেন গরিবের প্রয়োজনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হবে না?

আমাদের মেয়েটা মাঝে মাঝে খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করলে আমি ওর মাকে বলি, জোর করো না, ক্ষুধা জিনিসটা একটু বুঝুক। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের একটা বড় অংশই ক্ষুধার সঙ্গে পরিচিত নয়। তারা পরিচিত বাহারি মন ভোলানো খাবার আর বিজ্ঞাপনে।

সম্ভবত ২০০৪/০৫ সালের কথা। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পড়াশুনা করি। ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত আর মূল দল সিপিবির সঙ্গেও জড়িত। যাহোক সেসময় বাংলা ভাইয়ের উত্থান হয়েছে বাগমারা অঞ্চলে। আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে সেসময় রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে পার্টির ঝটিকা সফর ও সমাবেশ চলছিল। আমরা রাজশাহী শহরে সমাবেশ শেষ করে দূর্গাপুরে সমাবেশ করছিলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় সমাবেশ শেষ হবার পর আমাদের যাত্রা ছিল বাগমারার উদ্দেশে, কারণ পরের দিন বাগমারায় বাংলা ভাইয়ের এলাকাতেই আমাদের সমাবেশ ছিল। দূর্গাপুর থেকে একটা নসিমনে চেপে আমরা ১০/১৫ জন ভলান্টিয়ার সেদিন প্রায় গভীর রাতে বাগমারার বিল কালাইয়ের ধারে আক্কাস ভাইয়ের বাড়িতে পৌঁছেছিলাম। গভীর রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। আমরাও বৃষ্টিতে ভিজে, বিল সাঁতরে আক্কাস ভাইয়ের মাটির ঘরে রাতে খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু দেখলাম আক্কাস ভাই গভীর রাতে একটা গামলাতে করে সেমাই নিয়ে আসছেন। সেমাই দেখে আমাদের মনটা এত খারাপ হয়ে গেল যে সারা দিন অমানবিক পরিশ্রমের পর শুধু এই সেমাই খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার কথা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল।

যাহোক, গরিব কমরেড যেটাই আয়োজন করেছেন সেটাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব এই ছিল আমাদের চিন্তা। সে মোতাবেক ঘুমানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টির পর ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে ভেসে এলো গরম ভাতের একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ, আহা! মনটা একদম চনমন করে উঠল। আক্কাস ভাই দরজা দিয়ে একটা বিশাল ভাতের গামলা নিয়ে ঢুকছেন যা থেকে ভাপ উঠছে। আমরা আলু ভর্তা, ডাল দিয়ে পেটপুরে খেয়ে খুশি মনে ঘুমাতে গেলাম। শুধু এটাই বলতে চাই আমার জীবনের সবচেয়ে তৃপ্তি করে খাওয়ার তালিকা করলে এই দিনটি প্রথম স্থান অর্জন করবে। আমি সেদিন ক্ষুধাটা একদম মরমে অনুধাবন করেছিলাম।

বিগত প্রায় দেড় বছর আমরা একটা অতিমারির ভেতর দিয়ে আমাদের জীবন অতিবাহিত করছি। এই দেড় বছরে আমি ও আমরা অসংখ্য শ্রেণিপেশার মানুষের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমি ঢাকা শহরের নিম্ন আয়ের মানুষদের নিয়ে মূলত কাজ করি। তাদের জীবনের সংকটটাই আমি সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছি এসময়। কদিন আগে আমি মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানের একটা বস্তিতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম এক ভয়াবহ চিত্র। একদিকে লকডাউনে মানুষের নিদারুণ অভাব, অপরদিকে বস্তিকে কেন্দ্র করে চলছে রমরমা মাদক ব্যবসা, মাদকের সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত হয়ে গেছে কারণ তাদের এ সময়ে কোনো কাজ নেই। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছি একজন প্রতিবন্ধি কিশোরী, যে কিনা আমাদের বিভিন্ন মিটিংয়ে আসত, তাকে আমরা ভাতার ব্যবস্থা করে দেয়ার চেষ্টাও করেছিলাম। সেও এখন মাদকাসক্ত, এমনকি একজন বলল যে, সে ভিন্ন পেশায়ও যুক্ত হয়েছে।

আমি আসলে লেখাটা শুরু করতে চাচ্ছি গত ২৫ জুলাই কামারাঙ্গীরচরের নওয়াগাও এলাকায় ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনাকে স্মরণ করে। স্ত্রী ফুলবাসী রানি (৩৫) ও মেয়ে সুমি রানিকে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করেন মুখেন্দ্রচন্দ্র দাস। প্রাথমিক তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে অভাবের তাড়নায় ও ঋণে জর্জরিত হয়েই নাকি তিনি স্ত্রী সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। সকল পত্রিকায় বেশ ফলাও করে সংবাদটি প্রচারিত হয়।

কামরাঙ্গীরচর থানার ওসির বরাদ দিয়ে কিছু বক্তব্য গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়েছে। মুখেন্দ্রচন্দ্র দাসের অভাব অনটনের সংসার ছিল। তার স্ত্রীর সামান্য স্বর্ণালঙ্কার বিক্রির টাকা তার মামাকে বিদেশে যাবার জন্য দিয়েছিলেন কিন্তু সে টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি লকডাউনে তার জীবনে অভাব অনটন আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। বাজার থেকে ছারপোকা মারার বিষ এনে নিজেও পান করেছিল মুখেন্দ্র, কিন্তু বিষক্রিয়ায় তিনি মারা যাননি। এখন আমার প্রশ্ন হলো মুখেন্দ্র কেন হত্যাকারী হলো? সে কেন তার প্রিয়তম স্ত্রী ও সন্তানকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করল? অভাব ও ক্ষুধার তাড়নায়?

সরকার থেকে ঘোষণা আসে, গরিব ও সাধারণ মানুষদের জন্য তাদের সকল উন্নয়ন উদ্যোগ। মেহনতি মানুষের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছেন এবং তারা এ কাজ করেই ছাড়বেন। তাদের সবল প্রচারে এই মূল আলাপটা আমরা দেখে থাকি। কিন্তু সম্প্রতি এই করোনা অতিমারিতে যে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন সেসবের দিকে কি তাদের নজর রয়েছে? করোনা অতিমারির শুরু থেকে সরকার বিভিন্ন মেয়াদে বিশাল অংকের অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। কিন্তু সেই অর্থ কোথায় গেল? ব্যবসায়ীরা কতটা পেলেন? দলীয় নেতাকর্মীরা কতটা পেলেন? আমলারা পেলেন কতটা? এই প্রশ্নগুলো খুব সহজেই আমাদের সামনে হাজির হয়।

সম্প্রতি একই ধরনের বেশ কিছু ঘটনা আমাদের গণমাধ্যমে দেখেছি। বিশেষ করে অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা। করোনা মহামারির শুরুর দিকে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের মাঝে একটি সাধারণ গবেষণা করেছিলাম যার থেকে দেখেছি যে নিম্ন আয়ের প্রায় শতভাগ মানুষ এই অতিমারিতে ঋণগ্রস্ত হয়েছে। সে ঋণের পরিমাণ ২ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত। এই ঋণের যন্ত্রণায় হাজার হাজার মানুষ ঢাকা শহর ছেড়েছে, পেশা পাল্টেছে, পরিচয় পাল্টেছে। ঢাকা শহরে প্রায় ৪০ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষ যাদের একটি বড় অংশ বস্তিবাসী ও ভাসমান।

তাদের একেকটা দিন শুরু হয় শূন্যহাত ও শূন্যপেট নিয়ে। লকডাউনে যে হকাররা এখনও পুলিশের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলে তাদের অধিকাংশ এই নিম্ন আয়ের ভাসমান মানুষ। যারা একটা দিন আয় না করলে তাদের সংসার চলে না। ঈদের ৫/৭ দিন আগে বস্তির কয়েকজন ফোন করল, ভাই যদি একটা গরু ম্যানেজ করে দেন তো কাজ করে কিছু টাকা আর মাংস পেতাম। আবার কেউ ফোন করে বলেন, ভাই দেখেন না কিছু চাল, ডালের ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা বা একদিনের একটা কাজও যদি হয়। প্রতিদিন আমাদের মতো নগণ্য মানুষদের কাছে এমন অসংখ্য ফোন আসে, যদিও আমাদের কিছু করার নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে, আজও আমাদের এই দেশে একজন ফুলবাসীকে কেবল অভাবের তাড়নায় খুন হতে হয়, একজন কিশোরী সুমিকে তার পিতা হত্যা করে অভাবের তাড়নায়। আমরা কত দূর আসলে এগোতে পারলাম? নিশ্চয়ই এই ভয়াবহ অপরাধের শাস্তি মুখেন্দ্র দাসের জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কবে এই হাজার-হাজার ভুখাদের দায়িত্ব নেবে? কেন নেবে না?

ট্যাক্সের টাকায় এই দেশটা চালায় সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব ও সাধারণ মানুষ। দেশের ট্যাক্স ফাঁকি দেয় বড়লোক, বড় আয়ের চাকরিজীবী আর ক্ষমতাসীনরা। আর গরিবরাই রাষ্ট্রের কোষাগার ভরে। আর সেই কোষাগার কেন গরিবের প্রয়োজনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হবে না? আমার সাধারণ কয়েকটি দাবি, রাষ্ট্র আজ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের একটা ডাটাবেজ তৈরি করে তাদের অবস্থা বিবেচনায় রেশনিং দেয়া শুরু করা হোক, তাদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়ে গেল তার একটি ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক, তাদের চিকিৎসাব্যয় বহন করা হোক, তাদের সন্তানদের সকলের শিক্ষাব্যয় মওকুফ করা হোক। আর তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা দরকার। এমন না হলে আমিও একজন নাগরিক হিসেবে ট্যাক্স দিতে আগ্রহী নই। রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব না নেয়, আমরা কেন এমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে যাব!

লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা

এ বিভাগের আরো খবর