বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সবকিছুর আগে ক্ষুধা নিবারণ

  • লাভা মাহমুদা   
  • ২৫ জুলাই, ২০২১ ১১:২৫

আবার শুরু হয়েছে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন। যারা লকডাউনের পরামর্শ দেন, তারা হয়তো বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতার বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামান কম। অথবা মাথা ঘামালেও পরিস্থিতির মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হন। মহামারি নিয়ন্ত্রণ যেমন জরুরি, তেমনি নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়া তারচেয়েও বেশি জরুরি। লকডাউনে ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছানোর নিশ্চয়তা বিধান না করেই কঠোর লকডাউনের ঘোষণা অসহায় নিরন্ন মানুষের সঙ্গে নির্মম রসিকতাই বটে। ইতোমধ্যে দেশে ৩ কোটি দরিদ্র মানুষের সঙ্গে আরও ২ কোটি ৭০ লাখ নতুন দরিদ্র যোগ হয়েছে। বিশ্বে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।

পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম, অকৃত্রিম এবং মৌলিক শব্দ ‘ক্ষুধা’ বললে অত্যুক্তি হবে না। ক্ষুধা এমন এক অনুভূতি যার সঙ্গে কোনো শব্দের তুলনা হয় না। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে রূপ, লাবণ্য, সৌন্দর্য, আনন্দ সবকিছুই মূল্যহীন। ক্ষুধার রাজ্যে প্রেম, কবিতা বা আবেগের মতো অনুভূতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রেয়সীর ভুবন ভোলানো হাসি বা ডাগর চোখের চাহনিও খটোমটো প্রবন্ধ মনে হয়। দুঃখ কষ্টের তীব্রতা যত বেশিই হোক না কেন, ক্ষুধা একসময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই। ধনবানদের শখ করে দুএক বেলা না খেয়ে থাকা আর খাদ্যের অভাবে খেতে না পারা এক বিষয় নয়। ক্ষুধার জ্বালা যে বড় জ্বালা!

ক্ষুধার্ত মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খাদ্য ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না, এই ধরনি তার কাছে নীরস গদ্যময়। তাই তো দূর আকাশের পূর্ণিমার চাঁদটা আগুনে ঝলসানো রুটি মনে হয়। ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো বাবা-ই ঘরে চোখ বুজে থাকতে পারে না।আবার শুরু হয়েছে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন। যারা লকডাউনের পরামর্শ দেন, তারা হয়তো বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতার বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামান কম। অথবা মাথা ঘামালেও পরিস্থিতির মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হন। মহামারি নিয়ন্ত্রণ যেমন জরুরি, তেমনি নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়া তারচেয়েও বেশি জরুরি। লকডাউনে ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছানোর নিশ্চয়তা বিধান না করেই কঠোর লকডাউনের ঘোষণা অসহায় নিরন্ন মানুষের সঙ্গে নির্মম রসিকতাই বটে। ইতোমধ্যে দেশে ৩ কোটি দরিদ্র মানুষের সঙ্গে আরও ২ কোটি ৭০ লাখ নতুন দরিদ্র যোগ হয়েছে। বিশ্বে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। করোনায় চাকরি ও কাজ হারিয়েছেন প্রায় দেড় কোটি মানুষ। প্রতিনিয়ত ক্ষুধার্ত, আশ্রয়হীন, বস্ত্রহীন মানুষের হাহাকারের ভারী মেঘ জমছে বাংলার আকাশে। আমরা যদি এই হাহাকার ঠেকাতে না পারি, তাহলে এসব অসহায় মানুষের নীরব চোখের জলে ভেসে যাবে উন্নয়নের সব সরল রৈখিক গল্প।এ মুহূর্তে গোটা বিশ্বে ৮২ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত। এর মধ্যে মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও গৃহযুদ্ধের ফলে সংঘাত সমন্বিতভাবে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা পরিস্থিতিকে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, আগামী কয়েক মাসে ২০টির বেশি দেশে তীব্র ক্ষুধা বা খাবারের সংকট বর্তমানের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে। আমাদের চোখের সামনে এক মহাবিপর্যয় সৃষ্টি হতে চলেছে। গৃহযুদ্ধ, জলবায়ু ও মহামারির প্রভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, এমন পরিস্থিতিতে কোটি কোটি পরিবারের দরজায় দুর্ভিক্ষ কড়া নাড়ছে। এই মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ২৮ কোটি ৪৬ লাখ হতদরিদ্র মানুষ রয়েছেন ভারতে।কোভিড-১৯ এর প্রভাব কাটাতে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ লকডাউন অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়। এতে দারিদ্র্যের হার ক্রমশই বাড়ছে। কোভিডের আগেই যারা দরিদ্র ছিলেন, তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) রিসার্চ ডিরেক্টর বিনায়ক সেন এক ওয়েবিনারে এই তথ্য জানান। তার মতে করোনার আগে দরিদ্রতার হার ছিল ২০.৪% সেটা এখন ২৯.৪% হয়েছে। চলতি বছর শেষে দারিদ্র্যের হার আরও বাড়বে। দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫৯% ছিল, সেখানে ৪৪% গ্রামাঞ্চলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) খাদ্যসংকট ব্যাপক আকার ধারণ করা এলাকাগুলো নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, তীব্র ক্ষুধার বিপর্যয়কর মাত্রার তালিকায় থাকা অঞ্চল ও দেশের শীর্ষে আছে নাইজেরিয়া, ইয়েমেন ও দক্ষিণ সুদান। এ ছাড়া এশিয়ার আফগানিস্তান, সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের লেবানন, লাতিন আমেরিকার হাইতি ও ক্যারিবীয় এলাকার মানুষ এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে।

FAO-এর নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলে তার বক্তব্যে সতর্ক করে বলেন, ‘তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে ক্ষুধার মহামারি দেখা দেবে, যা কোভিড-১৯-এর চেয়েও মারাত্মক হবে। দুর্ভিক্ষ একদম আমাদের মানবতার দরজায় কড়া নাড়ছে। আমরা এক হয়ে কাজ করলে বিশ্বের ৬৯০ মিলিয়ন মানুষ, যারা প্রতিরাতে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়, তাদের ক্ষুধা দূর করতে পারতাম। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো আমরা এক হয়ে কাজ করতে পছন্দ করি না। বিভিন্ন যুদ্ধে মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখেই যুদ্ধজয়ের চেষ্টা করা হয়।’বর্তমানে আনুমানিক ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে অবস্থান করছে। জরুরি এ ক্ষুধা পরিস্থিতি ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন-৪ নামে পরিচিত, যার অর্থ হলো এসব মানুষ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হওয়া থেকে একধাপ দূরে আছেন মাত্র।আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের পেছনে বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টির মতো কারণ যেমন দায়ী, তেমনি সামাজিক-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতাও দায়ী। তবে সে সবই গৌণ। মুখ্য কারণ দুর্নীতি। দায়বদ্ধতার পরতে পরতে দুর্নীতি নামের বিষবৃক্ষের শেকড় ছড়িয়ে আছে গভীর থেকে গভীরে। করোনা মহামারিতেও যা থেমে নেই। নিরন্ন মানুষের বরাদ্দ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, হতদরিদ্র মানুষের মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দিতে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্প প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। দুর্নীতি আয় বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। দুর্নীতিবাজ যে কেউ হতে পারে, কিন্তু দুর্নীতির কালো থাবার শিকার হয় শুধু সাধারণ দরিদ্র মানুষ।

এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনই যে সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার কার্যকর পন্থা, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। তাই গণটিকাদান কার্যক্রম পরিচালনায় ভ্যাকসিন আমদানি, নিবন্ধন ও প্রদানের সক্ষমতার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া জরুরি। ভ্যাকসিন আমদানি কার্যক্রমও প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে দ্রুততার সঙ্গেই হচ্ছে। তবে আরও বিপুল পরিমাণ টিকার প্রয়োজন। সরকারের সদিচ্ছা এবং উন্নত দেশগুলোর টিকার প্রয়োজন কমে যাওয়াতে আশা করা যায়, তাড়াতাড়ি আমরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।

বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে মানুষকে যতই ঘরে থাকতে বাধ্য করা হোক না কেন তা চোর পুলিশ খেলার নামান্তর মাত্র। শহর-নগর, বন্দর-গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় অসংখ্য অলিগলিতে মানুষের আনাগোনা কোনোভাবেও বন্ধ করা যাবে না। তারচেয়ে বরং মাস্ক পরতে অনুপ্রাণিত এবং প্রয়োজনে এই বিষয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর ভ্যাকসিনের প্রতি মানুষের তীব্র অনীহা দূর করতে এলাকাভিত্তিক উদ্বুদ্ধকরণের কাজটি দ্রুতই শুরু করতে হবে। ভ্যাকসিন নিয়ে শহর-গ্রাম সবখানেই আছে নানারকম নেতিবাচক প্রপাগান্ডা।

মাস্ক এবং টিকা এ দুটোই শুধু মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারবে, অন্যকিছু নয়। তাই লকডাউন বা কঠোর লকডাউনের পন্থা বাদ দিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল করার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বন্ধ অর্থনীতির চাকা খুলে দিলে শুধু ক্ষুধার্তের অন্ন কষ্টই দূর হবে না, সার্বিক অর্থনীতিও প্রাণ ফিরে পাবে। নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে টিকা দিয়ে প্রাণ বাঁচাই, অর্থনীতিও বাঁচাই।

লেখক: শিক্ষক, প্রবন্ধকার-কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর