বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আগুন শুধু পোড়ায় না, দেখায়ও অনেক কিছু

  •    
  • ২২ জুলাই, ২০২১ ১৪:১০

দুর্ঘটনাজনিত প্রাণহানির ক্ষেত্রে দুই কার্যদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ঘটনা কলকারখানা পরিদর্শককে নোটিস করে জানানোর বিধান আছে। কিন্তু হাসেম ফুডস কারখানা তা করেনি। দেখা গেল কারখানার বিমার টাকা পাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ যত উদগ্রীব, শ্রমিকের জীবনের প্রতি দায়িত্ব পালনে ততটাই উদাসীন। হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় আগুনের ঘটনায় মালিকপক্ষের এমন পদক্ষেপে প্রশ্ন উঠেছে, যে শ্রমিকের শ্রমে কারখানার উৎপাদন ও মুনাফা সেই শ্রমিকের জীবনের চেয়ে সম্পদের মূল্যই বেশি?

ছোট ছোট সাদা ব্যাগে মোড়ানো কয়লার মতো কিছু জিনিস। না বললে কেউ বুঝতে পারবে না এই মোড়কে যা আছে তাতে একদিন প্রাণ ছিল। বাবা মা’র কথা আর সহকর্মীদের বর্ণনায় জানা যায় যে, তাদের অনেকেরই বয়স ছিল ১২ থেকে ১৬ বছর। ভাবতেই কষ্ট লাগে জীবনের শুরুতেই কতগুলো জীবনের অবসান হয়ে গেল! জীবন বাঁচাতে কাজ করতে এসে জীবন হারানোর ঘটনা যেন থামছেই না। কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা নতুন নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু অমানবিক বিষয় হলো সেটাই যখন অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকে না, সম্পদ রক্ষার জন্য বিমা করার ক্ষেত্রে দারুণ তৎপরতা থাকলেও শ্রমিকের জীবনের ক্ষেত্রে থাকে নিদারুণ অবহেলা।

বড় আকারের অগ্নিকাণ্ডের বিবেচনা করলে সেই ১৯৯০ সালে সারাকা গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে শ্রমিকের মৃত্যুর যে মিছিল শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের জুলাই মাসে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুসের কারখানায় ৫২ জনের মৃত্যুর সর্বশেষ ঘটনা প্রত্যক্ষ করল দেশবাসী। গত ৮ জুলাই বিকেলে হাসেম ফুডের কারখানায় আগুন লাগার পর প্রায় ৪০ ঘণ্টা লাগে আগুন পুরোপুরি নেভাতে। আগুন লাগার পর প্রাণ বাঁচাতে কারখানা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিন শ্রমিক নিহত হন। পরে চারতলায় এক জায়গা থেকে ৪৯ জনের পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়। আহত হয় অন্তত ৩০ জন। এর বাইরেও বেশ কিছু শ্রমিক নিখোঁজ থাকার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে এই বেদনাময় মৃত্যুই শেষ নয়। যে কারণে আগুনে পুড়ে শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে তা দূর না করলে আশঙ্কা আছে যে, খুব সহসাই আবার কোনো দুঃখজনক প্রাণহানির ঘটনার কথা শুনতে হবে।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়। এই তিনের সম্মিলনে ঘটে অগ্নিকাণ্ড। দাহ্য বস্তু, উত্তাপ এবং অক্সিজেন এই তিনটি বিষয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ফলে যেকোনো কারখানা যেখানে উত্তাপ সৃষ্টি হয়, যেখানে দাহ্য বস্তু থাকে আর বাতাসে তো অক্সিজেন আছেই সেখানে যদি প্রচুর শ্রমিক থাকে, তাহলে সতর্কতা রক্ষার সামান্যতম ঘাটতি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু যদি কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর বলে তাদের জরিপ অনুযায়ী ৬০ শতাংশ কারখানা কোনো নিয়ম মানে না, ৫০ শতাংশ কারখানা মারাত্মক অগ্নিঝুঁকিতে আছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এসব কারখানা ঝুঁকিমুক্ত করার দায়িত্ব কার বা কোন প্রতিষ্ঠানের?

অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত দল জানায়, কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা ছিল না। অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ রাখা ছিল। এতে শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকির মধ্যেই ছিল। ছয়তলা ওই ভবনের নিচতলা ও ছয়তলা বাদে বাকি চারটি ফ্লোরে চকোলেট, বিস্কুট, কোমল পানীয়, লাচ্ছা সেমাইসহ বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যপণ্য তৈরি হতো। নিচতলায় প্যাকেজিং সামগ্রী যা অত্যন্ত দাহ্য বস্তু ছিল।

দোতলায় ছিল বেকারি যেখানে সারি সারি চুল্লিতে প্রচণ্ড উত্তাপে বিস্কুট তৈরি হতো। তৃতীয় চতুর্থ তলায় জুস, পানীয়, ক্যান্ডি, ললিপপ তৈরি, পঞ্চমতলায় আচার তৈরির বড় কড়াইয়ে তেল গরম করা, ষষ্ঠতলায় বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ এমনকি কয়েক টন ডালডা জাতীয় পদার্থ রাখা কি কোনো বিবেচনাতেই অগ্নিঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের সাধারণ সূত্রের মধ্যে পড়ে?

শিশুশ্রমিক নিয়োগ যেমন অন্যায় তেমনি নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র না দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ বেআইনি। বছরের পর বছর অস্থায়ী শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোটাও তো বেআইনি। কিন্তু কারখানায় শিশুশ্রমিক ছিল। একজন দুজন নয় অনেক। আর কোম্পানির হিসাবরক্ষক ওয়াহিদ মুরাদের বক্তব্য অনুযায়ী, কারখানায় স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৪০০ এবং অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা দুই হাজার ২০০ জন। শ্রম পরিদর্শকদের পরিদর্শনে এই অসংগতি ধরা পড়ল না কেন?

মালিক তার মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে কম মজুরিতে শিশুশ্রমিক নিয়োগ করেছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নজরদারি ছিল না কেন? কেন বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, কেন ৩০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পরিবর্তে ১০ ফুট চওড়া রাস্তা ছিল এই প্রশ্নগুলো উঠছে। কিন্তু এগুলো যাদের দেখার কথা ছিল তারা দেখেনি কেন সে প্রশ্ন এখন তুলতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসেম ফুডস কমপ্লেক্সের প্রায় সব কারখানা ভবন ও অন্যান্য সম্পদ বিমার আওতায় রয়েছে। কিন্তু শ্রম আইন অনুযায়ী, কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য গ্রুপ বিমা করা ছিল না। এতে করে অগ্নিকাণ্ডে হতাহত শ্রমিকদের পরিবারের বিমা কোম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আর থাকল না।

শ্রম আইন অনুযায়ী, স্থায়ী শ্রমিকের ক্ষেত্রে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত হলে ক্ষতিপূরণ পাবে দুই লাখ টাকা। চিরস্থায়ী পঙ্গু হয়ে গেলে পাবে আড়াই লাখ টাকা। কী সামান্য মূল্য একজন মানুষের জীবনের! এই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক জটিলতা। হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের কোম্পানির কারখানা ভবন ও অন্যান্য সম্পদ বিমার আওতায় ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের নিরাপত্তায় গ্রুপ বিমা ছিল না। কিন্তু চারটি সাধারণ বিমা কোম্পানিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অল রিস্ক ও অগ্নিবিমার পলিসি রয়েছে হাসেমের। কোম্পানিগুলো হলো দেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স, কন্টিনেন্টাল জেনারেল ইনস্যুরেন্স, রিপাবলিক ইনস্যুরেন্স ও সেন্ট্রাল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।

সাধারণ বিমা করপোরেশন সূত্রে জানা যায় যে, হাসেমের কারখানা ভবন ও সম্পদের ওপর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার আইএআর ও অগ্নিবিমা রয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের গ্রুপ বিমার আওতায় আনেনি কোম্পানি। কিন্তু শ্রম আইন ২০০৬-এ বলা হয়েছে, শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যেসব প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১০০ জন স্থায়ী শ্রমিক কর্মরত তাদের জন্য বিমা আইন অনুযায়ী গ্রুপ বিমা চালু করতে হবে।

যদি প্রতিষ্ঠানের বিমা করা থাকে তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্তরা এই বিমার আওতায় ক্ষতিপূরণ পেতে পারে। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সূত্র জানিয়েছে, হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের মালিক মুনাফা বেশি করতে চেয়েছেন। কারণ শ্রমিকদের গ্রুপ বিমার আওতায় আনলে মালিককেই প্রিমিয়াম দিতে হয়। কিন্তু যে বিষয়টা উদ্বেগ এবং দুঃখের তা হলো এখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এসব বলছেন। ১৯৮৪ সাল থেকে চলে আসা প্রতিষ্ঠান আর গত ১২ বছরে অতি দ্রুত বর্ধনশীল এই কারখানার ব্যাপারে এতদিন কারও নজরে পড়ল না?

কোনো প্রতিষ্ঠান শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পখাত হলে এবং সরকারের মাধ্যমে তহবিল গঠিত হলে উক্ত প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের জন্য গ্রুপ বিমা করা থেকে অব্যাহতি পায়। কিন্তু হাসেম ফুডস শতভাগ রপ্তানিনির্ভর প্রতিষ্ঠান নয়। ফলে এখানে গ্রুপ বিমা করা ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু আইন না মানলে শাস্তি কত? শ্রম আইনের ৩০৭ ধারা অনুযায়ী শ্রমিকদের জন্য গ্রুপ বিমা না করলে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।

আবার বিমা না করার জন্য কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে ১৩২ ও ১৩৩ ধারা অনুযায়ী শ্রম আদালতের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে। কিন্তু আদালতের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন আইনি লড়াই চালাতে হবে। শ্রমিকদের পক্ষে এই দীর্ঘমেয়াদি আইনি লড়াই চালানো কি সম্ভব বা বাস্তবে কী হয়?

কী অদ্ভুত ব্যাপার! ভাবতেও অবাক লাগে হাসেম ফুডস কারখানায় আগুন লেগেছিল বিকেল সাড়ে ৫ টায়। কিন্তু এর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই বিমা কোম্পানিগুলোকে ফোনে জানায় মালিকপক্ষ। ১১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ই-মেইলে দেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স ও রিপাবলিক ইনস্যুরেন্সকে জানানো হয়। কোম্পানিগুলোর সূত্র বলছে, চিঠি দেয়া মানে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আইনি পথ তৈরি করে রাখা।

অপরদিকে দুর্ঘটনাজনিত প্রাণহানির ক্ষেত্রে দুই কার্যদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ঘটনা কলকারখানা পরিদর্শককে নোটিস করে জানানোর বিধান আছে। কিন্তু হাসেম ফুডস কারখানা তা করেনি। দেখা গেল কারখানার বিমার টাকা পাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ যত উদগ্রীব, শ্রমিকের জীবনের প্রতি দায়িত্ব পালনে ততটাই উদাসীন। হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় আগুনের ঘটনায় মালিকপক্ষের এমন পদক্ষেপে প্রশ্ন উঠেছে, যে শ্রমিকের শ্রমে কারখানার উৎপাদন ও মুনাফা সেই শ্রমিকের জীবনের চেয়ে সম্পদের মূল্যই বেশি?

আগুনে পুড়ে গেল শ্রমিক। পুড়ে গেল কত পরিবারের স্বপ্ন। আগুন শুধু উত্তাপ নয়, আলোও তো দেয়। কিন্তু কারখানায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের পরিবারে আজ শুধুই অন্ধকার। আগুনের আলোয় দৃশ্যমান হয়ে উঠল যে অসংগতিগুলো তা যদি দূর না করা হয় তাহলে আশঙ্কা নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরেকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের।

লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর