বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনাভীতি ও আবহমানকালের বাঙালির ঈদ

  •    
  • ২০ জুলাই, ২০২১ ১৩:২৬

করোনাকাল আমাদের কিছুটা থমকে দিলেও ঈদ-উৎসবের বাইরে থাকতে চায় না বাঙালি মুসলমান। আবহমান বাংলার ঈদ উৎসবে নানা আয়োজন ও উপাচার কালপরিক্রমণ করে আজও অনেকটা সবলভাবে টিকে আছে।

সারা বিশ্বেরই স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন ঘটিয়েছে জীবনঘাতী অদৃশ্য শত্রু করোনা ভাইরাস। আমাদের জীবনছন্দেও আঘাত হেনেছে। সরকারি নীতিনির্ধারকগণ দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ধরে রাখার জন্য ঝুঁকি নিয়ে হলেও শিল্প কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক রেখে দেড় বছর ধরে কঠোরভাবে সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ রেখেছে। অর্থাৎ আমাদের স্বাভাবিক চলার ছন্দকেও শাসন করছে করোনা।

সংখ্যাগোরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। মুসলমানদের ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব হাতেগোনা। এরমধ্যে প্রধান ঈদ উৎসব। এই করোনাকালেই আমরা তিনটি ঈদ উদযাপন করে ফেলেছি। আবার রাতপোহালেই ঈদুল আজহা। কিন্তু করোনা ভীতি সঙ্গে নিয়ে ঈদ কতটাইবা স্বস্তিদায়ক হতে পারে। এরপরেও মানুষ চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশুর হাটে যাওয়া যায় পশু ক্রয় করা যায়। প্রশাসন থেকেও নানা নির্দেশ জারি করা হয়েছে। মানুষ নিজেরা সচেতন না হলে অমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি যথার্থভাবে মানানো সম্ভব নয়। এমন অস্বাভাবিক জীবনধারায় আমরা বরঞ্চ ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে বাঙালির ঈদ উৎসবকে খুঁজে ফিরি।

বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রবেশ ও মুসলিম সমাজ গঠনের সূচনাকাল আট শতকে। বেশ কয়েক বছর আগে একটি জাতীয় দৈনিকে বিভ্রান্তিকর তথ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনেক আগেই আগে যে দাবিটি গবেষকদের দ্বারা পরিত্যাজ্য হয়েছিল তাকেই সামনে তুলে এনে বলা হয়েছে ৬৯ হিজরিতে মুসলমানদের পদার্পণ ঘটেছে বাংলায়। যা গ্রহণযোগ্য নয়। ইতিহাসের আকর সূত্র মতে, আট শতকে আরবের মুসলমান বণিকরা সমুদ্রপথে বাংলায় এসেছিলেন। তারা নোঙর ফেলেছিলেন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সমুদ্র তীরাঞ্চলে। দীর্ঘদিন বাণিজ্য করতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে এসব অঞ্চলের মেয়েদের বিয়ে করেন। এভাবে মুসলিম সমাজের গোড়াপত্তন হয়। এগারো শতক থেকে সুফি সাধকরা এসে ছড়িয়ে পড়তে থাকেন বাংলার নানা অঞ্চলে। এতে মুসলিম সমাজ বিস্তারও গতি পায়। তেরো শতকে মুসলমানদের হাতে রাজক্ষমতা চলে এলে ধীরে ধীরে বাংলা বিশেষ করে পূর্ববাংলা মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে পরিণত হয়ে যায়।

একটি অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে বাংলায় ধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষ পাশাপাশি বসবাস করত। তাই সাংস্কৃতিক মিশ্রণ ঘটায় সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে অবিমিশ্র রূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে মুসলমানদের ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা এদিক থেকে অনেকটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে। অবশ্য এই দুটো ধর্মীয় উৎসবে লোকধারার প্রভাব এড়ানো সম্ভব হয়নি।

প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র এবং বিশেষ করে সমকালীন ইতিহাস গ্রন্থ না থাকায় সকল পর্বের বাঙালির ঈদ উৎসব কীভাবে উদযাপিত হতো তা উপস্থাপন করা কঠিন। তবে মোগল যুগ থেকে ঈদ উদযাপনের তথ্য ইতিহাসবিদরা পেয়েছেন। এ যুগে ঝলমলে উজ্জ্বল ঈদ আয়োজন ধণিক শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে জানা যায়। মোগল শাসকরা ঈদ উৎসবটিকে যে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন তা নিশ্চিত করা যায় দেশের নানা অঞ্চলে পাওয়া ধ্বংসপ্রায় বা সংস্কার করা মোগল ঈদগাহ দেখে।

উনিশ শতকের মাঝ পর্ব থেকে এদেশে ঈদ-উৎসবের জৌলুস অনেক বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঈদের আনন্দে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হতে থাকে অনেক বেশি আনুষ্ঠানিকতায়। ঈদুল ফিতর বা রমজানের ঈদের আনন্দ ছোটদের মধ্যে শুরু হয়ে যেত আগের দিন থেকে। ছোটরা বিকেল থেকে উন্মুখ হয়ে থাকত ঈদের চাঁদ দেখতে।

চাঁদ দেখার পর বাড়িতে এসে বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করা, আনন্দ মিছিল করা এক ধরনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। সেকালে ঢাকা শহরের উঁচু দালান বলতে ছিল আহসান মঞ্জিল, বড় কাটরা, ছোট কাটরা আর হোসেনী দালান। রমজানের চাঁদ দেখার জন্য ঢাকার উৎসুক নাগরিকরা এসব ইমারতের ছাদে এসে ভিড় করত। এক চিলতে বাঁকাচাঁদ অল্প সময়ে ভাসত আকাশে। একজন দেখলে আরেক জনকে দেখতে সাহায্য করত। অনেকে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ভাসিয়ে চাঁদ দেখত। আহসান মঞ্জিল থেকে চাঁদ দেখার পরে সরকারিভাবে চাঁদ দেখা নিশ্চিত করা হত। চাঁদ দেখতে পেলে চাঁদকে সালাম দেয়ার একটি রেওয়াজ ছিল। চাঁদ দেখে বয়োজ্যেষ্ঠরা মোনাজাত করতেন। তারপর করতেন কোলাকুলি। আর ছোটরা বড়দের সালাম করত। অনেক সময় চাঁদ দেখার কথা সরকারিভাবে প্রচার করার জন্য বন্দুকের ফাঁকা গুলি ছোড়া হতো। তোপধ্বনিও করা হতো।

এসময় বিশেষ করে রমজানের ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রামে গ্রামে মেলার আয়োজন করা হতো। এখনও অনেক অঞ্চলে ঈদ উপলক্ষে গ্রামীণমেলার আয়োজন হয়। তবে কভিড হয়তো এখানে রাস টেনেছে। ঈদে নতুন পোশাক পরা অন্যতম বড় আনন্দের বিষয়। তাই কভিডের রক্তচক্ষুর সামনেও আমরা ছেলেমেয়ে, ভাইবোনদের জন্য মার্কেটে গিয়ে ঈদের পোশাক কিনতে দেখছি। অতীতকাল থেকেই বাঙালি মুসলমান ঈদে নতুন পোশাক পরা ধর্মীয় কর্তব্য বলেও মনে করত। ছেলে বুড়ো সবারই ঈদে নতুন পোশাক পরার আগ্রহ ছিল। সামর্থ্য অনুযায়ী এই আগ্রহ মেটানোর চেষ্টাও করা হতো। নিকটাত্মীয়দের মধ্যে উপহার হিসেবে পোশাক দেয়া এবং গরিবদের পোশাক দান করা ঈদ-উৎসবের একটি সাধারণ নিয়ম হিসেবে আবহমানকাল থেকে চলে আসছে।

ঈদ উপলক্ষে বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে বিশেষ খাবার ও পানীয়ের আয়োজন হয়ে আসছে বহু কাল ধরে। গ্রাম-গঞ্জে মোগলাই খাবারের পাশাপাশি নানা ধরনের পিঠাপুলির আয়োজন হতো। ফুল পিঠা তৈরিতে সাংস্কৃতিক মিশ্রণের স্পষ্ট রূপ লক্ষ করা যায়। যেমন কুমারী মেয়েদের বড়রা উৎসাহিত করত পিঠায় প্রজাপতির নকশা ফুটিয়ে তুলতে। বাংলার লোকসংস্কৃতিতে প্রজাপতি বিয়ের প্রতীক। তাই ধারণা করা হতো ঈদের পিঠেতে কুমারী মেয়ে প্রজাপতি ফুটিয়ে তুললে তারও বিয়ের ফুল ফুটবে। তবে শহুরে জীবনে প্রায় অনুপস্থিত ছিল এধারার আচার।

নবাবী আমলে ঢাকায় ঈদ-উদযাপনে বেশ জৌলুস ছিল। তা ছিল দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকটা আলাদা। ঢাকার নায়েব-এ-নাজিম ঈদ মিছিলের রেওয়াজ চালু করেন। ঈদ মিছিলের উৎস মোগল সম্রাটদের নানা আয়োজনের মধ্যে পাওয়া যায়। অনেক মোগল সম্রাট বিভিন্ন উৎসবে নহবত বাজিয়ে শোভাযাত্রার আয়োজন করতেন।

আবহমান বাংলায় হিন্দু সমাজে বিশেষ করে নাগরিক জীবনে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দিবস জন্মাষ্টমিতে আনন্দ মিছিল বের করা হয়। এসবের সম্মিলিত প্রভাবে ঈদ মিছিল এক সময় প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করে। প্রাপ্ত সূত্র থেকে জানা যায়, ঢাকায় ঈদ মিছিলের যাত্রারম্ভ হতো নিমতলী দেউড়ি থেকে। এই মিছিলে নায়েব-এ-নাজিম ও বড় কর্মকর্তারা পালকি ও হাতির পিঠে বসতেন। অন্যেরা হেঁটে চলতেন। কারো হাতে থাকতো রঙিন পতাকা। চমৎকার পোশাকে সজ্জিত বাদক দল বাজনা বাজাতেন। মিছিল হোসনী দালান, বেগম বাজার, চকবাজার ঘুরে আবার নিমতলীতে এসে শেষ হতো। অবশ্য নবাবী শাসনের অবসানের পর ঢাকায় ঈদ মিছিল বন্ধ হয়ে যায়। ঈদ মিছিল আবার শুরু হয় বিশ শতকের শুরুর দিকে।

ঢাকায় ঈদ আয়োজনে আরও কিছু বৈচিত্র্য ছিল। ঈদের দিন ধুপখোলার মাঠ, আরমানিটোলার মাঠ, রমনা প্রভৃতি স্থানে কত্থক নাচের আসর বসত। হিজরা নাচও অভিজাত উৎসবের একটি উপাদান ছিল। এ ছাড়াও ঈদকে কেন্দ্র করে নৌকাবাইচ, ঘুড়ি ওড়ানো এসবেরও আয়োজন করা হতো। ঈদকে ঘিরে ‘ফুল সিরিয়ালে’র একটি আয়োজন ছিল ঢাকায়, ছিল সারারাত সিনেমা দেখা। সাধারণত ঈদের রাতে পর পর তিন চারটি হিন্দি ছবি দেখানো হতো ঢাকার হলগুলোতে।

ঢাকায় আফগানিস্তান থেকে কাবুলিওয়ালারা এসে ব্যবসা করত। পরিজন ছেড়ে প্রবাসে থাকা এই নিঃসঙ্গ কাবুলিওয়ালারা সুযোগ পেলে দেশীয় সংস্কৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করত। এর একটি চমৎকার উদাহরণ দেয়া যায় ঈদের সময়। ঈদের দিন কাবুলিওয়ালাদের নাচ দেখতে নগরবাসী অনেকে জড়ো হতো পল্টন ময়দানে। কাবুলিওয়ালা ঢোলের তালে তালে রঙিন রুমাল উড়িয়ে নাচত।

ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদে ব্যাপকভাবে গরু কোরবানি দেয়ার প্রবণতা আগে তেমনটা ছিল না। এর দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, সাধারণ মুসলমানের সামর্থে্যর অভাব। দ্বিতীয়ত, হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব। উনিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এদেশে মুসলিম সম্প্রদায় একটি শক্ত অবস্থানে আসে। এসময় অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার কোরবানি দেয়ার মতো কিছুটা সামর্থ্য অর্জন করেছিল। তবে সাধারণত এককভাবে খাসি কোরবানি দেয়া হতো বেশি। আর গরু কোরবানি দিত কয়েকজন মিলে ভাগে। হাতেগোনা ধনী পরিবার এককভাবে গরু কোরবানি দিত। গ্রামে কৃষক সাধারণত গৃহপালিত ছাগল ও গরু কোরবানি দিতেন।

ঢাকার আদি অধিবাসীদের মধ্যে কোরবানির এটি আলাদা রেওয়াজ চালু ছিল। কোরবানির মাংস আত্মীয়দের বাড়িতে বিলানোটা ছিল একটি জরুরি কর্তব্য। বিশেষ করে বিয়াই বাড়িতে আস্ত রান পাঠানো ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। কোরবানির ঈদে মাংসের প্রাচুর্য থাকায় বিশেষ করে নাগরিক জীবনে মাংসের বিচিত্র রান্না হতো। এধরনের ঢাকাইয়া রান্নার বিবরণ পাওয়া যায় হাকিম হাবিবুর রহমান রচিত উর্দু গ্রন্থ ‘ঢাকা পচাশ বারাস পাহলে’ গ্রন্থে। তার বিবরণ মতে, তখন রান্না হতো কাঁচা ও সেদ্ধ মাংসের কোফতা, খাসতা কোফতা, কোফতা দিয়ে বানানো কালিয়া ও কোর্মা। নানা আকারের কোফতা বানানো হতো এসময়। মার্বেলের মত ছোট আকার থেকে শুরু করে দুই সের ওজন পরিমাণ পর্যন্ত কোফতা ছিল।

কোরবানির আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ গরিবের মধ্যে বিতরণ করা। বিশ শতকের মাঝ পর্ব থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসতে থাকে। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যায়। ফলে কোরবানিদাতার সংখ্যাও বেড়ে যায়। এসময় থেকে অনেক গ্রামেই মাংসের যৌথ বণ্টনপ্রথা চালু করা হয়। এখনও অনেক গ্রামে এধরনের প্রথা অব্যাহত আছে। গ্রামের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে সকলের গরু কোরবানি দেয়া হতো। গরিবের ভাগ একসঙ্গে জড়ো করা হতো। তারপর গ্রামের গরিব মানুষদের তালিকা করে সমপরিমাণ বণ্টন করা হতো।

করোনাকাল আমাদের কিছুটা থমকে দিলেও ঈদ-উৎসবের বাইরে থাকতে চায় না বাঙালি মুসলমান। আবহমান বাংলার ঈদ উৎসবে নানা আয়োজন ও উপাচার কালপরিক্রমণ করে আজও অনেকটা সবলভাবে টিকে আছে। করোনাকালে এই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচরণ আমরা তাই উপেক্ষা করতে পারছি না।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এ বিভাগের আরো খবর