বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রাজনৈতিক দোকান বনাম…

  •    
  • ৩০ জুলাই, ২০২১ ১১:২৭

আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের লোকজনের নামে গড়ে ওঠা এসব সংগঠনের অনেকেরই মূল কাজ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ। অর্থাৎ টেলিভিশনে নিজেদের চেহারা দেখানো এবং এর মধ্য দিয়ে নিজেদের ফেসভ্যালু তৈরি করে কোনো না কোনো ধান্ধা করা। এসব সংগঠনের নাম দেখে সাংবাদিকরা অনুষ্ঠানে যেতে না চাইলেও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উপস্থিত থাকেন এবং তারা সমসাময়িক নানা বিষয়ে বক্তব্য দেন— যেখানে খবরের উপাদান থাকে।

‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ হারিয়েছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর নামে একজন ব্যবসায়ী। সর্বশেষ তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছেন। তিনি ‘জয়যাত্রা’ নামে একটি অনলাইন টিভিরও মালিক। সেখানেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা অভিযান চালিয়েছে। সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে শূন্য হওয়া কুমিল্লার আসন থেকে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি।

সম্প্রতি ফেসবুকে নেতা বানানোর ঘোষণা দিয়ে ছবি পোস্ট করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সংগঠনটির জেলা, উপজেলা ও বিদেশি শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। কথিত এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে হেলেনা জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাহবুব মনিরের নাম উল্লেখ করা হয়।

তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়; হেলেনা জাহাঙ্গীরের এই ঘটনার পরে লীগ, বঙ্গবন্ধু, মুজিব, শেখ হাসিনা, জননেত্রী, দেশরত্ন—ইত্যাদি শব্দ যুক্ত সংগঠনগুলোও আলোচনায় আসে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, শুধু লীগযুক্ত সংগঠনই আছে তিন শ’র বেশি।

এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী মোটরচালক লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ ইত্যাদি। কিছু অদ্ভুত নামের সংগঠনও রয়েছে, যেমন ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ, আওয়ামী শিশু লীগ, বাউল লীগ, নাপিত লীগ, ফকির লীগ, প্রবীণ লীগ, নবীন লীগ ইত্যাদি। আবার বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ নামেই রয়েছে চারটি সংগঠন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও লেখক আফসান চৌধুরী ফেসবুকে রসিকতা করে লিখেছেন, ‘আওয়ামী বেকার লীগ বলে কি কিছু আছে? ওটা বাদে কী কী লীগ বাকি আছে জানাবেন।’ সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুলের ফেসবুক স্ট্যাটাসের নিচে একজন লিখেছেন: ‘ভাই আমি একটা আওয়ামী শুভাকাঙ্ক্ষী লীগ করতে চাই। পরামর্শ দেন।’ আরেকজন লিখেছেন: ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে আগাছা পরগাছা মাত্রারিক্ত বেড়ে যায়। ক্ষমতা বাইরে থাকলে সুসংগঠিত সুসংহত থাকে। কেউ হুঙ্কার দেয়ার সাহস পায় না।’

আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের লোকজনের নামে গড়ে ওঠা এসব সংগঠনের অনেকেরই মূল কাজ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ। অর্থাৎ টেলিভিশনে নিজেদের চেহারা দেখানো এবং এর মধ্য দিয়ে নিজেদের ফেসভ্যালু তৈরি করে কোনো না কোনো ধান্ধা করা। এসব সংগঠনের নাম দেখে সাংবাদিকরা অনুষ্ঠানে যেতে না চাইলেও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উপস্থিত থাকেন এবং তারা সমসাময়িক নানা বিষয়ে বক্তব্য দেন— যেখানে খবরের উপাদান থাকে। ফলে অতিথির পরিচয়ের কারণে এসব অনুষ্ঠান টেলিভিশনসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে গুরুত্ব পায়।

প্রশ্ন হলো এসব সংগঠন কী করে গড়ে ওঠে? কেন্দ্রীয় নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ জাতীয় সংগঠনের দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা কি আদৌ সম্ভব? সেই পৃষ্ঠপোষকতা যেসব সময় চাঁদা দিয়ে বা এসব সংগঠনের নেতাদেরকে ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দিয়েই হতে হবে, এমনটি না-ও হতে পারে। এসব সংগঠনের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষকতা হচ্ছে তাদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। ধরা যাক, একটি সংগঠনের নাম ‘বেকার লীগ’। তো এই সংগঠনের আয়োজনে কোনো অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হলেন দলের কোনো সিনিয়র নেতা বা মন্ত্রী। এটিই এই সংগঠনের প্রতি একধরনের স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা। যেদিন এই সংগঠনের কোনো অনুষ্ঠানে দলের সিনিয়র কেউ অংশ নিলেন, সেদিন থেকে এই সংগঠনের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে কোনো বাধা থাকে না—যতক্ষণ না কেউ এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

লীগ, বঙ্গবন্ধু, মুজিব, শেখ হাসিনা, জননেত্রী, দেশরত্ন—ইত্যাদি শব্দ যুক্ত করে শত শত সংগঠন একদিনে গড়ে ওঠেনি। বহু দিন ধরেই এগুলো নিয়ে সমালোচনা আছে। এসব রাজনৈতিক দোকান নিয়ে আগেও গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। তখনও দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এরকম কতটি সংগঠনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো রিপোর্ট এখনও চোখে পড়েনি। সুতরাং এটি ধরেই নেয়া যায় যে, এবারও হেলেনা জাহাঙ্গীর নামে একজন ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ গঠন করে সমালোচিত হওয়া এবং লীগ যুক্ত তিন শ’র বেশি সংগঠন আছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াও বেশ গরম। চাপে পড়ে হোক আর দায় এড়ানোর জন্যই হোক, দলের সিনিয়র নেতারাও এখন বলছেন যে, এসব অননুমোদিত সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী স্বীকৃত সংগঠনের বাইরে কোনো মনগড়া বা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সংগঠনকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে, তার নাম ভাঙিয়ে রাজনীতির দোকান খুলে বসেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম-ছবি ব্যবহার করে কোনো রাজনৈতিক দোকান খোলা যাবে না।

বাস্তবতা হলো, এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ যারা এসব সংগঠন গড়ে তুলেছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন দলকে সহযোগিতা করেন। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে হয়তো এসব সংগঠন বা এসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত লোকজনকে পাত্তা না দিলেও চলে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকলে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে রাজনীতির মাঠে আন্দোলন সংগ্রাম এবং ভোটের মাঠে কাজে লাগবে। এখন যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে আর আওয়ামী লীগের ‘পকেটে’ থাকবে না। এত বড় একটি জনগোষ্ঠীকে কেন ক্ষমতাসীনরা পকেট থেকে বের করে দেবে?

তাছাড়া এসব দোকান আছে বলেই দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকে প্রতিনিয়ত টেলিভিশনে নিজেদের মুখ দেখানোর সুযোগ পান। কারণ আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলো প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে না। করলেও সেখানে সকল স্তরের নেতার পক্ষে মঞ্চে উপস্থিত থাকা বা প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এসব অননুমোদিত কিংবা ভুইফোঁড় অথবা রাজনৈতিক দোকান আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে অন্তত বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ থাকে। টেলিভিশনের চেহারা দেখানোর সম্ভাবনা থাকে। যা দিয়ে তারা নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াতে পারেন। দলের ভেতরে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারেন। সুতরাং এসব সংগঠনকে সিনিয়র দোকান কিংবা ভুঁইফোড় যা-ই বলা হোক না কেন, আদতে এর দ্বারা সব পক্ষই লাভবান হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। সেই হিসেবে লীগ, বঙ্গবন্ধু, মুজিব, শেখ হাসিনা, জননেত্রী, দেশরত্ন— ইত্যাদি শব্দ যুক্ত করে কোনো সংগঠন গড়ে তোলা বেআইনি নয়, যদি না মূল দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগের তরফে সাংগঠনিকভাবে কোনো বিধিনিষেধ থাকে। কিন্তু এসব আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে সংগঠন গড়ে তুলে যদি এর নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি করেন, টেন্ডারবাজি করেন, ধান্ধাবাজি করেন, মাস্তানি করেন, জমি দখল করেন, তাহলে এর দায় মূল দলকেই নিতে হবে। আরও স্পষ্ট করে বললে যেসব কেন্দ্রীয় নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় এসব সংগঠন গড়ে উঠেছে অথবা যারা এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নেন, তাদের নিতে হবে।

প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। আরও অনেক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে কয়টি সংগঠনের নাম দেশের মানুষ জানে? তাদের কাজটা কী? দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা কী? তাদের কত শতাংশ ভোট আছে? সুতরাং শুধু লীগ, বঙ্গবন্ধু, মুজিব, শেখ হাসিনা, জননেত্রী, দেশরত্ন— ইত্যাদি শব্দ যুক্ত সংগঠনগুলো কী করছে, সেটি জানা যেমন জরুরি, তেমনি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অপরিচিত দলগুলোর কার্যক্রম নিয়েও অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর