বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আজীবন বয়ে বেড়াব তার স্মৃতি

  • শরিফুজ্জামান পিন্টু   
  • ১৯ জুলাই, ২০২১ ১৬:১০

কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী। একদিন তিনি আমাকে ফোন করলেন। ভরাট গলায় বললেন, ‘আমি এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী।’ আমি তো অবাক। আমার মতো একজন সাংবাদিককে আইজিপি ফোন করবেন কেন? এরপর বললেন, ‘ইকবালের (আনোয়ারুল ইকবাল) কাছ থেকে নম্বর নিলাম।’ তিনি আনোয়ারুল ইকবালকে পরামর্শ দিয়েছিলেন খুলনায় জনকণ্ঠ কার্যালয়ে সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারা দেয়ার জন্য। পুলিশ আমাকে সব সময় সহায়তা করবে, এমন আশ্বাসও দিলেন তিনি।

সাবেক আইজিপি এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকীর মৃত্যুসংবাদ শুনে চমকে উঠি। কদিন ধরে ভাবছিলাম ওনার সঙ্গে কথা বলব। ভাবতে ভাবতে ওনার মৃত্যুর খবর পড়লাম। ধাক্কা সামলাতেই খুলে যায় স্মৃতির ঝাঁপি। মানুষটির সঙ্গে ২৩ বছরের সম্পর্ক। মাঝেমধ্যে নিজের গাওয়া গানের লিংক পাঠাতেন, শুনে মতামত দিতাম। অনেক দিন দেখা নেই। কথা ছিল, করোনার প্রকোপ কমলে গুলশানের ফ্ল্যাটে যাব দেখা করতে।

পেশাগত জীবনে যে কজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল, তাদের অন্যতম ছিলেন এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী। তাকে মনে হতো সুখী মানুষের প্রতিকৃতি। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মানুষটির মুখে অন্যের কুৎ​সা শুনিনি, রাগতে দেখিনি। ওনার স্ত্রী রেহানা সিদ্দিকীরও স্নেহ পেয়েছি। তিনি আরেক ভালো মানুষ, সমাজসেবায় জড়িত। স্বামী-স্ত্রী দুজনই একসঙ্গে গান গাইতেন। এই গান আপলোড করতেন ফেসবুক বা ইউটিউবে।

সেই ১৯৯৯ সালে এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয়, এরপর থেকে দিন দিন সম্পর্ক ও শ্রদ্ধা কেবলই বেড়েছে। প্রয়াত এই পুলিশ কর্মকর্তাই একসময় হয়ে উঠেছিলেন আমার রক্ষাকর্তা। খুলনায় প্রায় আট মাস পুলিশ পাহারায় রেখেছিলেন আমাকে। তখন খুলনা মহানগর পুলিশের কমিশনার ছিলেন আনোয়ারুল ইকবাল, যিনি পরে আইজিপি এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ওনার সঙ্গে পরিচয় আনোয়ারুল ইকবালের মাধ্যমে, যিনি বছরকয়েক আগে স্বর্গবাসী হয়েছেন।

খুলনায় একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবেদন করায় আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। ১৯৯৯ সালে ঢাকা থেকে খুলনায় যাওয়ার পর দেখেছিলাম, চার দেয়ালের মধ্যেও নলছিটির সেই ‘রাঙ্গা চোরা’ সন্ত্রাসীর নাম কেউ জোরে উচ্চারণ করত না। কারণ দেয়ালেরও নাকি কান থাকে! খুলনায় যাওয়ার পর শুনলাম যুবলীগ নেতা খালিদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অথচ কোনও পত্রিকায় খুনির নাম নেই। বোকার মতো (!) পুলিশের বরাত দিয়ে লিখে ফেললাম তার নাম। যেন মৌচাকে ঢিল ছুড়লাম। খুলনা ছাড়তে হবে, অথবা চুপ থাকতে হবে। সিদ্ধান্ত নেই লিখেই যাবো।

ওই কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী। একদিন তিনি আমাকে ফোন করলেন। ভরাট গলায় বললেন, ‘আমি এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী।’ আমি তো অবাক। আমার মতো একজন সাংবাদিককে আইজিপি ফোন করবেন কেন? এরপর বললেন, ‘ইকবালের (আনোয়ারুল ইকবাল) কাছ থেকে নম্বর নিলাম।’ তিনি আনোয়ারুল ইকবালকে পরামর্শ দিয়েছিলেন খুলনায় জনকণ্ঠ কার্যালয়ে সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারা দেয়ার জন্য। পুলিশ আমাকে সব সময় সহায়তা করবে, এমন আশ্বাসও দিলেন তিনি।

আইজিপির এই আশ্বাসে আমি তখন যেন বদ্ধ ঘর থেকে রাস্তায় ছুটে বের হই। কিন্তু আমার ততদিনে একা বাইরে বের হওয়া মানা। কেএমপি সদর দপ্তরে যেতে হলেও আমাকে পুলিশ ডাকতে হতো। আইজিপি থাকা অবস্থায় খুলনায় যতবার তিনি গেছেন, আমাকে ডেকেছেন। নিরাপত্তার কারণে নিজের গাড়ি পাঠিয়েছেন আমাকে সার্কিট হাউসে নেয়ার জন্য। আবার জনকণ্ঠ কার্যালয়ে পৌঁছে দিয়েছেন। অভয় দিয়েছেন, ওই সন্ত্রাসীর ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত লেখা চালিয়ে যেতে বলেছেন।

২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এর আগে ২০০০ সালের প্রথম দিকে ওই সন্ত্রাসীর প্রথম ফাঁসির রায় হয়। ওই রায় ঘোষণার কয়েক মাস পর দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইকবালের ঢাকায় ডাক পড়ে পদোন্নতিসহ। আর ওই বছরের জুনে আইজিপি পদ থেকে অবসর নেন এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী। খুলনায় তারা দুজনই ছিলেন আমার অভিভাবকের মতো।

এরই মধ্যে ২০০০ সালের ১৬ জুলাই যশোরে খুন হন প্রখ্যাত সাংবাদিক শামসুর রহমান। সেদিন মোংলায় এক জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন তৎ​কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই জনসভা কভার করে মোটরসাইকেলে মোংলা থেকে খুলনা ফিরছিলাম, সঙ্গী ছিলেন খুলনার ফটোসাংবাদিক ফাইয়াজ হাসান পলাশ। এরই মধ্যে ফজলুল বারী ভাই ঢাকা থেকে জানালেন জ্যেষ্ঠ সহকর্মী শামসুর রহমানের মৃত্যুর খবর।

খুলনা এসে জনসভার নিউজটি দ্রুত লিখে ফেললাম। জনকণ্ঠের খুলনা অফিসে আমার সহকর্মী অমল দাকে বললাম যশোরে শামসুর রহমান ভাইয়ের মরদেহ দেখতে যাওয়ার কথা। ওনার মরদেহ দেখার পর তাৎক্ষণিক ঢাকা চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। ওই রাতেই জনকণ্ঠের ঢাকা থেকে যাওয়া সহকর্মীদের সঙ্গে ফিরে আসি রাজধানীতে।

খুলনায় গিয়েছিলাম নিজের এলাকায় থেকে সাংবাদিকতা করব সেই স্বপ্ন নিয়ে, এক বছরের মাথায় ফিরে এলাম। আট মাস পুলিশ পাহারায় ছিলাম। যে দুই পুলিশ কর্মকর্তা আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন তাদের একজনের খুলনা ছেড়ে​ আসা, আরেকজনের অবসরে যাওয়ার ঘটনায় নিজেকে অসহায় মনে হয়। তার ওপর নিজ চোখে দেখলাম যশোরে প্রিয় সহকর্মীর নির্মম মৃত্যু।

সেই সময়ে খুলনায় আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার কথা মনে পড়ে, যাদের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞ। তাদের একজন হলেন তখনকার উপকমিশনার (সদর) মাজহারুল হক, ঢাকায় ডিসি রমনা থাকা অবস্থায় বিশেষ পরিস্থিতির মুখে চাকরি হারিয়েছেন এই মেধাবী ও পড়ুয়া পুলিশ কর্মকর্তা। আরেকজন কর্মকর্তা ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক চন্দ্রভূষণ মজমুদার, যিনি সিবি মজুমদার নামে পরিচিত ছিলেন। কোথায়, কেমন আছেন, তা জানি না। দেখা হলেই তিনি বলতেন, ‘আমরা ‘থ্রি পি’ (প্রেস, পুলিশ এবং পাবলিক) এক হয়েছি, সন্ত্রাসীর বিচার হবেই।’সোনাডাঙ্গাসহ খুলনায় একাধিক থানায় ওই সময়ের ওসির দায়িত্ব পালন করা কামরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ আছে আজও। তিনি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে অবসরে গিয়ে সেবামূলক কাজ করছেন। এ ছাড়া খুলনা রেঞ্জের তখনকার ডিআইজি লুৎফুল কবিরের কথা মনে পড়ে, যিনি বছর কয়েক আগে ছিনতাইকারীদের হাতে ঢাকায় মারা গেলেন। ওই সময়ে খুলনার সহকারী পুলিশ কমিশনার আওলাদ হোসেন কোথায় আছেন জানি না, তবে মনে পড়ে তার সহযোগিতার কথা। আরও অনেক কর্মকর্তার মুখ চোখের সামনে ভাসছে, কিন্তু মনে করতে পারছি না।

অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক ছিলাম না, কখনও এ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ জন্মায়নি। কিন্তু খুলনার ওই সন্ত্রাসীর কর্মকাণ্ড এবং তার ৬০ খুনের মধ্যে ২৪টি খুনের ওপর কাজ করতে গিয়ে যেন অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক হয়ে গেলাম। খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ছিল রক্তাক্ত জনপদ, যেখানে একে একে মারা গেলেন সাংবাদিক মানিক সাহা, হারুনুর রশীদ খোকন, বেলাল হোসেন, হুমায়ুন কবীর বালু প্রমুখ। খুলনায় থাকলে এই তালিকায় হয়তো আরেকটি নাম ঢুকে পড়ত। তবে স্বস্তি এটুকুই যে, ওই সন্ত্রাসীর খুনের সংখ্যা ৬০ পার হয়নি।

যা-ই হোক, খুনের জনপদ খুলনা ছেড়ে আসার পর এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকীর সঙ্গে সম্পর্কটা হয়ে ওঠে শ্রদ্ধা ​ও স্নেহের। পারিবারিক আলোচনা ও কুশল বিনিময় হতো বেশি। নিশ্চয়ই ভালো মানুষটির জন্য সৃষ্টিকর্তা বেহেশতের সুন্দর জায়গাটি বরাদ্দ করবেন।

এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী ১৯৭০ সালে এএসপি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। বাংলাদেশের প্রথম সিভিল পিসকিপিং কন্টিনজেন্টের কমান্ডার ছিলেন। বছর তিনেক আগে তিনি ওই দিবস উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজন করেন পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। সেখানে তিনিসহ তার ঘনিষ্ঠজন এবং পিসকিপিং মিশনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন স্মৃতিচারণা করেন। অনুষ্ঠানে অনেক দিন পরে দেখা হয় রেহানা সিদ্দিকীর সঙ্গে। এই দম্পতির ছেলে লুৎফি সিদ্দিকী এবং এক মেয়ে হুসনা সিদ্দিকী। লুৎফি সিদ্দিকী ইউনাইটেড ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাদের কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু সামনাসামনি দেখা সেদিনই।

ওই অনুষ্ঠানে তিনি দুজন সাংবাদিককে দাওয়াত করেছিলেন। একজন আমি, আরেকজন অগ্রজ হারুন হাবীব। হারুন ভাইকে তিনি পছন্দ করতেন। আমার প্রতি ছিল অন্ধ স্নেহ। আমি তখন প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক, পত্রিকার কাজ শেষ করে গুলশানে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাতে রাত ১১টা। বেশ আফসোস করে শ্রদ্ধেয় মানুষটি বললেন, ‘গ্রুপ ছবিতে আপনি থাকতে পারলেন না।’ এরপর ওনার সঙ্গে ছবি তুললাম। এত সহজে সেই ছবি খুঁজে পাব, এমন আশা করি না। কিন্তু হয়তো খুঁজে পাব একদিন।

ওনার স্নেহের একটি দৃষ্টান্ত দিই। ২০০৪ সালে আইজিপি পদ থেকে উনি অবসরে গেলেন। ২০০৬ বা ২০০৭ সালের দিকে একদিন আমাকে ডাকলেন উত্তরার বাসায়। বিদায় বেলায় বললেন, ‘লন্ডনের ফুটপাতে হাঁটছিলাম। হঠাৎ আপনার কথা মনে পড়ল। এই টি-শার্টটি কিনে ফেললাম, এটা পরবেন কিন্তু।’

ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে না বলতে পারিনি। কিন্তু বাসায় এসে দেখলাম, এটি বেশ বড় হয়ে গেছে। তাই আর পরা হয়নি। যত্নে তুলে রেখেছিলাম অনেক দিন। আব্বা ঢাকায় এলে তাকে একদিন বললাম টি-শার্টটি পরে দেখতে। উনি পরলেন, লেগে গেল ওনার গায়ে। এরপর আব্বাকে সেটি দিয়ে দিলাম, যিনি বেঁচে​ নেই। আরেকবার বিদেশ থেকে একটি টাই এনে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আমি টাই পরি না, সেটি এক বন্ধুকে দিয়েছিলাম।

ওনার চেহারা মনে পড়তেই চোখের সামনে ভাসছে সংস্কৃতিমনা, হাসিখুশি, সৎ​ এবং পরিচ্ছন্ন মানুষের প্রতিকৃতি। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অভিজাত পরিবারে এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকীর জন্ম, ১৯৪৫ সালে। তার বাবা ছিলেন এ এম এল এ সিদ্দিকী। সাবেক মন্ত্রী এল কে সিদ্দিকী ছিলেন তার ভাই।

প্রিয় মানুষটির মৃত্যুর খবর জানার পর ফেসবুকে ওনার আইডিতে ঢুকি। তার গলায় বেশ কয়েকটি গান শুনি। উনি অনেক ভালো গাইতেন তা বলব না। কিন্তু ওনার চেষ্টাটা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে থেকে​ও তিনি সস্ত্রীক সংগীতচর্চা করে গেছেন। কয়েকটি গানের সিডি প্রকাশ করেছেন। বিটিভির তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী ও উপস্থাপক ছিলেন তিনি।

এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকীর ফেসবুক আইডিতে ওনার গলায় শুনতে পাই প্রিয় একটি রবীন্দ্রসংগীত—‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে,নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে–জীবন-মরণ সুখ-দুখ দিয়েবক্ষে ধরিব জড়ায়ে॥’

লেখক: সাংবাদিক

pintu.dhaka@gmail.com

এ বিভাগের আরো খবর