হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক আফগানিস্তান এখন পৃথিবীর সবচেয়ে অভিশপ্ত জনপদের একটি। কখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন, কখনও তালেবান, কখনও যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেছে আফগানিস্তানকে। যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে শাসন করেছে, শোষণ করেছে। আফগানিস্তানে যে চার কোটির মতো মানুষ আছে, তারা যেন খেলার পুতুল। যার ইচ্ছা মারছে, কাটছে; তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি কারো বিবেচনায়ই নেই।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ২০ বছরের যুদ্ধ শেষে মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে। ৩১ আগস্টের মধ্যে সর্বশেষ মার্কিন সৈনিকটিও আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে। এই ২০ বছরের যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে এবং প্রাণ গেছে ২ হাজার ৪০০ মার্কিন সেনার। দৃশ্যত জো বাইডেনের সিদ্ধান্তে মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ছে। বাস্তবে মার্কিন বাহিনী পরাজিত হয়ে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে। কিন্তু এই ২০ বছরের অর্জন কী? এই প্রশ্নের উত্তর- একটি বড় শূন্য। ঠিক ২০ বছর আগে আফগানিস্তানে যে ঝুঁকি ছিল, এখনও তাই আছে।
আফগানিস্তান আবারও তালেবানদের কব্জায় যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। গত ১ মে থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার শুরুর পর থেকেই তালেবানরা আবার আফগানিস্তানের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আফগান সীমান্তের ৯০ ভাগই এখন তালেবানদের দখলে। ৪০০ জেলার মধ্যে ২১৫টিই তাদের নিয়ন্ত্রণে। তালেবানদের হাতে নির্বিচারে প্রাণ দিচ্ছে সরকারি বাহিনীর সদস্যরা। অনেকে সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়েছে।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ এই ১০ বছরের সোভিয়েত দখলদারিত্বের সময় মার্কিন প্রশ্রয়েই গড়ে উঠেছিল তালেবান। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদায়ের পর নানামুখী জাতিগত সংঘাত আর গৃহযুদ্ধ শেষে ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের দখল নেয় তালেবানরা। পরের পাঁচ বছর শুধু আফগানিস্তান নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক কালো অধ্যায়।তালেবানদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে বসা আল-কায়েদা ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে বিশ্ব রাজনীতিকেই চিরদিনের জন্য বদলে দেয়। তারপরই শুরু হয় নিজেদের সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তালেবানদের সঙ্গে মার্কিন বাহিনীর লড়াই।
৯/১১-এর ২০ বছর পূর্তির আগেই যা শেষ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জো বাইডেন। তিনি বুঝেছেন, এ যুদ্ধ যত চলবে, মার্কিন সেনারা ততই জীবন দেবে। কিন্তু নিজেদের সেনাদের নিরাপদ রাখতে জো বাইডেন গোটা আফগানিস্তানকেই তালেবানদের কাছে জিম্মি করে ফেললেন। আর তালেবানদের পুনরুত্থান শুধু আফগানিস্তানের সমস্যা নয়, আঞ্চলিক রাজনীতি তো বটেই; গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকেই টালমাটাল করে দিতে পারে।
মার্কিন সেনাদের চলে যাওয়া এবং তালেবানদের অবশ্যম্ভাবী পুনরুত্থানের প্রভাব নিয়ে এখন নানামুখী আলোচনা চলছে। প্রথম ধাক্কাটা তো অবশ্যই আফগানিস্তানের জনগণের ওপর দিয়েই যাবে। ১৯৯৬-২০০১ এই পাঁচবছরের তালেবান শাসনের দুর্বিষহ স্মৃতি কেউই ভুলে যাননি। যদিও তালেবানরা বলছে, এবার আর আগের মতো বিচ্ছিন্ন থাকবে না তারা। সন্ত্রাসীর চেয়ে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেই নিজেদের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। কিন্তু গত দুই মাসে নিজেদের দখল পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময়ে তারা যা করছে, তাতে এটা নিশ্চিত, মুখে যা-ই বলুক- তালেবানরা অন্ধকারের প্রতিভূই।
তারা নির্বিচারে সরকারি সেনাদের হত্যা করছে, দখল নেয়া এলাকায় শরিয়া আইন চালু করেছে, নারীদের আবার অবরুদ্ধ করছে, রয়টার্সের পুলিৎজার বিজয়ী ফটোসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকীকে হত্যা করেছে, হত্যা করেছে মার্কিন বাহিনীর অন্যতম দোভাষী সোহেইল পারদিসকে। সব মিলিয়ে তালেবানরা যে বদলায়নি, বদলাবেও না, সেটা নিশ্চিত। বরং মার্কিন বাহিনী ২০ বছরেও তাদের কিছু করতে পারেনি, এই আত্মবিশ্বাস তালেবানদের আরও বেপরোয়া করে তুলতে পারে। বরাবরই আফগানিস্তান আফিম আর জঙ্গিবাদের উর্বর ভূমি। এবার তালেবানরা ক্ষমতায় এলে আফগানিস্তান হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গিবাদের নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আফগানিস্তান এ অঞ্চলের প্রবেশদ্বার। কিন্তু এ দরজা দিয়ে ব্যবসা যেমন এসেছে, দখলদাররাও এসেছে। বিশ্ব অনেক বদলে গেছে। তারপরও আফগানিস্তানের গুরুত্ব কমেনি। মার্কিন বাহিনী ছেড়ে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের ভূমিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকেই বিশেষ করে চীন, ভারত-পাকিস্তান। আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ে মনে মনে হলেও অনেকে খুশি হবে।
আমেরিকার যেকোনো পরাজয়ে নিশ্চয়ই চীন খুশি। চীন এখন চাইবে আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব আরও বাড়াতে। পাকিস্তান বরাবরই জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক; কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে। তবে সবচেয়ে বড় চিন্তায় পড়েছে ভারত। দুই চিরশত্রু চীন-পাকিস্তানকে টপকে আফগানিস্তানে খুব বেশি নাক গলাতে পারেনি ভারত। তবে মার্কিন যুদ্ধের সময়ে ভারত নানাভাবে আফগানিস্তানে নিজেদের অবস্থান সংহত করার চেষ্টা করছিল। বিপুল বিনিয়োগে তারা আফগানদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সকল বিনিয়োগই অর্থহীন হয়ে যাবে। এরই মধ্যে তালেবানরা আফগানিস্তানে ভারতের বানানো একটি বাঁধ দখল করে নিয়েছে। ভারতের উদ্বেগ আসলে বহুমুখী। স্বাভাবিকভাবেই নয়া আফগানিস্তানে চীন-পাকিস্তানের প্রভাব বেশি হবে।
অতীতে দেখা গেছে, আফগান জঙ্গিরা কাশ্মীর পর্যন্ত ছড়িয়ে পরেছে। এটা ভারতের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। এমনিতেই পাকিস্তান আর চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা আছেই। তার সঙ্গে যদি আফগানিস্তান সমস্যার নতুন ফ্রন্ট খোলে, ভারতের বিপদ সত্যিই বাড়বে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের দৌড়ঝাঁপ দেখলেই টের পাওয়া যায় আফগানিস্তান নিয়ে ভারতের উদ্বেগ কতটা।
আমি যদি গোটা বিশ্ব বাদ দিয়ে একদম স্বার্থপরের মতো বাংলাদেশের কথা ভাবি, তাতেও আমি শঙ্কিত হই। আশির দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে বাংলাদেশের অনেকে আফগানিস্তান গিয়েছিলেন। তারা ফিরে এসে ঢাকার রাজপথে, ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ এমন স্লোগানও দিয়েছিল। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের শুরুটা এই আফগানফেরতদের হাত ধরেই হয়েছিল। জঙ্গিদের জগতে ‘আফগানফেরত যোদ্ধা’দের আলাদা মর্যাদা ছিল।
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে জঙ্গিরা এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। তবে নিষ্ক্রিয় হলেও তাদের নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। সুযোগ পেলেই তারা আবার মাথাচাড়া দিতে পারে। আফগানিস্তানে তালেবানদের প্রত্যাবর্তনের চেয়ে বড় সুযোগ জঙ্গিদের কাছে আর কিছু হতে পারে না। শোনা যাচ্ছে, এরই মধ্যে জঙ্গিদের কেউ কেউ আফগানিস্তান পাড়ি জমিয়েছেন। নিশ্চয়ই আফগানিস্তান থেকে পাওয়া মনোবল আর সহায়তায় তারা বাংলাদেশেও নতুন করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করবে। তবে সরকার এ বিষয়ে সচেতন। বাংলাদেশ যাতে কোনোভাবে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বাংলাদেশ, আফগানিস্তান-দক্ষিণ এশিয়া এবং গোটা বিশ্ব জঙ্গি আর সন্ত্রাসবাদমুক্ত মুক্ত থাকুক এই হোক এ সময়ে সবার কামনা।
লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক