দেশের রাজনীতি যেমন স্থির হয়ে বসে থাকে না, তেমনি বিশ্বরাজনীতিও স্থির হয়ে বসে থাকে না। প্রতিনিয়ত এর পরিবর্তন ঘটে। তবে বিশ্ব রাজনীতি পরিবর্তনের সমীকরণগুলো সব সময়ই বড় বড় শক্তিকে কেন্দ্র করে ঘটে। আর ছোট ছোট দেশকে সেদিকে তাকিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নিজের পা ফেলতে হয়।
এ মুহূর্তে বিশ্বরাজনীতি পরিবর্তনের সব থেকে বড় ইঙ্গিত চায়না ও রাশিয়ার একজোট হওয়ার চেষ্টা। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে চায়না ও আমেরিকা একজোট হওয়াতে বদলে গিয়েছিল বিশ্বরাজনীতি। ১৯৭১ সালে চায়নায় পা রেখেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন। সেদিন হ্যান্ডশেক হয়েছিল মাও দেজ দং ও নিক্সনের মধ্যে। আর তার ফলেই দ্রুত বদলে যেতে থাকে পৃথিবীর রাজনীতির সমীকরণ।
আর সমীকরণ বদলের হিসাব-নিকাশের ভেতর সেদিন বাংলাদেশও পড়েছিল। কারণ, এ দেশের মানুষ জানে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমেরিকার জনগণ আমাদের পক্ষে ছিল। মেজরিটি সিনেটর আমাদের পক্ষে ছিল। সিভিল সোসাইটি এবং শিল্পীসমাজও ছিল আমাদের পক্ষে। সর্বোপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অংশ। তারপরেও সমগ্র গণতান্ত্রিক পৃথিবীর বিপরীতে গিয়ে সেদিন আমেরিকা বিশেষ করে নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশের সংগ্রামের বিপরীতে ছিল। এই বিপরীতে থাকার একটি বড় কারণ ছিল চায়নার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক স্থাপন। এই সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যস্থতাকারী ছিল পাকিস্তান।
অপরদিকে চায়না আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করলে চায়না ও আমেরিকার মধ্যে যে নতুন সম্পর্ক স্থাপন হতে যাচ্ছিল, তখন তাতে কোনো ক্ষতি হতে পারে, এমনটি মনে করেছিল নিক্সন প্রশাসন। আর যে যে কারণে আমেরিকা সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি, তার অন্যতম একটি ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওই নতুন সম্পর্ক। অর্থাৎ চায়না-আমেরিকা সম্পর্ক। মাও-নিক্সন হ্যান্ডশেক। আর এই হ্যান্ডশেকের ফলেই আমেরিকার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল মাত্র দুই দশক পরে তার প্রবল প্রতাপশালী প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাসের ঘরের মতো ভেঙে দেয়া।
এর পরে পৃথিবীতে অযুত নিযুত দিন সূর্য উঠেছে ও অস্ত গেছে। আর তার ভেতর পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তনের ধারা বেয়ে আজ ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় অংশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন পা রাখবেন চায়নার মাটিতে। অর্থাৎ নিক্সন-মাও হ্যান্ডশেকের ঠিক পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে সেই চায়নার মাটিতে এবার নতুন হ্যান্ডশেক হবে। পুতিন হ্যান্ডশেক করবেন জি জিংপিংয়ের সঙ্গে।
চায়না মনে করছে, নিক্সনের সেই মাওয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেকের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে পুতিনের এই জি জিংপিংয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেক বিশ্বরাজনীতিতে একটি অনেক বড় ঘটনা হবে। শুরু হবে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে নতুন সমীকরণ। এটাও ১৯৭১-এর মতো একটি নতুন যুগের সূচনা করবে চায়না ও পৃথিবীর জন্য। তবে একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করতেই হয়, ১৯৭১ সালে নিক্সনের চায়না যাওয়ার আগ পর্যন্ত সব কাজ ঘটে গোপনে। এমনকি নিক্সনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের মতো মানুষও পাকিস্তান হয়ে গোপনে চায়নায় গিয়েছিলেন। আর এর বিপরীতে ২০২১ সালে সবকিছুই ঘটছে প্রকাশ্যে।
রাশিয়া ও চায়না যে পরস্পর কাছে আসার চেষ্টা করছে তা নিয়ে কোনো রাখঢাক এখন নেই। কারণ বেশ কিছুদিন যাবৎ চায়না ও রাশিয়া মিডলইস্টের লেবাননে তাদের তেল অর্থনীতিতে পা রাখার চেষ্টা করছে। ঘটনার নানান কিছু বিশ্লেষণ করলে এখানে বোঝা যায়, রাশিয়া ও চায়নার এই লেবাননে প্রবেশে অনেকখানি সাহায্য করেছে মিডলইস্টে এই দুই দেশের পুরোনো মিত্র ইরান।
ইরানের তেল অর্থনীতিতে চায়না ও রাশিয়া অনেক বেশি পা রাখতে পেরেছে; এবং যা ইরানকে আমেরিকার সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলতে বেশ শক্তি জোগাচ্ছে। এখন ইরান চাচ্ছে ও সহযোগিতা করছে লেবাননের তেল অর্থনীতিতে রাশিয়া ও বিশেষ করে চায়না ভালোভাবে পা রাখুক। লেবাননের তেল অর্থনীতি মূলত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে। এখন যদি সেখানে চায়না ও রাশিয়া পা রাখতে পারে, তাহলে লেবাননে ইউরোপীয় এই কোম্পানিগুলোর একাধিপত্য কমে যাবে। যা প্রকারান্তরে আমেরিকার পায়ের পাতাকেও দুর্বল করবে। কারণ এই কোম্পানিগুলো আমেরিকার মিত্র দেশের। ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর ফলে মিডলইস্টে আমেরিকার অবস্থান দুর্বল হবে।
ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যতটা আশা করছে, বাস্তবে ঘটনা ততখানি হবে না। কারণ, প্রথমত মিডলইস্টে সৌদিসহ অনেক দেশের এ মুহূর্তে কোনো উপায় নেই আমেরিকার বাইরে যাওয়া। তা ছাড়া লেবাননে চায়না ও রাশিয়া তেল-অর্থনীতিতে পা রাখলেও এ দুই দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করেই চলবে। প্যালেস্টাইনকে সমর্থন করবে না আন্তর্জাতিক ফোরামে। সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার সময়েও তারা করেনি।
তাই এ দুই দেশ আমেরিকাকে হয়তো কিছু পরিমাণ অর্থনৈতিক স্বার্থ থেকে সরাতে পারে মিডলইস্ট থেকে, তবে মিডলইস্টের রাজনৈতিক সমীকরণের খুব কোনো পরিবর্তন হবে না। তারপরেও লেবাননে প্রবেশ রাশিয়ার থেকে চায়নার একটি বড় অর্জন। লেবানন ছাড়াও চায়না ও রাশিয়া কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে আফগানিস্তান নিয়ে। সেখানে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হতেই তালেবানরা তাদের ২০ বছর আগের রূপে ফিরে এসেছে। প্রায় অধিকাংশ আফগানিস্তানের ভূমি এখন তালেবানদের দখলে। তাই আফগানের রাজনীতিকে স্থিতিশীল করতে রাশিয়া ও চায়নার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইতোমধ্যে মিটিং হয়েছে।
কারণ আফগানে চায়না ও রাশিয়া এই দুই দেশেরই স্বার্থ আছে। তবে আফগান থেকে আমেরিকার এই সৈন্য প্রত্যাহার মোটেই মানবিক কোনো বিষয় নয় এ এক নতুন রাজনীতি। এ রাজনীতির সমীকরণ হিসাব এ মুহূর্তে হয়তো কিছুটা করা যায়, তবে এ মুহূর্তে সব থেকে বড় হলো আসলে এর গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যায় তার জন্য অন্তত নভেম্বর অবধি অপেক্ষা করা। তবে আমেরিকা আফগানে সৈন্য পাঠানোর পরে এই তালেবানদের সহায়তা করা শুরু করে প্রথমে ইরান ও পরে রাশিয়া তার সঙ্গে যোগ দেয়। এখন এই তালেবান আবার আগের মতো আমেরিকার হাতে ফিরে যাবে কি না, তাও এখন দেখার বিষয়। কারণ, মৌলবাদ নিয়ে খেলা আমেরিকার অনেক পুরোনো কৌশল।
অপরদিকে আমেরিকা কিন্তু এ মুহূর্তে মোটেই বিনা যুদ্ধে রাশিয়াকে চায়নার হাতে ছেড়ে দেবে না। ইতোমধ্যে পুতিন-বাইডেন কথা হয়েছে। তা ছাড়া আমেরিকা ও রাশিয়া ট্রাম্পের আমলের মতো না হলেও তাদের মধ্যে বেশ একটা সম্পর্ক রেখে এগিয়ে যেতে চায়। আর তা রাশিয়ার জন্য প্রয়োজনও; ৭১ সালে আমেরিকার চায়নাকে যতখানি প্রয়োজন ছিল, এখন রাশিয়ার ঠিক চায়নার অতটা প্রয়োজন নয়। তাই চায়নাতে যতই পুতিনের সফর নিয়ে উৎসাহ দেখা যাক না কেন, এখানে ৭১-এর নিক্সন-মাওয়ের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে না। তবে নিঃসন্দেহে রাজনীতির এই নতুন সমীকরণটা অনেক জটিল।
আর জটিল সমীকরণ থেকে বাংলাদেশকেও শতভাগ বাইরে থাকার কোনো উপায় নেই। কারণ, আফগানিস্তানে তালেবান শক্তিশালী হওয়া মানেই ভারত ও বাংলাদেশে জঙ্গিরা শক্তিশালী হওয়া। এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক বড় বড় দুর্ঘটনায় পড়তে হবে। গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি ও বোম্বের তাজ হোটেলের পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
আর সেখানে ভারত ও বাংলাদেশের জঙ্গিদের একটা মিলিত চেষ্টা দেখা যাবে। অপরদিকে মিডলইস্টের রাজনীতিতে বাংলাদেশের জন্য লাভ হলো সৌদির পক্ষে থাকা। সেখানে সৌদি সব সময়ই থাকবে আমেরিকার পক্ষে। আবার এর বিপরীতে চায়না ও রাশিয়ার যে সম্পর্ক হবে তার প্রভাব বাংলাদেশে কতটা পড়বে, সেদিকেও বাংলাদেশকে নজর রাখতে হবে। কারণ, চায়না ও রাশিয়া এই দুই দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের রয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক। যদিও বাংলাদেশের ওইভাবে কোনো রপ্তানি নেই এ দুই দেশে। বাংলাদেশের রপ্তানি আমেরিকা ও ইউরোপে সব থেকে বেশি। তাই নতুন সমীকরণে বাংলাদেশকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার অর্থনৈতিক স্বার্থের সব দিক মাথায় রেখে।