একসময় আমরা মিডিয়ায় অনেক বড় বড় হেডলাইনে, লাল-নীল কালিতে খবর পড়তাম, এ বছর শীতে মারা গেল এত জন। কোথায় মারা গেলেন এত এত মানুষ।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খবর আসত উত্তরবঙ্গ থেকে (কেউ আবার আহত হবেন না যেন! সব বঙ্গেই এ রকম মানুষ আছেন)। শীতাক্রান্ত হয়ে কোথায় মারা যাচ্ছে মানুষ? জীর্ণ কুটিরে কিংবা পথে ঘাটে।
একইসঙ্গে আমরা দেখতাম এলাকায় এলাকায় অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহ অভিযান। কাদের দেয়া হবে, যাদের শীতবস্ত্র নেই তাদের। মনে স্বভাবতই তখন প্রশ্ন জাগত তাহলে কি শীতে মানুষ মারা যাচ্ছে না শীতবস্ত্রের অভাবে? অর্থাৎ গরম জামা-কাপড় না থাকার কারণে মানুষ নানারকম ঠান্ডাজনিত রোগ বা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন। তার মানে শীত প্রতিবছর আসবে, প্রতি বছর যাবে, কিন্তু শীত প্রতিরোধ-উপযোগী মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং জামাকাপড় না থাকার কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে।
তেমনি অভিভাবকের মুখে প্রায়ই আমরা শুনি, বাচ্চার জুতো ছোট হয়ে যাচ্ছে, পরিধেয় জামা-কাপড় ছোট হয়ে যাচ্ছে! আসলেই কি তাই? জুতো আর জামা-কাপড় ছোট হয়, না বাচ্চারা শারীরবৃত্তিক কোষের ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়ার কারণে দ্রুত বড় হয় বলে আগের ব্যবহৃত জুতো বা জামা-কাপড় আর তার গায়ে লাগে না। অর্থাৎ জুতো কিংবা জামা-কাপড় কখনো ছোট হয় না।
সেই দেশে স্বভাবতাই করোনার যথাযথ ব্যবস্থাপনা বা চিকিৎসার অভাবের বদলে করোনায় মানুষ মারা যাবে এই তো স্বাভাবিক!
করোনা পজিটিভ হলে সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ছেন এর চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে। সরকারি হাসপাতালে হুড়োহুড়ি করে কোভিড টেস্ট করা যায়। আগে ফি নেয়া না হলেও এখন টোকেন ফি নেয়া হচ্ছে। টেস্টের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। আর বেসরকারি হাসপাতালে অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কোভিড টেস্টে ফি নেয়া হচ্ছে ৩৫০০ টাকা। তারপর রিপোর্ট নেগেটিভ হলে (যদি না ফলস নেগটিভ হয়) তো মুক্তি। আর পজিটিভ হলে রোগীর বয়েস আর রোগের তীব্রতা অনুযায়ী আরও আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
সরকার কর্তৃক ঠিক করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত ফি’র বিবেচনায় ফুসফুসের সিটি স্ক্যান করতে গেলে ৬০০০ টাকা, ডি ডিমার পরীক্ষা ১৫০০ টাকা, এস. প্রো ক্যালসিটোসিন পরীক্ষা ২০০০ টাকা, এস. ফেরিটিন ১২০০ টাকা, এস. ইলেকট্রোলাইট ১০০০ টাকার পরীক্ষাসহ ইত্যকার আরও আরও পরীক্ষা।
এ তো গেল টেস্ট, এবার যদি আসি ওষুধের দামে! করোনার তীব্রতায় সবচাইতে বেশি আক্রান্ত রোগীর যে ওষুধ লাগে, সেই জীবন রক্ষাকারী রেমডিসিভিরের দাম বিশ্লেষণ করলে উঠে আসে কোম্পানিভেদে এর দামের ভয়াবহ তারতম্য।
৭১ টেলিভিশনে ২৭ জুলাই রাত ৮টায় টকশোতে উপস্থাপক জানালেন, ১১০০ টাকায় রেমডিসিভির ইনজেকশন পাওয়া যায়। সেখানে অনলাইনে ওষুধের দাম খুঁজলে পাওয়া যায়ে বেক্সিমকো, জেনারেল এবং একমির ১০০ মিলিগ্রামের ভায়ালের দাম ৩৫০০ টাকা থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রায় সব কোম্পানির ৪৫০০ টাকা আর হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের দাম ৫৫০০ টাকা।
এই টকশোতেই একজন ভুক্তভোগী জানালেন, তার কোভিড আক্রান্ত মাকে বাড্ডায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে পাঁচ দিন রেখে চিকিৎসা করাতে হয়। কোনো অক্সিজেন লাগেনি, এমনকি লাগেনি আইসিইউ সাপোর্টও। তারপরও চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, যার মধ্যে ওষুধের খরচই ধরা হয়েছে ৩২ হাজার টাকা।!
আচ্ছা এই যে ওষুধের দাম কোম্পানি থেকে কোম্পানি এত বেশি-কম হয়, কেন হয়? এর উত্তর কে দেবে কিংবা এর উত্তর চাওয়ার মতো নাগরিক আমরা কবে হয়ে উঠব? মিডিয়ায় সীমিত টকশো, প্রতিবেদন আর লেখালেখির বাইরে কবে আমরা ব্যাপক সংখ্যায় আমাদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে শিখব? জবাবদিহি বলে যে একটা বিষয় আছে সে বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বরত কর্তাব্যক্তিদের কবে আমরা দায়বদ্ধ হতে বাধ্য করতে পারবো?
শুধু পরীক্ষা করা আর প্রয়োজনমতো ওষুধের ব্যবস্থা হলেই তো হবে না, লাগবে রোগ অনুযায়ী যথাযথ পথ্য। তবু ভালো, মুরগী-মাছ-ডিম-ফলমূলওয়ালা আর শাকসবজিওয়ালারা এখনও হয়তো জানেন না যে, করোনা আক্রান্তদের শরীর মেরামতে প্রচুর প্রোটিন ও ভিটামিন প্রয়োজন হয়। জানলে ঈদের বাজারের শসা-লেবু-কাঁচামরিচের মতো এই করোনা বাজারে তারা কী করতেন সেটা বলাই বাহুল্য!
অন্য কোনো কিছুর দাম অনুসন্ধান করে এই মহামারীকালে শরীর ও মন আজ আর নাই বা খারাপ করলাম! শুধু এইটুকু বলতে চাই, এই করোনাকালে মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন নতুন নতুন যে মুখ যুক্ত হচ্ছে, কোনো খোঁজ খবর কি নেয়া হচ্ছে- কীভাবে বা কোন ধরনের উদ্যোগ নিলে এই মিছিল থামানো বা নিদেনপক্ষে এর গতি কমাতো যেত! কীভাবে করোনা আক্রান্তসহ তাদের আত্মীয় পরিজনের কষ্ট ও উদ্বেগ কিছুটা লাঘব করা যেত?
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে টিকা দেয়ার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ অব্যহত রেখেছেন। আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে শুনেছি, ২১ কোটি ডোজ টিকার ব্যবস্থা হচ্ছে। তার মানে সরকারের দিক থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই আন্তরিক উদ্যোগের সঙ্গে সারা দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় যারা যুক্ত, তাদের সামগ্রিক উদ্যোগও যথাযথভাবে সমন্বিত হোক- মানুষের কষ্ট আর দুর্ভোগ লাঘব হোক, নাগরিক হিসেবে এটাই আমাদের এখনকার প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক