প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন। সমগ্র বিশ্বকে তছনছ করে ফেলা ভয়ংকর এক ভাইরাস করোনার কাছে হার মেনে তিনিও চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি। এমন এক ভাইরাসের কবলে বিশ্ব পড়েছে যে, এর আক্রমণে অসংখ্য সাধারণ মানুষ যেমন মারা যাচ্ছেন তেমনি অনেক গুণী মানুষও আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যেকোনো মানুষের মৃত্যুই খুবই কষ্টের এবং দুঃখের। কিন্তু গুণী মানুষ ও প্রখ্যাত ব্যক্তিদের এভাবে চলে যাওয়া অনেক বেশি কষ্টের এবং দেশ ও জাতির জন্য অনেক বেশি ক্ষতির। গুণী মানুষ সবসময়ই জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের অবিভাবকের দায়িত্ব পালন করে।
জাতির বিবেক বলে পরিচিত গুণীজনরা কখনই ঘরে ঘরে এবং প্রতি বছর জন্মগ্রহণ করেন না। এই করোনা সংক্রমণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে আমরা যত গুণীজনকে হারিয়েছি তেমনটা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনার পর আর কখনও ঘটেনি।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে এতটাই হতাশ হতে হয় যে, আমরা কি আসলে মেধাশূন্যতার মধ্যে পড়তে চলেছি। এই ক্ষেত্রে হয়ত করোনা মহামারির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ উন্নত বিশ্বের চেয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের। বিশেষ করে আমাদের দেশের অনেক বেশি। এই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে উন্নত বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা এখনও হয়ত অনেক। কিন্তু গুণী মানুষের মৃত্যু আমাদের দেশেই বেশি হয়েছে।
আমাদের দেশে যেকোনো সংকটকালে এসব গুণী মানুষই সকল প্রকার ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে এগিয়ে আসেন সবার আগে। ফলে তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়েন, আক্রান্তও হন এবং জীবনও উৎসর্গ করেন। এই করোনা মহামারির ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। অথচ উন্নত বিশ্বে গুণী মানুষ এবং প্রথিতযশা ব্যক্তিরা জাতির সকল সংকটে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেই নির্দেশনা-উপদেশ দিয়ে থাকেন। এ কারণেই করোনা সংক্রমণে উন্নত বিশ্বে লাখ লাখ সধারণ মানুষ এবং বৃদ্ধাশ্রমের বা ওল্ড হোমের বয়স্করা মারা গেলেও প্রখ্যাত ব্যক্তিদের মৃত্যুর খবর খুব একটা শোনা যায়নি।
আমাদের দেশে যে কয়েকজন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ছিলেন তাদের মধ্যে ফকির আলমগীর অন্যতম। তিনি যদিও গতানুগতিক ধারার গান খুব কমই গেয়েছেন। তিনি মূলত গণসংগীতই বেশি গেয়েছেন। সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি গণসংগীতশিল্পী হিসেবেই মানুষের মাঝে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন। আমরা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে ফকির আলমগীরের গণসংগীত শুনে আসছি।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের এক আনন্দমেলা অনুষ্ঠানে তার গাওয়া ‘ও সখিনা’ গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও বেশ পছন্দের গান ছিল। দেশে গণসংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে ফকির আলমগীর ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী নামের এক গণসংগীত দল গড়ে তুলেছিলেন। পয়লা বৈশাখ এবং মে দিবস উপলক্ষে যত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো সেখানে ফকির আলমগীরের গান থাকতই এবং তার গান শোনার জন্য আমরা সবাই সেখানে ভিড় জমাতাম। মূলত ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী অনুষ্ঠানের আয়োজন করত কিন্তু মূল আকর্ষণ থাকত এর কর্ণধার ফকির আলমগীর। তার কণ্ঠে ‘ও সখিনা’ এবং ‘নাম তার জন হেনরি’ গানসহ অনেক জনপ্রিয় গণসংগীত শোনার জন্য মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত। সেসময় আমাদের দেশে পাশ্চাত্য রক মিউজিকের আগমন সেভাবে ঘটেনি। ফকির আলমগীর ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সংগীতশিল্পী।
তিনি স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাশ্চাত্য রক বা পপ সংগীতের আগ্রাসন কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না। তাই আমাদের দেশের গণমানুষের সংগীতকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাকে আধুনিক সংগীতের আদলেই পরিবেশন করতে হবে। সেকারণেই তিনি আমাদের দেশের গণসংগীতকে পাশ্চাত্য রক বা পপ মিউজিকের আদলে পরিবেশন শুরু করেন এবং তার এই নতুন ধারার সংগীত দ্রুতই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। তিনি যে শুধু গণসংগীত গেয়েছেন তাই নয়, এই সংগীতের উন্নতিকল্পে যথেষ্ট কাজও করেছেন।
ফকির আলমগীর গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে দেশের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি সোচ্চার ছিলেন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। খুব অল্প বয়সে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শব্দসৈনিক হিসেবে যোগদান করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন।
দেশে শ্রমজীবী এবং মেহনতি মানুষের প্রতি কোনো রকম অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি যথেষ্টই সোচ্চার ছিলেন। টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও-পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন ফোরামে সুযোগ পেলেই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনের সময়েও ফকির আলমগীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগ্ননাথ হলের অডিটোরিয়াম ভবনের ছাদধসে প্রায় চল্লিশ ছাত্র নিহত এবং প্রায় তিন শতাধিক ছাত্র আহত হয়। সেই ঘটনার পর দেশব্যাপী এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং সকল মহল থেকে প্রতিক্রিয়ার ঝড় ওঠে। ফকির আলমগীর সেই দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রদের স্মরণে একটি ক্যাসেট বের করেছিলেন।
তার গণসংগীত সংগঠন, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী এই ক্যাসেট বের করলেও এর মূল পরিকল্পনা, গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক ছিলেন ফকির আলমগীর নিজেই। সেই ক্যাসেটে নিহতদের আত্মীয়স্বজনের আহাজারি, তাদের দুঃখ-দুর্দশা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলার বিষয়গুলো গান, কবিতা এবং আবৃত্তির মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন ফকির আলমগীর। ক্যাসেটের গানে এবং আবৃত্তিতে নিহত ছাত্রদের আবেগ এমনভাবে তুলে ধরেছিলেন যে সেই গান ও আবৃত্তিগুলো শুনে চোখের পানি আটকাতে পারেনি কেউই। শুধু ক্যাসেট বের করেই শেষ করেননি। তিনি ঋষিজ শিল্প গোষ্ঠীর ব্যানারে টিএসসির মিলনায়তনে ঘটা করে এই ক্যাসেটের মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন, যা ছিল মূলত সেই দুর্ঘটনার জন্য তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বড় রকমের এক প্রতিবাদ।
সেই অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলাম যে, এরকম হৃদয়বিদারক ঘটনা আপনি যেভাবে গান এবং আবৃত্তির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তা এককথায় অসাধারণ। এই প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ‘গণসংগীত এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম যেখানে শুধু গণমানুষের কথাই তুলে ধরা হয় না, সেইসঙ্গে প্রতিবাদও জানানো হয়, আর আমি সেই কাজটাই করার চেষ্টা করেছি। যদি আপনাদের ভালো লাগে তাতেই আমি সার্থক।’ আমি অনেকদিন সেই ক্যাসেটটি সংগ্রহে রেখেছিলাম এবং মাঝেমধ্যেই শুনতাম।
কানাডা আসার সময় সেই ক্যাসেটটি হারিয়ে ফেলেছি। ইচ্ছে ছিল ফকির আলমগীরের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে সেই ক্যাসেটের নতুন সংস্করণ বা অন্যকোনো ফর্মে বা ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে পুনরায় প্রকাশ করার জন্য তাকে অনুরোধ জানাব। বছর দুয়েক আগে যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম তখন সেই চেষ্টা করেছিলামও, কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাইনি। ভেবেছিলাম পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সহসাই বাংলাদেশে যাব এবং তখন তার সঙ্গে দেখা করে এই অনুরোধ জানাব। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সেই সুযোগ আর এ জীবনে হয়ে উঠল না।
আমাদের দেশে ব্যান্ড সংগীত বা পপ সংগীতের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও গণসংগীতের প্রসার সেভাবে ঘটেনি। এই বিষয় নিয়ে ফকির আলমগীর যথেষ্ট কাজও করছিলেন। সংগীতকে সাধনার বিষয় হিসেবে না নিয়ে যেনতেনভাবে গান গেয়ে জানপ্রিয় হবার যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে তার যথেষ্ট হতাশাও ছিল এবং বিভিন্ন পরিসরে তিনি সেই হতাশা প্রকাশও করেছেন। তবে তিনি হাল ছাড়েননি এবং গণসংগীতকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কাজ করে গেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
যেসময় গণসংগীতের প্রসারে বাংলাদেশে তার মতো মানুষের খুব বেশি প্রয়োজন, ঠিক সেই সময়েই তিনি চলে গেলেন। তার মৃত্যুতে দেশের সংগীত জগতে বিশেষ করে গণসংগীতের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল যা সহসা পূরণ হবার নয়। তার অনুসারীরা বিশেষ করে তার হাতেগড়া সংগঠন ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যদি তার আদর্শকে ধারণ করে গণসংগীতের প্রসারে কাজ করে যেতে পারে তাহলে সেটিই হবে এই গুণী শিল্পীর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো।
গণসংগীত গেয়ে ফকির আলমগীর একদিকে যেমন জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, অপরদিকে তেমনি প্রশংসাও পেয়েছেন সকল মহল থেকে। জীবদ্দশায়ই একুশে পদক পেয়েছেন।
সংগীত জগতে সুদীর্ঘ এক বর্ণাঢ্য জীবন পার করে দেশে গণসংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে ফকির আলমগীর একাত্তর বছর বয়সে চলে গেলেও গণসংগীতের মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
লেখক: ব্যাংকার, কলাম লেখক। টরেন্টো, কানাডা