বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শুভ জন্মদিন: জয়ের জয় হোক

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ২৭ জুলাই, ২০২১ ১৭:১৯

২০১৮ সালের ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে নিজেই জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেও টাকার অভাবে ছেলে জয়কে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াতে পারেননি।

২০০৭ সালের ১৬ জানুয়ারি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বা ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সুইজারল্যান্ডের জেনেভার সদর দপ্তরের ওই বিজ্ঞপ্তিতে ওই বছর বিশ্বের ২৫০ তরুণ নেতৃত্বের নাম প্রকাশ করা হয়। প্রতিবছর বিশ্বের তরুণ নেতৃত্বের নাম প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। পেশাদারি সাফল্য, সামাজিক প্রতিশ্রুতি এবং ভবিষ্যৎ বিশ্ব বিনির্মাণে অংশীদারত্বের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিচার বিশ্লেষণ করেই তবে বাছাই করা হয় বছরের বিশ্বসেরা আড়াই শ’ তরুণ নেতৃত্ব।

বিশ্বের চার হাজারেরও বেশি প্রার্থী থেকে বাছাই প্রক্রিয়ায় সেবছর বিচারক হিসেবে ছিলেন ৩৪ জন আন্তর্জাতিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বিচারকদের প্রধান ছিলেন জর্ডানের রানী রানিয়া আবদুল্লাহ। গর্ব করার মতো বিষয় হচ্ছে, ওই বছর আড়াই শ তরুণ নেতৃত্বের একজন ছিলেন বাংলার সন্তান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়। ইয়াং গ্লোবাল লিডার হিসেবে জয় নির্বাচিত হয়েছিলেন ইনফরমেশন টেকনোলজি বা আইটি স্পেশালিস্ট হিসেবে।

যেকোনো বাংলাদেশির জন্য এটা গর্বের। কিন্তু গর্ব করা যতটা সহজ, ওই পর্যন্ত আসা মোটেই সহজ ছিল না জয়ের। এমনকি বঙ্গবন্ধুর নাতি হয়েও। বরং বেশ কঠিনই ছিল। কতটা কঠিন?

সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়। তার জন্মটাই ছিল ভীষণ এক কঠিন পরিস্থিতিতে। দেশে তখন হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলা চলছে। নির্বিচারে মানুষ খুন করে যাচ্ছে তারা। নানা শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি। আর দেশে বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবার বন্দি। তার মা শেখ হাসিনা, নানি বেগম ফজিলাতুন্নেছা, বাবা ওয়াজেদ মিয়া, মেজ মামা শেখ জামাল, ছোটমামা শেখ রাসেল, খালা শেখ রেহানা-সবাই।

বড় মামা শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন আগে থেকেই। তেমনি এক কঠিন সময়ে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই জন্ম নেন সজীব ওয়াজেদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানা শেখ মুজিবুর রহমান দেশে আসেন। জাতির বিজয়ের প্রতীক হিসেবে নাতির নাম রাখেন ‘জয়’। নানার সঙ্গে পুরো শিশুকালটাও কাটাতে পারেননি। জয়ের মাত্র চার বছর বয়সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন নানা বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসের এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের সময় দেশে ছিলেন না জয়। বাবা ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন একটি উচ্চতর বৃত্তি নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে পড়াশোনা করছিলেন। মা শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই ছেলে জয়, মেয়ে পুতুল ও ছোটবোন শেখ রেহানাকে নিয়ে পশ্চিম জার্মানি চলে যান।

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর মা-বাবার সঙ্গে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন জয় ও তাদের পুরো পরিবার। শুধু তাই নয়, ঢাকা রেডিও থেকে তখন শুধু বঙ্গবন্ধু বিরোধী কথা ও গান প্রচার করা হতো। কারফিউ জারি করা হলো সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত। এরকম পরিস্থিতিতে দেশে ফেরা অসম্ভব ছিল।

মায়ের সঙ্গে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেলেন। ভারতের নৈনিতালে সেন্ট জোসেফ কলেজ ও তামিল নাড়ুর কেআইএস স্কুলে লেখাপড়া করেন। মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় সাত দিনই সবজি বা ডালভাত খেতে হতো, একদিন শুধু মাংস খেতে পারতেন। এরপর ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক করার পর কিছুদিন চাকরি করলেন। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছের কারণে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের আর্লিংটনের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে। এখানে বিজ্ঞানের ওপর আরেকটা ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জনের পর হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

কিন্তু এ পর্যন্ত লেখাপড়া করতে কম কাঠখড় পোহাতে হয়নি সজীব ওয়াজেদকে।

২০১৮ সালের ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে নিজেই জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেও টাকার অভাবে ছেলে জয়কে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াতে পারেননি।

শেখ হাসিনা নিজেই জানান, ‘ভারতের ব্যাঙ্গালোর ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক করার পর জয় কিছু দিন চাকরি করে এরপর আরও উচ্চশিক্ষার জন্য এমআইটিতে (আমেরিকা) চান্স পেল। আমি তার শিক্ষার খরচ দিতে পারিনি। দুটো সেমিস্টার পড়ার পর নিজে কিছু দিল, আমাদের কিছু বন্ধুবান্ধব সহযোগিতা করল, যার জন্য যেতে পারল। আর আব্বার বন্ধু আমার ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উনি বলতেন, তুমি পলিটিক্স করো এটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। তিনি না থাকলে আমি পড়াতে পারতাম না।...

‘যখন এমআইটিতে দিতে পারলাম না। আমি প্রধানমন্ত্রী, আমার দ্বিধা হল, কাকে বলব টাকা দিতে বা কিভাবে আমি টাকা পাঠাবো, বুঝতে পারিনি। কার কাছে দেনা হব? আমার কারণে তার পড়া হল না। দুটো সেমিস্টার করে তাকে বিদায় নিতে হল। তারপর সে চাকরিতে ঢুকল। ’

‘২০০৭ সালে বউমা অসুস্থ হলে দেখতে গেলাম। তখন তাকে অনুরোধ করলাম। কারণ আমার ভেতরে এই জিনিসটা খুব কষ্ট লাগত যে, আমি প্রধানমন্ত্রী হলেও তার পড়ার খরচ দিতে পারিনি। তখন আমি বললাম, তুমি হার্ভার্ডে আবেদন কর। আমি অনুরোধ করার পর সত্যি সে আবেদন করল। চান্স পেয়ে গেল। আমি কথা দিয়েছিলাম, ফার্স্ট সেমিস্টারের টাকা আমি দেবো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার আগে গ্রেফতার হয়ে গেলাম। পরে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে তা ভাড়া দিয়ে সেই ভাড়ার টাকা দিয়ে, কলেজ থেকে দূরে বাসা নিল যাতে সস্তায় বাসা পায়, গাড়ি রেখে মোটরসাইকেল চালিয়ে সে আসত।’

বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতার নাতি হয়েও লেখাপড়ার টানে কী কষ্টটাই না করেছেন জয়!

কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার করার কারণে ও উন্নত বিশ্বে থাকার কারণে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের অনেক কিছুই আগে থেকে বুঝতে পেরেছিলেন জয়। বেকার তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হিসেবে অনুপ্রেরণা দিলেন। যাতে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ঘরে বসেই উপার্জন করতে পারে। দেশের সীমিত জনবল নিয়েও তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। আর এটা সম্ভব হয়েছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কারণে। তার দূরদর্শী চিন্তার কারণে ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সম্মানসূচক আইসিটি উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করা হয় তাকে।

এটা কিন্তু বিনাবেতনের পদ। চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মহাকাশ গবেষণার বীজ রোপিত হয়েছিল তখন। সে রোপিত বীজের সফল বাস্তবায়ন ঘটালেন তারই নাতি-মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের মাত্র ৫৬টি দেশ এখন পর্যন্ত মহাকাশ স্যাটেলাইটের গর্বিত অংশীদার। এছাড়া হাইটেক পার্ক নির্মিত হয়েছে গাজীপুরে।

এ হাইটেক পার্কে রয়েছে দেশের প্রথম ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওয়েব পোর্টালও তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। জাতীয় পরিচয়পত্রকে স্মার্ট করা হয়েছে। আর পাসপোর্ট তো মেশিন রিডেবল পেরিয়ে ই-পাসপোর্ট হয়ে গেছে। দেশের প্রতিটা মানুষের ডেটা ডিজিটালি সংরক্ষণের জন্য বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করা হয়েছে। নানান প্রজেক্টে থাকা ডেটাগুলোকে নিয়ে আসা হয়েছে সেন্ট্রাল ডেটাবেজে। সেখান থেকে সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই যে কারো পরিচয় জানতে পারছে। এতসব কিছুই সম্ভব হয়েছে জয়ের পরিকল্পনায়। তার পরিকল্পনার মধ্যে আরও রয়েছে ক্যাশলেস লেনদেন, অনলাইনে সরকারি সেবাসহ আরও নানান কিছু। ক্যাশলেস লেনদেন পুরো সফল হলে দুর্নীতি কমে যাবে। আর সকল সরকারি সেবা অনলাইনে হলে জনগণ অপেক্ষমাণ (ইন লাইন) না থেকে সেবার অনলাইনেই থাকবে।

তথ্যপ্রযুক্তির কারণে বাংলাদেশের অনেক তরুণ এখন আর অভিশাপ নয়, বরং জনশক্তি হিসেবে দেশের সম্পদ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। যার নেপথ্য কারিগর জয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান তুলে দেশকে সত্যি সত্যি ডিজিটাল মহাসড়কে তুলে দেয়া মানুষটার আজ জন্মদিন।

জন্মদিনের শুভেচ্ছা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। শুভেচ্ছা নিরন্তর।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর