মুসলমান সমাজের সবচেয়ে বড় দুটি উৎসবের অন্যতম ঈদুল আজহা যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যেই পালন করেছে বাংলাদেশ। অতিক্রান্ত ঈদের পূর্বাপর যদি সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় তাহলে ত্যাগের মহিমা যে আমরা যথাযথভাবে অনুসরণ করিনি অপ্রিয় হলেও সে সত্যই চোখে পড়বে।
এবারের ঈদের নামাজ শেষে সবচেয়ে বড় প্রার্থনা ছিল করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে মুক্তির। প্রার্থনার সঙ্গে মানুষকে কর্মও করতে হয়। তাই করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর মতো সব কাজ করে আমরা যদি করোনা মুক্তির প্রার্থনা করি, তা কতটুকু কবুল হবে বলা মুশকিল।
বছরের দুটি ঈদ আমাদের জন্য দুই ধরনের শিক্ষা রেখে যায়। ঈদুল ফিতরে আমরা এক মাসের সংযমের পরীক্ষা দিয়ে শেষ দিবসে ঈদুল ফিতর উদযাপন করি। ঈদুল আজহার শিক্ষা সবচেয়ে প্রিয়বস্তু ত্যাগের। যে শিক্ষা নবী ইব্রাহিমের আমল থেকে আমরা অনুসরণ করে আসছি। কিন্তু এই শিক্ষা আমরা কতটা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করি, সেটাই ভাববার বিষয়। ভোগবাদী সমাজে ত্যাগের চেয়ে ভোগের লিপ্সাটাই প্রবল। যে কারণে আমরা অনেক সময় সাধারণ পরিমিতি জ্ঞানও হারিয়ে ফেলি। এটি উৎসব আয়োজনে বেশি চোখে পড়ে। কোরবানি ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হলেও করোনা কালের ঈদে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অসংযমী আচরণ করলাম। তাই অতিক্রান্ত ঈদে যতটুকু আনন্দ উপভোগ করেছি ঈদের শেষে এখন আনন্দের চেয়ে শঙ্কাটাই প্রবল হয়ে উঠেছে।
গতবছরও করোনার মধ্যেই ঈদুল আজহা ৩০ (জুলাই) উদযাপিত হয়েছে কিন্তু বছরের ব্যবধানে করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার ভয়ংকর। এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেই ঈদুল আজহা উপলক্ষে শিথিল করা হয়েছিল কঠোর লকডাউন
১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত বাস, ট্রেনসহ নৌযান এবং শপিংমলসহ সবধরনের মার্কেট খুলে দেয়া হয়। কিন্তু ভেবে দেখুন কী ভয়াবহ আচরণই না আমরা সেই মুক্ত অবস্থায় করলাম! মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্বর ধার অনেকেই ধারিনি! কোরবানির পশুর হাটে করোনার সিমটম নিয়ে গিয়ে পরীক্ষায় পজিটিভ ধরা পড়েছি অনেকে। রাজধানীর বাইরে এই পরীক্ষা কতটা হয়েছে জানি না।
করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, তা যে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে, এরই মধ্যে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
যারা গ্রামে গিয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ এক দুদিন থেকে ইতোমধ্যেই ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের কর্মস্থলে ফিরে গেছেন।
আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর লকডাউন। যাদের ফিরতেই হবে নিরুপায় হয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু গ্রামে রয়ে গেছেন অনেকেই।
ভয়টা সেখানেই। যারা গ্রাম থেকে ফিরে এসেছেন তাদের নিয়ে যেমন ভয়, যারা গ্রামে রয়ে গেলেন, তাদের নিয়ে আরও বড় ভয়।
এর কারণ কারো অজানা নয়। গত দুমাস ধরে করোনা পরিস্থিতির যে ভয়াবহ বিস্তার, এই চিত্র তো আমাদের দেখতে হতো না, যদি আমরা দায়িত্বশীল আচরণ করতাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সবকিছু খোলা পেয়ে যাতায়াতে আমরা অনেকেই সেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিইনি। অবিবেচকের মতো ঈদুল ফিতর উদযাপনের জন্য গ্রামের পথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই।
রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে যে এমন ঝাঁপিয়ে পড়া পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, সেই আশঙ্কা থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শহর থেকে মানুষের গ্রামে যাওয়ার প্রবণতা রুখে দেবার জন্যই লকডাউন বহাল রেখেছিল মে মাসে।
বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বাস, ট্রেনসহ সব ধরনের গণপরিবহন। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সংযমী হতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, একটিবার অন্তত গ্রামে না গিয়ে ঈদ নিজ নিজ কর্মস্থলে করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই অনুরোধ সত্ত্বেও বেপরোয়া ঘরমুখো মানুষকে সেই লকডাউনের বিধি নিষেধ মানানো যায়নি।
হয়তোবা সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থেকেই এবার আগেই সব খুলে দেয়া হয়েছিল যাতে মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শান্তিপূর্ণ ঈদযাত্রা করতে পারে।
পরিতাপের বিষয় বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানেনি, সামাজিক দূরত্বেরও ধার ধারেনি। পশুরহাট বসার সিদ্ধান্ত দেয়ার আগেই রাজধানীসহ বহু জায়গায় বসে গিয়েছিল কোরবানির পশুর হাট। আর সিদ্ধান্ত দেয়ার পর সারা দেশের পশুহাটের যে ভয়ংকর চিত্র টিভিসহ নানা সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়েছিল, তাতে এই ঈদের পরে করোনা পরিস্থিতি কত ভয়ংকর হবে, এখন তা ভাবতেও ভয় করছে!
হাজার হাজার মানুষ নেমে পড়েছিল সারা দেশের পশুর হাটগুলোতে। অধিকাংশের মুখে ছিল না মাস্ক, ছিল না সামান্য দূরত্বও। যাদের মাস্ক ছিল তাদেরও হয় চিবুকের কাছে, না হয় গলায় ঝুলেছে! লকডাউন শিথিলের ৮ দিন ঈদের যানবাহন যাতায়াতের জন্য যে পাঁচটি শর্ত দিয়েছিল বিআরটিএ, তাও মানেনি অধিকাংশ গণপরিবহন। মনিটরিংয়ের দৃশ্যও চোখে পড়েনি তেমন একটা।
এই অবস্থায় গ্রামে যারা গেছেন তারা কী নিয়ে গেছেন আর যারা ফিরে এলেন, তারাইবা কী নিয়ে ফিরলেন, তা বুঝতে হয়তো আরও সপ্তাহ দুই-তিনেক অপেক্ষা করতে হতে পারে। শহর থেকে ঈদ করতে গিয়ে গ্রামে যারা এখন আছেন, তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রাবণের লঙ্কায় হনুমানের লেজের আগুনের মতো তা ছড়িয়ে পড়বে আরও বহুগুণ লেলিহান হয়ে। আর যারা ফিরে এসেছেন, তারাইবা কতটা আইসোলেশন মেনে চলবেন তা কে জানে!
অথচ এদের কঠোর মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখা দরকার ছিল। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? সবকিছু সরকারের পক্ষে করা কতটা সম্ভব, বিবেকবান মানুষমাত্রই তা উপলব্ধি করবেন। এই দুর্যোগে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল আত্মসচেতনতা আর সর্বাত্মক সামাজিক ভূমিকা। এজন্যে গ্রামগঞ্জে রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের অঙ্গ ও শাখা সংগঠন এবং তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা যদি সচেতনভাবে সক্রিয় দায়িত্ব নিতেন, সেটা সংক্রমণরোধে হতো একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। শহরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
যাহোক আজ শুক্রবার থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। এই ঘোষণা বাস্তবায়ন করা খুব সহজ নয়। এর সঙ্গে বহু মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন।
বিশেষ করে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের কথা মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রেও সরকারি সহায়তা ও নতুন সিদ্ধান্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বিত প্রয়াসও জরুরি। লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকর করা মানে কেউ বাড়ি ঘর থেকে বের হবে না কিন্তু দিনমজুর, রিকশাচালকসহ সমাজের অতিদরিদ্র মানুষের খাবারের কী হবে? সরকারের একার পক্ষে সবাইকে কাভার করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দল এবং তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো কি পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান করবেন?
কঠোর লকডাউন গত রোজায়ও আমরা দেখেছিলাম। মাত্র একদিন কার্যকর হয়েছিল। যেদিন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তা কার্যকর করতে নেমেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে আর তা সেভাবে কার্যকরের চিত্র দেখা যায়নি। কঠোর লকডাউনের মধ্যে গত রোজার ঈদে আমরা যা দেখেছি তারপর আর আস্থা পাচ্ছি না ১৪ দিন কঠোর লকডাউনের সুফল প্রাপ্তির বিষয়ে।
গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যখন ঈদুল ফিতর উদযাপনের জন্য সমস্ত বিধিনিষেধ- এমনকি লকডাউন অগ্রাহ্য করে মানুষ যানবাহনহীন পরিবেশেও পায়ে হেঁটে অনেক দুর্যোগ মাথায় নিয়ে চরম কষ্ট সয়ে বাড়ি ফিরছিল, তখনই বোঝা গিয়েছিল একটা চরম বিপর্যয় আসন্ন। বাস ট্রেন লঞ্চ সব বন্ধ। চালু ছিল শুধু জরুরি অ্যম্বুলেন্স, ওষুধ, লাশের গাড়ি, খাদ্যপণ্যসহ নৌরুটের ফেরিগুলো। আর তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জীবনের ঝুঁকি নেয়া হাজার হাজার মানুষ!
তার ওপর করোনার কথাও ভুলে যাওয়া! কোথায় মাস্ক! কোথায় কীসের দূরত্ব! প্রবল ভিড়ের চাপে পরস্পর পিষ্ট হয়ে দেশের প্রত্যন্ত জনপদের মানুষ বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামে গিয়েছিল ঈদ করতে।
তখনই চিকিৎসাবিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাস ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। সব সংবাদমাধ্যম, সামাজিক নেটওয়ার্কে সেই ভয়ংকর ঈদযাত্রার চিত্র দেশবাসী দেখেছে। গত দুমাস তারই বিষফল ভোগ করতে হচ্ছে দেশবাসীকে।
ঈদুল ফিতরের সেই যাত্রায় যারা শহর থেকে স্বজনদের সঙ্গে আনন্দে ঈদ করতে গ্রামে গিয়েছিলেন, তারা তো আসলে আনন্দ নয়, স্বজনদের জন্য চরম সর্বনাশই নিয়ে গিয়েছিলেন। যে বাবা-মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়ে ঈদ পালন করেছিলেন, তাদের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে অকালে ইহলোক ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে এখনও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিদিন ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে।
রোজার ঈদের পর ২/৩ সপ্তাহের মধ্যেই সারা দেশে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। একদিনে রেকর্ড ২৩০ জনের প্রাণহানি এবং কয়েক হাজার মানুষের সংক্রমণও দেখতে হয়েছে। সেই চিত্র দেখে দেখে সারা দেশ আজও আঁতকে উঠছে।
মে মাস পর্যন্ত রাজধানীসহ বড় বড় শহর-নগরে করোনার ঝুঁকি থাকলেও গ্রামবাংলা ছিল মোটামুটি নিরাপদ। কিন্তু অতি-উৎসাহী স্বজনদের গ্রামে গিয়ে ঈদ উদযাপনের বিবেচনাহীন আকাঙ্ক্ষা গ্রাম-বাংলাকে ভয়াবহ সংক্রমণে তছনছ করে দিয়েছে! প্রতিদিন সেই সংক্রমণেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতালে ধুঁকে ধুঁকে মরার মর্মান্তিক দৃশ্য আমরা টেলিভিশনে, সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং সংবাদমাধ্যমে এখনও প্রত্যক্ষ করছি।
স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন! কিছুতে পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না। বিপুলসংখ্যক করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণও নেই সেখানে।
এই দুঃসময়ে প্রাথমিকভাবে গ্রামের মানুষকে বাঁচাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো। কিন্তু সেগুলোর অবস্থাও তেমন ভালো নেই। দেশের অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার নিয়োগ দেয়া থাকলেও কর্মস্থলে মাসে দশদিনও পাওয়া যায় না তাদের। কাজ চালায় আয়া আর ওয়ার্ডবয়! পাঁচটি উপজেলার চিত্র তুলে ধরে একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় যখন শিরোনাম হয় ‘যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দী; নষ্ট অ্যাম্বুলেন্স’ তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিকিৎসার চিত্র অনুমান করতে কারো অসুবিধা হয় না।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার যা, তা দুই মাস আগেও কেউ কল্পনা করেননি। ভারতের ভয়াবহ বিপর্যয় দেখেও আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত ছিল। পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে কী করবেন, তৃণমূল পর্যায়ে তার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত ছিল। এই প্রস্তুতিটা নেয়ার কথা ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ দূরের ভাবনা যেন ভাবতে চান না অথবা ভাবতেই পারেন না। তাই এত বড় বিপর্যয় আজ।
বাস্তবতা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী যত মমতায় আন্তরিকতায় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করছেন, তার স্বাস্থ্য প্রশাসন তত দয়ালু মনে হয় না। তারা কাঙ্ক্ষিত গতিশীলতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করতেই পারছে না, অথবা করছে না। প্রশাসন এবং রাজনীতির তৃণমূলের সবক্ষেত্রেই এই ভয়াবহ বৈপরীত্যের চিত্র! লাইভ মিটিংয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীকে যত আশ্বাস দেন, বাস্তবায়নে ততটা নয়!
বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আকাঙ্ক্ষার মতো করে সবাই একই আন্তরিকতায় এগিয়ে এলে আরও অনেক সুফল পাওয়া যেত। কী নিষ্ঠুর অসততা!
মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশের প্রতিটি সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র পরিবারের জন্য একটি করে বাসস্থান করে দেয়া। সেই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণকালের প্রশংসনীয় মানবিক প্রকল্পও বদনামের মুখে পড়ল! এত বড় মহৎ আকাঙ্ক্ষা কলুষিত হলো গুটিকয় কর্মকর্তা আর স্থানীয় রাজনৈতিক অসততাজনিত ব্যর্থতায়!
পরিতাপের বিষয়, ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত জাতির পিতাকেও একই অবাঞ্ছিত বাস্তবতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতাদের কারো কারো অসততা আর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক মানসিকতার আমলাতন্ত্রের কাজকর্মে, বৈরিতায় তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না কিছুতেই। চরম অস্বস্তিতেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সাড়ে তিন বছরের পুনর্গঠনের কাজ করছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আজ যুদ্ধাবস্থা না হলেও করোনা মহামারির সংক্রমণে ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে দেশকে। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বহু ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে হচ্ছে সরকারি তহবিল থেকে। সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনী ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হচ্ছে। এরকম সংকটে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সততা, কর্মনিষ্ঠা ছাড়া মানুষের দুর্ভোগ মোচনের কোনো উপায় নেই।
এই দুর্যোগ পাড়ি দিতে হলে আমাদের অনেক দূরে তাকাতে হবে। কত বছর এই করোনা পরিস্থিতি থাকবে, এখনই তা বলা মুশকিল। মনুষ্যসৃষ্ট এই ভয়ংকর ভাইরাস! একে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক একটি চক্র একযুগ আগে থেকে ব্যবসার ফাঁদ নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল বলে যে অভিযোগ সম্প্রতি উঠেছে, সে তথ্য এরই মধ্যে গণমাধ্যমে চাউর। সত্য-মিথ্যা যাচাই করবে ভবিষ্যতের গবেষণা। কিন্তু ভয়ংকর একটা কিছু যে ঘটে গেছে যার শিকার পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ। তিন কোটি মানুষ এই ভাইরাসে মারা যেতে পারে বলে এক দশক আগেই অপ্রকাশিত গোপন গবেষণার তথ্য সম্প্রতি সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এর সত্যতা যাচাই করবেন আগামী দিনের গবেষকরা। কিন্তু মানবতাহীন নৃশংস বাস্তবতার মুখোমুখি যে আজ গোটা পৃথিবী। এই নির্মম সত্য তো উপেক্ষা করার উপায় নেই।
ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করে আমরা প্রতীকীভাবে মনের পশুত্বকে কোরবানি করি, প্রিয় বস্তু ত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ করি। এই শিক্ষাটাই নবী ইব্রাহিমকে প্রিয় সন্তান কোরবানির আদেশ দিয়ে আল্লাহ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই ত্যাগের শিক্ষাটা যদি সবক্ষেত্রে আমরা গ্রহণ করতে পারতাম, তাহলে অনেক বড় বিপর্যয়ও সহজে অতিক্রম করা সম্ভব হতো। দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই যে আমরা মুখে ত্যাগের কথা বললেও ব্যক্তিস্বার্থে চরমভাবে অন্ধতার পরিচয় দিচ্ছি। বিশ্বাসহীনতার উৎসটা সেখানেই।
লেখক: কবি-সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক (বার্তা), বিটিভি।