ছেলেবেলার ঈদের আনন্দই অন্যরককম ছিল। ৩০ দিনের রোজা শেষে ঈদের চাঁদ দেখার যে আনন্দ, এখন চাঁদ দেখা কমিটির ঘোষণার সঙ্গে তার কোনো তুলনা নেই। ঈদের একফালি চাঁদ অল্পসময় থাকে। সেই চাঁদ দেখতে কত কসরত যে করতাম। কেউ কেউ আরও কাছ থেকে চাঁদ দেখতে মসজিদের ছাদে বা কোনো উঁচু গাছে চড়ে বসত। ঈদুল আজহায় চাঁদ দেখার ব্যাপার নেই বটে। তবে কোরবানির ঈদের আনন্দ এবং প্রস্তুতি রোজার ঈদের চেয়েও বেশি হতো।
কয়েকদিন আগে থেকেই কোরবানির জন্য প্রস্তুতি, মুরব্বিদের সঙ্গে পশুর হাটে যাওয়া, গরু কেনার পর সেটার দেখভাল- আনন্দের কোনো শেষ নেই যেন। তবে কোরবানির ঈদ এলে অনেকে ভয় দেখাত। ইসলাম ধর্মে কোরবানির ইতিহাস হলো- আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে বললেন তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস যেন কোরবানি দেয়া হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ভেবে দেখলেন সবচেয়ে প্রিয় তার সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)। আল্লাহর নির্দেশে তিনি তার প্রিয় সন্তানকেই কোরবানি দিতে উদ্যত হন। প্রশ্নহীন আনুগত্য ও নিবেদনে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তার কোরবানি কবুল করে নেন এবং শেষ মুহূর্তে হজরত ইসমাইল (আ.)কে সরিয়ে ছুরির নিচে একটি দুম্বা দিয়ে দেন। সেই থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানির প্রচলন।
আমাদের ছোটবেলায় ভয় দেখানো হতো, আল্লাহ যদি হজরত ইসমাইলকে সরিয়ে না নিতেন, তাহলে আমাদের পিতারা এখন তাদের সন্তানদের কোরবানি দিতেন। এখন ভাবলে হাসি পায়, কিন্তু তখন এই ভয়ঙ্কর ভাবনায় কত কেঁদে বুক ভাসিয়েছি।
এখন যেমন কোরবানি নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, কার গরু বড়, কার গরুর দাম বেশি; তেমনটা অন্তত আমাদের ছেলেবেলায় দেখিনি। সত্যি বলতে কি, প্রতিযোগিতা করার মতো পয়সাওয়ালা মানুষও বেশি ছিলেন না আমাদের এলাকায়। যাদের সামর্থ্য বেশি তারা একাই একটা গরু কোরবানি দিতেন। যারা একা কোরবানি দিতেন, তাদের দেখে রীতিমতো হিংসা হতো। আমার স্কুলশিক্ষক বাবার অত সামর্থ্য ছিল না। আমরা ৭ জন মিলে একটা গরু কোরবানি দিতাম। একা কোরবানি দিতে না পারার দুঃখ থাকত অল্প কিছুক্ষণ। দ্রুতই আমরা দুঃখ ভুলে গরুর পেছনে লেগে যেতাম। মুহূর্তেই আমাদের আনন্দ ৭ গুণ হয়ে যেত।
ইসলামের অন্যতম মূল চেতনাটাই হলো বৈষম্য কমিয়ে আনা। আনন্দটা সবার মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়া। জাকাত ব্যবস্থাটাই হলো, সম্পদশালীদের অর্থের একটা অংশ দরিদ্রদের মাঝে বিলি করা। ঈদেও ধনী-গরিবকে এক কাতারে আনার চেষ্টা থাকে। যেমন কোরবানির ঈদে যে পশু কোরবানি দেয়া হয়, তার মাংস বিলি করা হয় সবার মধ্যে। আমাদের এলাকায় এই মাংস বণ্টনের একটা অসাধারণ সিস্টেম ছিল। এটাকে বলা হতো ‘সমাজ’। কোরবানির পর সবাই মাংসের এক তৃতীয়াংশ সেই ‘সমাজ’-এ জমা দিত। সমাজের সব মাংস একসঙ্গে করে আমাদের গ্রামের যারা কোরবানি দিতে পারত না, তাদের মধ্যে সমান ভাগ করে দেয়া হতো। যারা কোরবানি দিতে পারত না, তারা বিপুল উৎসাহে সেই সমাজের মাংস তৈরি এবং বণ্টনে অংশ নিত।
তাতে গ্রামের সবার ঘরেই কম বেশি মাংস পৌঁছে যেত। দুয়েকটি মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার হঠাৎ কোনো বছর হয়ত, কোরবানি দিতে পারল না। তারা কিন্তু লজ্জায় সমাজের মাংস নিতে আসত না। তাদেরকে খুব সম্মানের সঙ্গে মাংস পৌঁছে দেয়া হতো। সমাজের মাংসের মধ্যে কোনো গ্লানি ছিল না; একতা ছিল, ভ্রাতৃত্ব ছিল, আনন্দ ভাগাভাগি করার বার্তা ছিল। সমাজের মাংসের পরও অনেকে গরিব প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে মাংস বিলি করত। তখন তো ফ্রিজ ছিল না। তাই মাংস সংরক্ষণেরও উপায় ছিল না। তাই কোরবানির মাংস মোটামুটি সমানভাবে ভাগ হয়ে যেত। কোরবানির মাংস অনেক পরিবারের সারা বছরের পুষ্টি ছিল।
ইসলামের নিয়ম মেনে এখনও কোরবানির মাংস বিলি করা হয়। কিন্তু শহরের ফ্ল্যাট-কালচারে সেই সমাজের মাংসের ধারণাটা খুব মিস করি। এখন কোরবানিতে ত্যাগের চেয়ে দেখনদারিটা বেশি। কার গরুর দাম কত, এই নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। কোরবানির পর কয় মণ মাংস হলো, দামে পোষালো কি না, তা নিয়ে অনেক হিসাব-নিকাশ হয়। কোরবানির আগে ফ্রিজ কেনার ধুম পড়ে যায়। গরিবের মাংস দুদিনেই ফুরিয়ে যায়। কিন্তু বড়লোকের ডিপ ফ্রিজে কোরবানির মাংস থেকে যায় মাসের পর মাস। আমি ঠিক জানি না, কিন্তু অনেকের কোরবানিতে ত্যাগের চেয়ে মাংসের গন্ধ বেশি। তাদের কোরবানিতে পশু জবাই হয় বটে, ঠিক কোরবানি হয় কি না জানি না।
যেমনটি বলছিলাম, আমাদের গ্রামে হঠাৎ কোনো বছর নিয়মিত কোরবানি দেয় এমন কোনো পরিবারও কোরবানি দিতে পারত না। তারা লজ্জায় নিজেদের আড়াল করে রাখতে চাইত। আমি নিশ্চিত, এবার করোনায় তেমন লাজুক পরিবারের সংখ্যা আরও বাড়বে। একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম, কোরবানি দিতে না পারা এমন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের মন খারাপ নিয়ে।
প্রতিবেশী সেই শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে তার মন ভালো করে দেন। আসলেই সময়টা এখন সত্যি খারাপ। করোনায় হঠাৎ চাকরি হারিয়ে অনেক পরিবার গরিব হয়ে গেছে। আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই। সমাজের মাংসের সেই ধারণাটা যেন আমরা আবার ফিরিয়ে আনি। কোরবানি মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণের চেয়ে যেন চারপাশের গরিব বা হঠাৎ গরিব হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর মাঝে বিলিয়ে দেই। এ তো শুধু মাংস বিলানো নয়, আনন্দ বিলানো। শুধু কোরবানির মাংস বলে নয়, আমরা যেন নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াই।
আরেকটা অনুরোধ করে লেখাটি শেষ করব। কোরবানির পশুর চামড়া বা চামড়া বিক্রির টাকা সাধারণত কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা বা এতিমখানায় দান করা হয়। তাই করুন। খালি দান করার আগে খেয়াল রাখবেন, যেখানে দিচ্ছেন; সেখানে সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা, উগ্রতার চর্চা হচ্ছে কি না। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম দেশে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চালাচ্ছে। আপনি দান করার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন, আপনার দানে যেন সাম্প্রদায়িকতার চর্চা না হয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক।