রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, ভূমিহীনদের ঘর দেয়াসহ সামাজিক নানা কর্মসূচির কারণে বাংলাদেশ গোটা পৃথিবীর কাছে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে নজির স্থাপন করেছে। অর্থনীতিসহ বৈশ্বিক নানা মানদণ্ডে অন্যান্য সমকক্ষ দেশের চেয়ে বাংলাদেশ যখন অনেক এগিয়ে ঠিক তখন নতুন করে মহা-চ্যালেঞ্জের মুখে শেখ হাসিনার সরকার তথা গোটা জাতি। তবে এটা যে শুধু বাংলাদেশের জন্য বিপদ তা নয়, গোটা বিশ্বই আজ কোভিড মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই পরিস্থিতি মোকাবিলা সবচেয়ে কঠিন।
ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশে এখন গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়েছে। প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ নতুন এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। যদিও অনেক আগে থেকেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু জীবন ও অর্থনীতি সচল রাখার প্রয়োজনে হয়ত সরকার সব পরামর্শ মেনে চলতে পারেনি। আগে থেকে আরও বেশি সতর্ক হওয়া গেলে হয়ত ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া যেত।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রথমে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে ছড়িয়েছে। আস্তে আস্তে তা সারা দেশে বিস্তার ঘটায়। এখন রাজধানী ঢাকায় মৃত্যু ও সংক্রমণ কমলেও বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় রোগীর চাপ বেশি। তাছাড়া আগে পুরুষের মৃত্যুসংখ্যা বেশি হলে এখন কিন্তু নারীসহ সব বয়সের মানুষ মারা যাচ্ছে। নারী মৃত্যুহার দাঁড়িয়েছে ৪০ ভাগ। এর মানে হলো অবহেলায় সংক্রমণ বেড়েছে। ক্ষতিকর ডেল্টা ভাইরাসও আগ্রাসী হয়ে বাড়াচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।
দেশের জেলা-উপজেলায় করোনার উন্নত চিকিৎসা এখনও প্রসারিত করা যায়নি। দেড় বছরেও স্বাস্থ্য খাতের বড় ব্যর্থতা এটি। স্বাস্থ্য বিভাগকে বিতর্ক আর সমালোচনার ঊর্ধ্বে নেয়া সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে খোদ সরকার দলের এমপিরাই সন্তুষ্ট নন। সম্প্রতি সংসদ অধিবেশনে সিনিয়র রাজনীতিকরা স্বাস্থ্য বিভাগের তীব্র সমালোচনা করে মন্ত্রীর পদত্যাগ পর্যন্ত দাবি করেছেন।
বিভাগীয় শহরগুলোতে চিকিৎসা ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বা প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ কিন্তু একেবারেই কম। বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনা বার বার চোখ রাঙাতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও তৃতীয় ওয়েবও চলছে। রাতদিন লাশ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কারণে দিল্লির তাপমাত্রা বৃদ্ধির খবরও গোটা বিশ্বে আলোচিত। অতি মৃত্যুর কারণে অনেক দেশে দেয়া হয়েছে গণকবর।
আমাদের দেশে প্রথম ধাক্কার পর একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ঠিক হয়নি। আবারও সংক্রমণ বাড়তে পারে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের চিত্র দেখে ব্যাপকভাবে পরবর্তী ওয়েভ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল। করোনা চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো আইসিইউ-সেবা ও অক্সিজেন। একারণে ঢাকার বাইরের বেশি রোগী মারা যাওয়ার কথা বলছেন চিকিৎসকরা।
মহাখালী বিশেষায়িত কোভিড হাসপাতালের পরিচালক এ কে এম নাসির উদ্দিনের কথা ধরে যদি বলি, আক্রান্তদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ ভাগ রোগীকে আইসিইউ সেবা দিতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সেবা না পেয়ে জেলা বা উপজেলা শহর থেকে যেসব রোগীকে ঢাকায় আনা হচ্ছে তাদের একটা বড় অংশের মৃত্যু হচ্ছে। একহাজার শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে আছে ২১২ আইসিইউ। সব মিলিয়ে আইসিইউ মাপের সেবা আছে ৫০০ বেডে। বাকি ৫০০ বেড চলে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে।
কথা হলো সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আইসিইউ এই হাসপাতালে। বর্তমানে রোগীর সংখ্যার তুলনায় যা অপ্রতুল। যদি জেলা শহরগুলোতে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো, তাহলে এই হাসপাতালসহ রাজধানীর অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ঢাকার রোগীদের চিকিৎসার চাপ অনেকটাই হয়ত সামাল দেয়া যেত।
প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। এমন বাস্তবতায় ঢাকার বাইরে থেকে নিয়ে আসা রোগীদের ভর্তির জন্য একের পর এক হাসপাতাল ঘুরতে হচ্ছে। আইসিইউ দূরের কথা, অক্সিজেনের জন্য সাধারণ বেড কোনো কোনো সময় মিলছে না। কিন্তু জটিল এসব রোগীদের বড় অংশই অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নয়। তাদের অসহায় হয়ে হাসপাতালের গেটে ধরনা দেয়া ছাড়া কিছু করার নেই।
চিকিৎসার জন্য স্বজনদের বিলাপ, আর রোগীর মৃত্যুযন্ত্রণার দৃশ্য যখন গণমাধ্যমে প্রচার হয় তখন বিশ্বে দেশের জন্য ভালো বার্তা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে চিকিৎসা পাওয়া একজন ব্যক্তির অধিকার। রাষ্ট্র সেই অধিকার পূরণে বাধ্য। তবে কেন রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে হবে? এর জবাব হয়ত সরকারের নীতি নির্ধারকরাই ভালো দিতে পারবেন।
বেসরকারি হাসপাতালে সহজেই চিকিৎসার জন্য এসব পরিবারগুলো পা বাড়ানোর সাহস করে না। কারণ সেখানে মোটা দাগের খরচ। রাত পোহালেই লাখ লাখ টাকা দরকার।
সময়ের প্রয়োজনে এখন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে সরকারি ব্যয়ে চিকিৎসা করানোর ঘোষণা দেয়া জরুরি। সরকার যেভাবেই হোক এসব হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারি নিয়মে ব্যয় নির্বাহের চুক্তি করতে পারে। তাহলে তো সাধারণ রোগীদের সঠিক চিকিৎসার জায়গাটি আরেকটু বেশি নিশ্চিত করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়াটি সারা দেশের বড় বড় বেসরকারি সব হাসপাতালের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।
পৃথিবীজুড়েই বিপর্যয়কালে একটি জাতির জন্য সবাই এক হয়ে কাজ করার নজির আছে। তাহলে আমরা কেন নয়? আশা করি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সরকারি নিয়মে কোভিড চিকিৎসাসেবা দিতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিলে তারা দ্বিমত করবে না। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকারের যে পরিমাণ ব্যয় হয় বেসরকারি হাসাপাতালগুলোতে সরকার সম পরিমাণ ব্যয় নির্বাহ করবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত এ ঘোষণা দেয়া সময়ের প্রয়োজন ও চাহিদায় করা জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জেলা হাসপাতালগুলোতে কোভিড চিকিৎসার পরিধি বাড়ানোর নির্দেশনা আমরা দেখেছি। তা দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন করার বিকল্প নেই। অক্সিজেন সরবরাহ ও আইসিইউ শয্যা বাড়ানো গেলে মৃত্যুসংখ্যা কমে আসবে। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা ও প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ কমিটির কারফিউ জারির পরামর্শ সরকারকে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। টিকা কার্যক্রম চলমান থাকলে মনে হয় এই দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও অন্তত এক মাসের বেশি সময় লাগতে পারে। এরমধ্যে কোভিড সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ার আশঙ্কা তো রয়েছেই। অন্যান্য দেশগুলোতে কিন্তু সরকার কঠোর হয়ে এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কঠোর লকডাউন, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা ও টিকা কার্যক্রম সমানতালে চালিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে রোগী বাড়ছে। কিন্তু কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। লাশ যেন রাস্তায় পড়ে না থাকে। একটি সিটের জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে রোগীর স্বজনদের আহাজারি করতে না হয়। শেষ কথা হলো কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর কিছু ভুল ত্রুটির জন্য এগিয়ে চলার বাংলাদেশ যেন থেমে না যায়।
লেখক: সাংবাদিক