‘গঞ্জে যখন আইলাম, চাচার নামে একটা মামলা দিয়া যাই’— বাঙালি সমাজের কিছু মানুষের মামলাবাজ চরিত্র বোঝার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো প্রবাদ হয় না।
সম্প্রতি অভিনেতা মোশাররফ করিমসহ আরও তিনজনের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকার মানহানি মামলা করেছেন এক আইনজীবী। কুমিল্লার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৬ নং আমলি আদালতে এই মামলা হয়। অভিযোগ ‘হাই প্রেসার-২’ নামের একটি নাটকে আইনজীবীদের হেয়প্রতিপন্ন করে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম। মামলায় বাকি তিন আসামি হলেন—অভিনেতা জামিল হোসেন, ফারুক আহমেদ, আদিবাসী মিজান। এছাড়া নাটকটি প্রচারিত হয়েছে যে বৈশাখী টেলিভিশনে, তার কর্তৃপক্ষকেও বিবাদী করা হয়েছে। তদন্তের পর আগামী ১৮ আগস্ট মামলার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।
স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ‘আই থিয়েটার’ নামক একটি অ্যাপে আংশিকভাবে মুক্তি পাওয়া ‘নবাব এলএলবি’ সিনেমায় ধর্ষণের শিকার এক নারীকে পুলিশের জেরা করার দৃশ্যে পুলিশকে হেয় করার অভিযোগে দায়ের করা পর্নোগ্রাফির মামলায় ছবিটির পরিচালক অনন্য মামুন এবং অভিনেতা শাহীন মৃধাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’ নামে একটি উপন্যাস লিখলে সেটি নিয়ে জীবদ্দশায় তাকেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। এর আগেও হুমায়ুন আহমেদ এরকম পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন একটি ধারাবাহিক নাটকে আফজাল হোসেনকে ‘বোকা ডাক্তার’ হিসেবে উপস্থাপন করে। তখন ডাক্তাররা সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ করেছিলেন।
সিনেমায় অশ্লীল সংলাপ (যদিও অশ্লীলতার ধারণা একেক দেশে একেকরকম) বা প্রদর্শনের অযোগ্য কোনো দৃশ্য (এটিও আপেক্ষিক। কারণ বিদেশের অনেক সিনেমায় এমন অনেক দৃশ্য থাকে যা বাংলাদেশের জন্য প্রদর্শন অযোগ্য বিবেচিত হতে পারে) থাকলে সেটির ছাড়পত্র না দেয়ার এখতিয়ার আছে সেন্সর বোর্ডের। কিন্তু নাটক বা সিনেমার কোনো দৃশ্যে কোনো একটি পেশার মানুষকে হেয় করা হয়েছে— এই অভিযোগে মামলা করা কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি তাই হয়, তাহলে সিনেমায় কেউ যখন খুন করেন, তখন খুনের দায়ে সেসব অভিনেতার বিরুদ্ধেই মামলা করা উচিত। এটা কি হাস্যকর নয়?
বাস্তব জীবন ও শিল্পের পর্দা বা ক্যানভাস এক নয়। যদি শিল্প সাহিত্যের বিরুদ্ধে এভাবে মামলা হতে থাকে, তাহলে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত নারীর নগ্ন শরীরের ছবি আঁকা হয়েছে, তার সব ছবির শিল্পীর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা হওয়া উচিত। অনেক নাটক-সিনেমায় সাংবাদিকদেরও নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই বলে সাংবাদিকদের তরফে কোনো নাটক সিনেমার পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। বস্তুত, চলচ্চিত্রে পুলিশ, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ নানা পেশার মানুষকে নানাভাবে উপস্থাপন করা হয়। এটা সব দেশের, সব ভাষার চলচ্চিত্রেই।
একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি) কেন্দ্রিক ‘বাণিজ্যিক’ সিনেমার শেষদৃশ্যে পুলিশের যে কমন বা অতি সাধারণ উপস্থাপন ছিল তা মোটামুটি এ রকম; খলনায়ককে পরাভূত করে নায়ক যখন পিস্তল হাতে নিয়ে গুলি করতে যাবেন, তখনই পুলিশের আবির্ভাব এবং দলনেতা বলেন, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ অসংখ্য সিনেমার শেষদৃশ্যে এই সংলাপ রয়েছে। আবার পুলিশের সাহসিকতা বা বিশেষ কোনো অভিযান নিয়েও প্রচুর সিনেমা হয়েছে।
সম্প্রতি রিলিজ হওয়া ‘মহানগর’ নামে একটি ওয়েব সিরিজের মূল চরিত্রই একজন পুলিশ অফিসার। একজন থানার ওসিকে কী ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়, কী ধরনের কৌশল নিতে হয়— তা তুলে ধরতে গিয়ে এমন সব সংলাপ ব্যবহার করতে হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে এগুলোকে পুলিশ বাহিনীর জন্য মানহানিকর মনে হতে পারে। এখন যদি পুলিশের তরফে এই ওয়েব সিরিজের পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বা কেউ যদি অতি উৎসাহী হয়ে মামলা করেন, সেটি যৌক্তিক নয়। কারণ কাহিনির প্রয়োজনেই এসব সংলাপ প্রয়োগ করতে হয়েছে।
প্রতিবেশী ভারতের অনেক সিনেমায় পুলিশের মুখ থেকে বা পুলিশ সম্পর্কে এমন সব সংলাপ ব্যবহার করা হয়, যার সিকি ভাগও বাংলাদেশের সিনেমায় ব্যবহার করা হয় না বা চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকরা সাহস করেন না। অথচ ভারতে কোনো সিনেমায় পুলিশ বা উকিলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়েছে— এমন অভিযোগে মামলা হয়েছে কিংবা পরিচালককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে— এমনটি শোনা যায়নি।
নাগরিকের বাকস্বাধীনতা আর শিল্পীর স্বাধীনতায় কিছু তফাৎ আছে। একজন কবি তার কবিতায় অনেক কিছুই বলতে পারেন। আবার কবিতা লেখার দায়ে রাজরোষে পড়ে অনেক কবিকে জেলও খাটতে হয়েছে। জীবনের ওপর হুমকি এসেছে। অনেক শিল্পীর অনেক ছবি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে শিল্পীর স্বাধীনতা কেউ অস্বীকার করে না।
ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন হিন্দুদের দেব-দেবীর নগ্ন ছবি এঁকে বেজায় তোপের মুখে পড়েছিলেন। আবার ইসলামের নবী ইব্রাহীম (আ.)-এর কোরবানি ইস্যুতে রেমব্রান্টের ছবি কিংবা যিশু ও মা মরিয়মকে নিয়েও বহু শিল্পী ছবি এঁকেছেন। কিন্তু এসব ছবির জন্য তাদের কারাগারে যেতে হয়নি।
এটা ঠিক যে, অশ্লীলতা ও বাকস্বাধীনতারও সীমারেখা রয়েছে। শিল্পীরা যেসব নগ্ন নারীর ছবি এঁকেছেন, সেখানে নির্দিষ্ট কোনো নারীর জীবদ্দশায় অনুমতি ছাড়া তার নগ্ন ছবি আঁকলে নিশ্চয়ই এর প্রতিবাদ বা মামলাও হতো। একইভাবে বাকস্বাধীনতার নামে শিল্পে যা খুশি বলা বা লেখা কিংবা আঁকাও রাষ্ট্র ও সমাজ অনুমোদন করে না। এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন-কানুন ও রীতিনীতির ওপর। যেমন ডেনমার্কের সদ্যপ্রয়াত কার্টুনিস্ট কার্ট ওয়েস্টারগার্ড মহানবীর ব্যঙ্গ কার্টুন এঁকে পুরো মুসলিম বিশ্বে বিতর্কিত হয়েছেন। এই ইস্যুতে অনেকের প্রাণও গেছে। কারণ এটি মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর একটি। সুতরাং এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে তীব্র। কারণ এখানে ওই কার্টুনিস্ট নির্দিষ্টভাবে মুসলমানদের নবীর কার্টুন এঁকেছেন। কিন্তু যে সিনেমায় বা যে নাটকে নির্দিষ্ট কোনো পুলিশ সদস্য বা নির্দিষ্ট কোনো আইনজীবীকে উপস্থাপন করা হয়নি, সেখানে মামলা করা বা পরিচালককে গ্রেপ্তার করা অন্যায্য, অযৌক্তিক। এটা মূলত শিল্পীকে ভয় দেখানো এবং তাদের যে ক্ষমতা আছে, সেটি জানানো।
সমস্যা এখানে সংলাপ বা দৃশ্যের নয়। সমস্যা ইগোর। সবশেষ যে নাটকে আইনজীবীদের বিকৃতভাবে উপস্থাপনের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে, সে বিষয়ে পুলিশ কী প্রতিবেদন দেবে বা বিচারক শেষ পর্যন্ত কী রায় দেবেন—তা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে আইনজীবী মামলাটি করেছেন, এটি তার অতি উৎসাহ। কারণ নাটকে কোনো নির্দিষ্ট আইনজীবীকে টার্গেট করে কিছু বলা হয়নি। এরকম আরও অনেক পেশার মানুষকেই নাটক সিনেমায় নানাভাবে উপস্থাপন করা হয়। এখানে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ আনাটাই হাস্যকর।
শুধু নাটক-সিনেমার দৃশ্য বা সংলাপই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি মামলার প্রবণতা দেখা যায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, ডিজিটাল প্লাটফর্মে কারো কোনো বক্তব্য মানহানিকর মনে হলেই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়া হচ্ছে। ফেসবুকে পোস্ট, কার্টুন, সংবাদ লেখা এমনকি শেয়ার করলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে।
গত বছরের ২৬ জুন একটি প্রথম সারির পত্রিকার খবরে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে মামলা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের বরাতে ওই খবরে বলা হয়, ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালে এই মামলার সংখ্যা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কটূক্তিমূলক’ পোস্ট দেয়া, পোস্ট শেয়ার করা, কার্টুন বা ব্যঙ্গাত্মক চিত্র আঁকা, ই-মেইলে যোগাযোগ করা এবং নিজেদের মধ্যে চ্যাট করার দায়ে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৮ জন ছিলেন সাংবাদিক।
গত ৩০ জুন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে একটি অনলাইন পোর্টালের খবরে বলা হয়েছে, ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পড়েছে ফেসবুক পোস্টের কারণে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৪। আর এ বছর মে পর্যন্ত সেটি দাঁড়িয়েছে ৬০টিতে। সম্ভবত ফেসবুকে পোস্ট দেয়া এবং তার শেয়ার করার কারণে পৃথিবীর আর কোনো দেশে এরকম গণহারে মামলা হয় না। আবার চাইলেও যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে মামলা করে দিতে পারে— এমন ব্যবস্থাও বোধ হয় খুব কম দেশেই আছে।
গত ৫ জুন একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়, দেশে বিচারাধীন মামলা ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার। খবরে বলা হয়, করোনা মহামারির কারণে নিয়মিত আদালতের বিচারকার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার। এ ছাড়া হাইকোর্টে প্রায় চার লাখ ৫৩ হাজার এবং আপিল বিভাগে ১৫ হাজার ২২৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের আদালতগুলোতে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি।
যে কারণেই মামলার জট লাগুক না কেন, পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশের আদালতে এত বিপুল পরিমাণ মামলা আছে কি না—সন্দেহ।
প্রশ্ন হলো কিছু মানুষ কেন এত মামলা দেয়? কেন ‘গঞ্জে যখন আইলাম চাচার নামে একটা মামলা দিয়া যাই’—এর মতো প্রবাদ তৈরি হলো?
এর একটি বড় কারণ প্রতিপক্ষকে হয়রানির বড় অস্ত্র হচ্ছে মামলা। একবার মামলা দিতে পারলে এবং পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করতে পারলে কেল্লাফতে! বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই মামলায় আসামিকে হাজিরা দিতে হবে। উকিলকে পয়সা দিতে দিতে অনেকে ফতুর হয়ে যান।
আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘ এবং সেখানে ক্ষমতাবান ও টাকাওয়ালারা নানারকম সুবিধা পায় বলে মামলার ভিকটিম হতে হয় সাধারণ মানুষকে। বিনাবিচারে বছরের পর বছর জেল খাটার উদাহরণও কম নয়। অর্থাৎ পুলিশ ভুল করে একজনকে গ্রেপ্তার করল এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি যে নিরপরাধ, সেটি প্রমাণ করতে করতেই হয়তো তার জীবনের বহু মূল্যবান সময় চলে যায়।
একসময় নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে কিংবা উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি হয়তো জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু জীবন থেকে যে সময় ও অর্থ চলে যায়, রাষ্ট্র তার ক্ষতিপূরণ দেয় না। সুতরাং একটি মানবিক ও সহনশীল মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গেলে কথায় কথায় মামলা দেয়া প্রতিরোধ করতে হবে। কেউ কিছু বললে, লিখলে বা নাটক সিনেমায় দেখালেই তার বিরুদ্ধে মামলা দিতে হবে, তাকে ধরে নিয়ে যেতে হবে—এ ধরনের প্রবণতা সমাজে বিভেদের দেয়ালকে শুধু উঁচুই করে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।