বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনায় দায় আছে আমাদেরও

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২২ জুলাই, ২০২১ ১৭:০২

বাংলাদেশের নাগরিকদের এক বড় অংশ এখনো মনে করে, করোনা হচ্ছে বড়লোকের রোগ, গরিবের করোনা হয় না। বেশিরভাগ মানুষ মাস্ক পরে না। পরলেও মাস্ক পরার নিয়ম মানে না। অনেকেই আছেন, যারা এখনও তাবিজ, ওঝা, পানিপড়া, ফুঁ, মাদুলি, কবচসহ নানাবিধ অবৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের ওপর আস্থা রাখেন। এটা কেবল যে শিক্ষার অভাব তা নয়, এটা যুক্তিবুদ্ধির অভাব, আরও সহজ ভাষায় বললে, কাণ্ডজ্ঞানের অভাব।

কেমন হবে ভবিষ্যতের দুনিয়াটা? কেমন হবে যদি পৃথিবীর সবার টিকাকরণ হয়ে যায়? তখন কি পৃথিবী থেকে মুছে যাবে করোনার নাম? একটা খারাপ সময়ের মন্দ স্মৃতি হিসেবেই শুধু থেকে যাবে করোনা? এই প্রশ্নগুলো এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এসব প্রশ্নের উত্তরও খুঁজছেন। আমেরিকার একদল চিকিৎসকের মতে, সকলের টিকাকরণ হয়ে গেলেই পরিস্থিতি হুবহু আগের মতো হয়ে যাবে না। প্রতিবছরই হয়তো ফিরে আসবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ। ভাইরাসটিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলাবে। রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাবে।

প্রতিবছরই যেভাবে সর্দি-কাশি-জ্বরের ভাইরাস ফিরে আসে সেভাবেই হয়তো আরও কিছুটা শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে। অনেকে হয়তো অজান্তেই মৃদু উপসর্গ নিয়ে বা উপসর্গ ছাড়াই এই জীবাণুকে বয়ে বেড়াবেন। আর নানা কারণে যাদের রোগপ্রতিরোধ শক্তি কম, তাদের বার বার এই জীবাণু আক্রমণ করবে এবং হয়তো সমস্যাতেও ফেলবে। টিকাকরণ হয়ে গেলেও এই ভাইরাস থেকে পুরোপুরি রেহাই মিলবে না।

করোনা থেকে ভবিষ্যতেও আমাদের নিষ্কৃতি মেলার সম্ভাবনা কম। গবেষকরা এ ক্ষেত্রে হামের টিকার উদাহরণ টানছেন। হামের টিকা দেয়ার পরেও কিন্তু শিশুদের হামের ঘটনা ঘটে। যদিও হাম মহামারির আকার নেয় না। সেভাবে করোনাও হয়তো নেবে না। কিন্তু বিশেষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে যেতে পারে এই জীবাণু। ফলে কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে মাথাচাড়া দিতে পারে।

ভবিষ্যৎ নয়, আপাতত আমরা করোনার বর্তমান থাবা থেকে পরিত্রাণের জন্য লড়ছি। যদিও লড়াইটা আমাদের যেভাবে করা উচিত ছিল, সেভাবে করতে পারিনি, এখনও পারছি না। ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিরোধে ‘স্বঘোষিত নির্বাসনের’ মতো এমন অসামান্য অস্ত্র যে ডাক্তারি বিজ্ঞানের ঝুলিতে ছিল, তা আমাদের জানা ছিল না; ভাইরাস ‘নির্মূল’ করে ফেলার যেসব উপায় বাতলানো হয়েছিল, তা-ও আমাদের অধীত বিদ্যার সঙ্গে মেলেনি।

ফলে আমরা বিষয়গুলোকে খুব একটা পাত্তা দিইনি। প্রত্যেক ভাইরাসের এক-একটা আবক্রপথ থাকে, ‘ট্র্যাজেক্টরি’। ঢেউয়ের পরে ঢেউ, ছোট-বড়-মাঝারি, সমুদ্রের জলরাশির মতো। ‘নতুন’ করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমরা এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছি। ঢেউ আরও আসতে পারে, আরও প্রবল-বিপুল ঢেউ। বর্তমান ঢেউ সামলে আমাদের সম্ভাব্য পরের ঢেউয়ের জন্যও প্রস্তুত হতে পারে।

গত বছর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকা এবং ইউরোপের কোনো কোনো দেশে যখন কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রতি দশ লাখ মানুষের মধ্যে ২০০ থেকে ৫০০, তখন বাংলাদেশে সংখ্যাটা ছিল শূন্য দশমিক ৪; এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও ছিল খুবই কম। অথচ, জনমানুষের ভিড়েই তো শ্বাসতন্ত্রীয় ভাইরাস রসদ পায়। ভিড়ের নিরিখে আমাদের সঙ্গে পাল্লা দেবে কোন দেশ? তাইতো এখানে উল্টো ফল ফলতে শুরু করে। চলতি মাসে এসে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ক্রমেই বাড়তে থাকে।

ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে এই হার হয়তো এখনও অনেক কম, কিন্তু ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর অভাবের দেশে বর্তমানে যে হারে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে, তাতে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এমনিতেই আমাদের বেশিরভাগেরই পেটে ভাত নেই, হাতে টাকা নেই, কাজ না করলে ঘরে চুলা জ্বলে না। হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড নেই, করোনা পরীক্ষার অবাধ সুযোগ নেই, আইসোলেশনের ব্যবস্থা নেই, অক্সিজেন নেই। পর্যাপ্ত টিকার বন্দোবস্ত নেই। আমাদের জন্য করোনা তো সাক্ষাৎ দুঃস্বপ্ন।

তারপরও আমাদের দেশে ফ্রিস্টাইলে চলা এখনও বন্ধ হয়নি। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা খুবই কম। সরকারিভাবে টিকাকরণের গতি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এর মধ্যে চলছে ঈদ পালনের সমারোহ। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে বাড়ি যাওয়া, সামাজিক দূরত্ববিধি না মেনে শপিং, গরুর হাটে যাওয়া। এসব অপরিণামদর্শী আচরণের ফলে আগামী দিনে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংকট আছে, টিকার সংকট আছে, সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণেরও সমস্যা আছে। এখন অনেকেই টিকার দোহাই টানছেন। যদিও এই ধরনের সংক্রমণে টিকার যুক্তি আছে, কিন্তু তা সীমিত। টিকার চেয়ে অনেক বেশি দরকার ছিল সুচিকিৎসার উপায় খোঁজা, মৃত্যুর সংখ্যা কমানো; সেই পথের হদিস করাই হলো না।

করোনা সংক্রমণের ঢেউগুলো কিন্তু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আবার দেখিয়ে দিল যে, জনস্বাস্থ্যের কাঠামো কত ভঙ্গুর, কত অগোছালো। অসীম নির্বুদ্ধিতা, ঔদ্ধত্য আর উদাসীনতা দিয়ে সেই ফাঁক ভরাট করা যায় না। আমরা জনসংখ্যার বহর দেখে আর্তনাদ করি, কিন্তু সম্পদের অসম বণ্টনের কথা ভেবে দেখি না।

স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও একই কথা; অভাব শুধু পরিকাঠামো আর অবকাঠামোতে নেই, আছে বণ্টন ব্যবস্থাতেও। বড় শহরে অতিকায়, সুরম্য হাসপাতাল আপৎকালে যেকোনো সুরক্ষা দেয় না, বরং আতঙ্ক বাড়ায়, সে কথা আর কতবার বললে গ্রাহ্য হবে? তার ওপর আছে ‘কোভিড’ চিকিৎসায় অবিমৃশ্যকারিতা, ক্রমশ তা স্পষ্ট হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের পাণ্ডিত্যের হাল দেখে মনে হয়, মহামারির চেয়ে মহামারি-সৃষ্ট আহাম্মকির ওজনই যেন অনেক বেশি।

বাংলাদেশের নাগরিকদের এক বড় অংশ এখনো মনে করে, করোনা হচ্ছে বড়লোকের রোগ, গরিবের করোনা হয় না। বেশিরভাগ মানুষ মাস্ক পরে না। পরলেও মাস্ক পরার নিয়ম মানে না। অনেকেই আছেন, যারা এখনও তাবিজ, ওঝা, পানিপড়া, ফুঁ, মাদুলি, কবচসহ নানাবিধ অবৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের ওপর আস্থা রাখেন।

এটা কেবল যে শিক্ষার অভাব তা নয়, এটা যুক্তিবুদ্ধির অভাব, আরও সহজ ভাষায় বললে, কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। আমাদের দেশের নাগরিকদের একাংশের মধ্যে এখনও এই কাণ্ডজ্ঞানের অভাব যথেষ্ট। তারা আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে যৌথ অপরিণামদর্শী আচরণ ও কার্যকলাপ দিয়ে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কাছে আনবে, তারপর কারো মৃত্যু হলে স্বজনরা মাতম করবে, আর এর-ওর ওপর দায় চাপাবে।

লকডাউন কার্যকর করা, মানুষ যেন ঠিকঠাকমতো মাস্ক পরে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, এ ব্যাপারে মানুষকে বোঝানো, সচেতন করা, জরুরিভিত্তিতে টিকাকরণের ক্ষেত্রে সরকারের দায় আছে। এ মুহূর্তে সরকারের উচিত সেই কাজটি ভালোভাবে এবং গুরুত্বের সঙ্গে করা। আর জনগণের উচিত যথাযথ নিয়মে মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। কেবল সরকারের সমালোচনা করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, নিজেদের কর্তব্যটুকুও পালন করতে হয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক-সাবেক ছাত্রনেতা।

এ বিভাগের আরো খবর