বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম কী? (উত্তর: তাজউদ্দীন আহমদ)। প্রতিযোগিতামূলক কিছু পরীক্ষায় এমন একটি প্রশ্নের উপস্থিতি মাঝে-মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের সমকালীন আলোচনায় তাজউদ্দীন আহমদ মনে হয় এক ‘অপাঙক্তেয়’ চরিত্রে পরিণত হতে চলেছেন। কোথাও যেন তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আজ তার জন্মদিনে তাজউদ্দীনকে খুঁজে বেড়াই। দলমত নির্বিশেষে দেশের গণ্যমান্য মানুষেরা তাজউদ্দীন আহমদের কথা উঠতেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। কিন্তু গণমাধ্যমসহ অন্য কোথাও তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে তাদের দুই কলম লেখা কমই চোখে পড়ে।
আজ ২৩ জুলাই। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশের অন্যতম সফল প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশই অস্থিত্বহীনতায় ভুগছিল। ঠিক সেই সময়ে ভারতে গিয়ে ভারতসহ অন্যান্য দেশের সহযোগিতায় মাত্র নয় মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাকে সঙ্গে করে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
১৯২৫ সালে জন্ম নেয়া তাজউদ্দীন আহমদ স্বাভাবিক জীবন পেলে আজও হয়তো তাকে জীবিত পাওয়া যেত। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার সময় তাজউদ্দীন আহমদ দল এবং সরকারের কোনো পদে ছিলেন না। বাংলাদেশে যুগে যুগে কিছু প্রধানমন্ত্রী এসেছেন, আসবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধজয়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন একজনই আছেন, থাকবেন।
মহান রাজনীতিবিদদের প্রতি আমাদের নজর কমই পড়ে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলোর মধ্যে কোন দিবসগুলো কী মর্যাদায় পালন করা হবে তার একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকাটি সর্বশেষ আপডেট হয়েছে। আগে থেকেই জানি এ তালিকায় তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন নেই। খুব আশা নিয়ে তালিকাটি খতিয়ে দেখতে থাকি, ৩ নভেম্বর অবশ্যই থাকার কথা। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চারনেতাকে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা বিশ্ব ইতিহাসেই নজিরবিহীন ঘটনা। আশাহত হতে হলো। ক, খ ও গ মর্যাদার সরকারি কোনো তালিকাতে তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চারনেতার কারো জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষিকীর কোনোটাই নেই। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে এসব দিবসও বাংলাদেশে বদলে যায়। মহান এই নেতার জন্ম অথবা মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয় তালিকায় উঠলে তালিকাটির সম্মান বৃদ্ধি হবে বললে অত্যুক্তি হবে না।
তাজউদ্দীন আহমদ টানা ছয় বছর বেশি সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর আগে দলে সম্পাদকীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৬ সালে মুজিব-তাজউদ্দীন জুটি যখন থেকে যাত্রা শুরু করলো তখন থেকেই মূলত আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে একক জায়গা করে নিতে শুরু করে। এর পরিণত ফল দাঁড়ায় ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক বিজয়। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-বাংলাদেশ পাই আমরা।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে সরকার বুঝিয়ে দিয়ে শুধু দলে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লিডার তথা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি সরকারে থাকেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দায়িত্ব নেন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর। মন্ত্রিসভায় তাজউদ্দীন এক পর্যায়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
যতদিন সরকারে ছিলেন ততদিন যত মতানৈক্যই থাকুক বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার অকৃত্রিম শ্রদ্ধার ঘাটতি দেখাননি। তার বড় প্রমাণ তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভা থেকে নিজে পদত্যাগ করেননি। তাজউদ্দীন আহমদ যে উঁচুমাপের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা মুহূর্তের সিদ্ধান্তেই মন্ত্রিত্ব ছাড়তে পারতেন। কিন্তু তাজউদ্দীন জানতেন, তিনি পদত্যাগ করলে একদিকে তার লিডারের প্রতি অশ্রদ্ধা হয়। অপরদিকে মন্ত্রিসভা দুর্বল হয়। এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু লিখিত নির্দেশে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
পদত্যাগের পরও তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল ছিলেন। তিনি বাকশাল সমর্থন করেননি। কিন্তু বঙ্গন্ধুর প্রতি কখনো বিশ্বাস হারাননি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক সরকারের মন্ত্রিত্বের অলংকার পায়ে ঠেলে জেলে গিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন তাজউদ্দীন কতটা আপসহীন ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় থাকার সময়েই মোশতাক গং তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে নানান অপবাদ ছড়িয়েছে। মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পর গুজবের ডালপালা মেলেছে। ওই সময়ের উদীয়মান রাজনৈতিক দল জাসদ তাকে নেতা হিসেবে চেয়েছে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ নির্মোহ থেকেছেন। কারণ তিনি জানতেন ইতিহাসে তার কর্তব্য সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। তার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে, বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছে নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র। একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য এর চেয়ে বড় কী প্রাপ্তি থাকতে পারে। সেই প্রাপ্তিও তাজউদ্দীনের ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। এত বড় ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের সময়েও তাজউদ্দীন আহমদ তার সহকর্মীদের বলতেন, এমনভাবে কাজ করুন যাতে ইতিহাস আমাদের খুঁজে না পাওয়া যায়। এমন নির্মোহ একজন নেতার কথা দেশের সব প্রজন্মের জানা দরকার। এজন্যই তাজউদ্দীনকে খোঁজার চেষ্টা।
যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে চরম সংকটাপূর্ণ পরিস্থিতিতে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল। ভারতের সহযোগিতায় সরকার গঠন ও যুদ্ধ পরিচালিত হলেও অনেক বিষয়ে স্বস্তিতে থাকার উপায় ছিল না। সব ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরূপতা পরাজিত করে ইতিহাসের আলো নিজেদের দিকে টানতে সফল হয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধকালে তাজউদ্দীন আহমদকে কতটা বিপৎসংকুল পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে তার ছোট একটি নমুনা পাওয়া যায় রাশেদ খান মেনননের সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘এক জীবন, স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ (প্রথম পর্ব) বইয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘খোন্দকার মোশতাকের এ রকম ভূমিকার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানদের ভূমিকাও পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় তারা মুক্তিবাহিনীর সমান্তরাল বাহিনী গড়ে তুলেছিল।... সেটা নিয়ে প্রবাসী সরকার ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বিএলএফের একটা মুখোমুখি অবস্থা দাঁড়িয়ে যায়। অন্যদিকে একই সময়কালে সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের একটি বিশেষ বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমর্থনে ট্রেনিং শুরু করেছিল।... সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে একটা বিভেদ-বিসংবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।’ এমনসব ভয়ংকর বিভেদরেখার মতো অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চ্যলেঞ্জগুলো অভতূপূর্ব দক্ষতায় সামলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যুদ্ধের মূলধারার নেতৃত্ব দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ষড়যন্ত্রকারীদের সফলতায় আবারও দুর্বল হয়ে যায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ যাত্রার শুরু সময়েই দেশ হিসেবে দুর্বল হয়ে পড়ার দুইটি কারণ চিহ্নিত করেছেন লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। ‘বেলা-অবেলা, বাংলাদেশ ১৯৭২-১৯৭৫’ শীর্ষক গ্রন্থে মহিউদ্দিন আহমদের মন্তব্য ‘প্রথমটি হলো দলের মধ্যে গৃহদাহ- পরিণতিতে বিভক্তি। দলের মূল চালিকাশক্তি তরুণদের একটি বড় অংশ আওয়ামী বৃত্তের বাইরে গিয়ে আলাদা সংগঠন (জাসদ) তৈরি করল এবং ধীরে ধীরে তা হয়ে উঠল আওয়ামী লীগের প্রবল প্রতিপক্ষ।...আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় বিয়োগান্ত ঘটনাটি হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্বদানকারী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেপথ্যে চলে যাওয়া এবং দলের মধ্যে ক্রমে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়া। ১৯৬৬ সাল থেকেই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দলের শীর্ষনেতা হলেও সাংগঠনিক বিষয়গুলোতে তাজউদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। বাহাত্তরের শুরু থেকে এই ছন্দটি আর থাকল না, কোথায় যেন তাল কেটে গেল।’
তাজউদ্দীন আহমদ সময়ের অনেক আগেই জন্মেছিলেন। আমরা তাকে খুঁজি বা না খুঁজি। বাঙালির পরম আরাধ্যের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব তাকে ইতিহাসে অমর করেছে। উপমহাদেশের অতুলনীয় রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধুকেই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের অবদান তো মুছে ফেলার নয়। কোনো না কোনোভাবে ফিরে আসেই। তাজউদ্দীন আহমদের ক্ষেত্রেও হয়তো একদিন এমন হবে।
লেখক: সাংবাদিক।