বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের ঘটনার পর বিভিন্ন পর্যায়ে আমি প্রায় এক ডজনেরও অধিক নিবন্ধ লিখেছিলাম দেশের ইংরেজি এবং বাংলা পত্রিকায়। বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা দায়ের করায় ঘটনাটি এখন বিচারাধীন। তাই একজন পেশাদার ব্যাংকার হিসেবে এ ব্যাপের খোঁজখবর রাখলেও এই বিচারাধীন বিষয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু গত ১৬ জুলাই স্থানীয় একটি পত্রিকায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে মনগড়া এক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলাকে ব্যাহত করতে পারে এবং প্রকারান্তরে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (রিজাল ব্যাংক) ব্যাংককে সহায়তা করতে পারে। এ কারণেই কিছু বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। সেই উদ্দেশ্যে এই লেখা।
বাংলদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি যেভাবে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত এবং বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে আমি আমার লেখাগুলো লিখেছি। সেসব লেখায় স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছিলাম যে বাংলাদেশ ব্যংকের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। তথ্যপ্রযুক্তির অনেক খারাপ দিকের একটি হচ্ছে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করা যা প্রতিনিয়ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটছে এবং বাংলদেশ ব্যাংকেও ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনার আগে এই হ্যাকাররা বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে এই অপকর্ম চালিয়েছিল। এর মধ্যে ভিয়েতনামের ব্যাংকের ওপর পারিচালিত প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হয়, কারণ তারা অনলাইনের পাশাপাশি ম্যানুয়াল পদ্ধতিও চালু রেখেছিল যেখানে এই হ্যাকিং প্রচেষ্টা ধরা পড়ে, ফলে ক্রিমিনালদের উদ্যোগটি সেখানে সফল হয়নি। কিন্তু ইকুইডরে তারা যথেষ্ট সফল হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতোই ইকুইয়েডরের একটি ব্যাংক থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে আমেরিকার বাংকে গচ্ছিত অর্থ থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার হংকং স্থানান্তর করে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সেই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
এই বিষয়গুলোও আমি আমার লেখায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছি। ধারণা করা হয় যে, কুখ্যাত হ্যাকাররা ইকুইয়েডরে সফল হবার পরই বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর তাদের প্রচেষ্টা চালায় এবং সফলও হয়। উল্লেখ্য ইকুইয়েডরের সেই ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে সেই অর্থ আদায়ও করেছে। এমনকি আমেরিকার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ সংস্থা আয়োজিত কনফারন্সে বাংলাদেশ ব্যংকের মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা কেস স্টাডি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলে আমি এই সংস্থার একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে এর প্রতিবাদ করি এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় বিষয়ও তুলে ধরেছিলাম একটি লেখায়। ঘটনাটির শুরু থেকে প্রতিটা লেখায় আমি দৃঢ়ভাবেই উল্লেখ করেছিলাম যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা দায়েরই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পন্থা। অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই পথেই অগ্রসর হয়েছে।
সারা বিশ্বে মানি লন্ডারিং এর ঘটনা যেভাবে ঘটে সেগুলো বিচার বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং খুবই সুচতুরভাবে সংগঠিত একটি মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা না করে সেই পত্রিকায় মনগড়া এক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে যেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে দেখানো হয়েছে যে এই ঘটনার সব দোষ বাংলাদেশ ব্যাংকের এবং তৎকালীন গভর্নরের।
আর ফিলিপাইনের যে ব্যাংকে এই মানি লন্ডারিং প্রকৃত অর্থে সংগঠিত হলো তারা ধোয়া তুলসীর পাতা। দেশের স্বার্থের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে কেউ এই ধরনের প্রতিবেদন ছাপতে পারে না, ঠিক এমন সময় যখন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলা চলমান। যতটুকু খোঁজখবর রাখতে পেরেছি তাতে এই মামলা সঠিক পথেই এগিয়ে চলেছে। ঠিক এমন সময় এই মনগড়া প্রতিবেদন ভয়ংকর এক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশে প্রকাশিত সমস্ত প্রতিবেদন ফিলিপাইনের অভিযুক্ত রিজাল ব্যাংক সংগ্রহ করে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাদের পক্ষে আদালতে উপস্থাপন করতে পারে এবং মামলার রায় তাদের পক্ষে আনার চেষ্টা চালাতে পারে।
ইতোপূর্বে এই ঘটনার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির প্রদত্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে তারা এমনটি করার চেষ্টা করেছিল এবং তখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনগত ব্যখ্যা ও অবস্থান কী হবে তা বিস্তারিত তুলে ধরে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। ওই প্রতিবেদনের কপি যদি ইংরেজিতে অনুবাদ করে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে উপস্থাপন করে বিচারককে বুঝানো হয় যে, বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাই বলছে এই মানি লন্ডারিং ঘটনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকই দায়ী, তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেই পত্রিকার প্রতিবেদক এবং সম্পাদক কি একবার ভেবে দেখেছিলেন?
প্রতিবেদনটি পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায় যে এটি তৈরিই করা হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে দায়ী করে। একথা সত্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু অপারেশন ল্যাপ্সেস এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে একজন প্রধান নির্বাহীর সরাসরি কী করার ছিল?
প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নৈতিকতার দায়িত্ব হয়ত তার ওপরই বর্তায় এবং তিনি সেই দায়িত্ব স্বীকার করেই এই গভর্নরের পদ থেকে সরে গেছেন। যদিও বর্তমান করপোরেট বিশ্বে এখন কোনো ঘটনা বা অঘটনের কারণে কোনো শীর্ষ নেতৃত্ব দায়িত্ব থেকে সরে যায় না। আমেরিকার বহুল আলোচিত সাবপ্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারির কারণে কোনো প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব থেকে সরে যাবার ঘটনা আমাদের জানা নেই। অথচ ২০০৮ সালে এই সাবপ্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারি আমেরিকার অর্থনীতির ধস নামিয়ে বিশ্ব মন্দার জন্ম দিয়েছিল।
বিশ্বে লইবর রেট কেলেঙ্কারির মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের জালিয়াতির সঙ্গে ইউরোপের একাধিক ব্যাংক জড়িত থাকার প্রমাণ পাবার পরেও কোনো প্রধান নির্বাহীর পদত্যাগের খবর শোনা যায়নি। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রা রেট জালিয়াতি, প্রেসাস মেটাল ব্যবসার কেলেঙ্কারির মতো ভয়ংকর সব আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও সেগুলোর দায়দায়িত্ব স্বীকার করে কোনো প্রধান নির্বাহীর পদত্যাগের কথা শোনা যায়নি। এমনকি ঘটনাগুলো নিয়ে যথেষ্ট গোপনীয়তাও রক্ষা করা হয়েছে। তৎকালীন গভর্নরকে দায়ী করার চেষ্টা করা হয় এই বলে যে, তিনি ঘটনাটি গোপন রেখেছেন। আর এটাই স্বাভাবিক। কেননা যেকোনো অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা অতি গোপনীয়তার সঙ্গেই মোকাবিলা করা হয়ে থাকে। এই গোপনীয়তার অনুশীলন বিশ্বের উন্নত দেশে তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশেও মেনে চলা হয়। শুধু মানা হয় না আমাদের দেশে। কেননা এখানে এক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো বুঝে না বুঝে অহেতুক হৈচৈ করে ভালোর থেকে খারাপই বেশি করে থাকে। এবং আলোচ্য প্রতিবেদনটি সেরকম একটি প্রচেষ্টা।
সাম্প্রতিক কালের বিশাল এক অর্থ কেলেঙ্কারির উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। জার্মান কোম্পানি ওয়ারকার্ডের দুই বিলিয়ন ডলারের অধিক পরিমাণ অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে যার সঙ্গে ফিলিপিন্সের দুটো বাণিজ্যিক ব্যাংকের নামে জড়িয়ে আছে। ঘটনাটি এখনও তদন্তাধীন আছে। এই অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ে ২০১৯ সালে অথচ জানাজানি হয় ২০২০ সালের মাঝামাঝি তাও খুবই সীমিত পরিসরে। সারা বিশ্বে অসংখ্য মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। আমরা যারা এই অপরাধ প্রতিরোধ সংস্থার সদস্য তারা কিছুটা জানতে সক্ষম হলেও সাধারণ মানুষ এসব কিছুই জানতে পারে না। কারণ এসব ব্যাপারে সবসময়ই কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।
একটি কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ সরিয়ে নেয়ার ঘটনা নয় মোটেই। একটি ভয়ংকর মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চক্র যারা ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংককে ব্যাবহার করেছে এই মানি লন্ডারিং সম্পন্ন বা এই অবৈধ লেনদেন নিষ্পত্তি করার জন্য। তাই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংক এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত এবং তারা এর দায় এড়াতে পারে না। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে পেয়িং ব্যাংক বা অর্থ প্রদানকারী ব্যাংকের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যে ব্যাংক চূড়ান্তভাবে গ্রাহককে অর্থ প্রদান করবে তাদের প্রধানতম দায়িত্ব হলো গ্রাহকের পরিচিতি শতভাগ নিশ্চিত করেই সেই অর্থ প্রদান করা। শুধু তাই নয়, যদি লেনদেনের পরিমাণ কোনো গ্রাহকের অতীত লেনদেনের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বা অস্বাভাবিক মনে হয় তাহলে অর্থ প্রদানকারী ব্যাংক সেই অর্থ প্রদান করা থেকে বিরত থাকবে এবং অর্থ প্রেরণকারী ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এ কারণেই কে-ওয়াই-সি বা নো ইওর কাস্টমার অর্থাৎ ‘তোমার গ্রাহককে ভালোভাবে জান’ মেনে চলা সকল প্রদানকারী ব্যাংকের অন্যতম পূর্বশর্ত। আর এভাবেই বিশ্বে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং এবং ভুয়া অর্থ আদান-প্রদান প্রতিরোধ করা হয়ে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংক এগুলোর কোনোরকম তোয়াক্কা না করে ভুয়া হিসাব খুলে এই বিশাল অংকের অর্থ প্রদান করেছে।
তারা অবশ্য তাদের ব্যর্থতা এবং সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে এবং তাদের প্রধান নির্বাহীসহ জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। ঘটনার মূল বিষয়টি অনুধাবন না করে শুধু বাংলাদেশ বাংক এবং সেসময়ের গভর্নরকে একতরফা দায়ী করে মনগড়া এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন ছাপলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপক্ষেই যাবে এবং সেইসঙ্গে উপকৃত হবে এই মানি লন্ডারিং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংক। বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং নিয়ে যেকোনো অপপ্রচার বা মনগড়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
লেখক: ব্যাংকার, কলাম লেখক, টরেনটো, কানাডা