দেশে বহুল প্রচলিত একটি টার্ম হচ্ছে ই-কমার্স। আমরা বুঝি আর না বুঝি দিনে দিনে সবাই ঝুঁকে পড়ছি এই নতুন ধারার দিকে। তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর এই বিশ্বে এখন সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছে ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশও সেই ধারা থেকে বাইরে নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ হবার রাস্তায় অনলাইন-ভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রটি একটি অন্যতম মাধ্যম। গোটা বিশ্বে এখন এই ই-কমার্সের জয় জয়কার! বলা হচ্ছে আগামীর বিশ্ব অর্থনীতি হবে ডিজিটাল অর্থনীতি।
আমি ই-কমার্স বিশেষজ্ঞ নই, তাই এর তাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক আলোচনায় আমি যাব না। একদম সাধারণের জ্ঞানে ই-কমার্স বলতে যা বুঝি তা হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে কেনাবেচার প্রক্রিয়া। এই ই-কমার্সেরও আছে বিভিন্ন ধরন। সেসব আলোচনা এখানে অপ্রয়োজনীয় বলে লিখছি না। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের প্রচুর অনলাইন-ভিত্তিক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীর প্রসার দেখা যাচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১০ কোটির মতো ইন্টারনেট গ্রাহক আছেন। এদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ জড়িত আছেন ই-কমার্স ও এফ কমার্সের মতো বাণিজ্যিক কার্যক্রমেও। এফ কমার্স বা ফেইসবুক-ভিত্তিক বাণিজ্যও কম চলছে না। এই যে এত মাধ্যমে বাণিজ্যিক চ্যানেল তৈরি হচ্ছে এবং ক্রেতাদেরকে অতি সহজে আকৃষ্ট করতে পারছে, এর পিছনে রয়েছে একটি বড় আকারের গ্রাহক চাহিদার হিসাব।
খুব সহজেই দোকান বা বাজারে না গিয়ে চাহিদামাফিক নির্দিষ্ট পণ্যটি পেতে সাহায্য করছে এই ই-কমার্স। যত চাহিদা বাড়ছে এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠছে বিপুলসংখ্যক বিক্রেতা। বাংলাদেশে এই ই-কমার্সের প্রচলন খুব বেশি দিনের নয়। অতি অল্প সময়ে বিস্তার লাভ করেছে ব্যাপক। এই কেনাকাটা একটি অভ্যাসের বিষয়। যত আমরা অভ্যস্ত হচ্ছি ততই অভিযোগের পাল্লাও বাড়ছে ক্রমশ। পণ্য না পাওয়া, সঠিক পণ্য না পাওয়া, সঠিক সময়ে না পাওয়া। পণ্যের মান ও দাম নিয়েও রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। বাংলাদেশে এই সময়ে সবচেয়ে বড় ই-কমার্স সাইট হচ্ছে ই-ভ্যালি। ইতোমধ্যেই এই প্ল্যাটফর্মটিকে কেন্দ্র করে উঠেছে গ্রাহক ঠকানোর অভিযোগ। তাদের ব্যবসায়িক মডেল নিয়েও রয়েছে আলোচনা। বেশি দামে পণ্য কিনে অর্ধেক দামে বা কখনও আবার অর্ধেকেরও কম দামে পণ্য বিক্রি করার কৌশলটি এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। ইতোমধ্যেই তাদের দেনার হিসাব বেড়ে দাঁড়িয়েছে সম্পদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
বাংলাদেশে অনলাইন-ভিত্তিক কেনাকাটা একদমই নতুন। এখন পর্যন্ত এর কোনো কাঠামোই দাঁড়ায়নি। হঠাৎ করেই বাড়তে থাকা এই সেক্টরটি তাই হয়ে উঠছে মাথাব্যথার কারণ। ইতোমধ্যেই ই-ভ্যালির সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছে গ্রাহক ও সাপ্লায়ারদের লাখ লাখ টাকা আটকে আছে। সেগুলো কেমন করে ফেরত দেবে সেই উপায়টিও জানা নেই কারো। কেবল ই-ভ্যালিই নয়, ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আছে জানা অজানা আরও অনেক। জানা যায়, একই মডেলের বিজনেস পলিসি নিয়ে বাজারে ছোট বড় আরও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। একটি প্রতিষ্ঠান মানে কিন্তু কেবল ব্যবসাই নয়। একদিকে যেমন একটি বড় আকারের সাপ্লাই চেইন গড়ে ওঠে অপরদিকে কর্মসংস্থান হয় অনেক লোকের।
ই-ভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল ক্রেতাদের অভ্যাসকেই নষ্ট করছে না, সাপ্লাই চেইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকেও নষ্ট করে দিচ্ছে। দেশের অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটা বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে। আর অস্বাভাবিক ডিসকাউন্ট অফার পেয়ে ক্রেতারা পাগলের মতো হামলে পড়ছে সেখানে। কোনোরকম বিচার বিবেচনা ব্যতিরেকেই পরিচালিত হয়ে আসছিল ই-ভ্যালির এই ব্যবসা। তারপরও ভালো সংবাদ যে, সবকিছু হাতছাড়া হবার আগেই টনক নড়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের।
কিন্তু এই যে এতদিন ধরে তারা বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা বজায় রেখেছে তার পিছনে আসলে দায় কার? আমাদের দেশে কোনো ঘটনা ঘটার আগে কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না অথচ লোকসান হয়ে যাবার পর আসে অনেক তথ্য। ই-ভ্যালির যে পরিমাণ দেনা আছে মার্কেটে সেটা শোধ করবার মতো সক্ষমতা দেখছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। তাহলে যেসব গ্রাহক বা মার্চেন্ট এতদিন বিনিয়োগ করে আসছে তাদের কী হবে? না পণ্য পাচ্ছে, না টাকা ফেরত পাচ্ছে। এমন অবস্থা কেন দাঁড়াল? কোনো মনিটরিং কি আদৌ ছিল? আলোচনায় এসেছে ব্যবসায়ী থেকে ক্রেতা বা পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ই-কমার্সভিত্তিক জ্ঞান নিয়েও।
আগেই বলেছি আমাদের দেশে ইন্টারনেট-ভিত্তিক লেনদেন খুব অল্পদিনের। এই অল্প সময়ের মধ্যে যে যে কাজগুলো করার কথা ছিল সেগুলোর করা হয়নি সঠিকভাবে। দরকার ছিল ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি। কেবল ডিসকাউন্ট অফার পেলেই দৌড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। দেখতে হবে সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক স্বচ্ছতার বিষয়টিও। ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ছিল না কোনো রেগুলেটরি হিসাব-নিকাশ। অতি সম্প্রতি মূলত ই-ভ্যালি কাণ্ডের পরই তড়িঘড়ি করে ঘোষণা করা হয়েছে ই-কমার্স গাইডলাইন। এই কাজটি আরও অনেক আগেই করা দরকার ছিল। কেন ই-ভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের মতো সাধারণ গ্রাহকদের চাহিদাকে পুঁজি করে দিনের পর দিন নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যবসা করে যাবে? যেসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে সেগুলো করার সুযোগইবা পেল কেমন করে?
আমাদেরকে আরও অনেক এগোতে হবে। বিশ্ব ডিজিটাল অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে ই-কমার্স, এফ কমার্সসহ অনলাইন-ভিত্তিক এসব ব্যবসাকে বন্ধ করারও কোনো উপায় নেই। ক্রমশ এগোতে হবে সেদিকেই। করোনা আসার পর এই প্রয়োজনীয়তা যেন এগিয়ে এসেছে অন্তত কয়েক বছর। সময়ের চাহিদা হচ্ছে ডিজিটাল কেনাবেচার প্লাটফর্ম। তাই ই-কমার্সভিত্তিক এই পথটিকে বন্ধ বা নষ্ট হতে দেয়া যাবে না কোনোভাবেই। দেশের স্বার্থেই এর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআইসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে। সরকার যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সেটিকে যুগোপযোগী করে জনসাধারণের সচেতনার কাজটি করতে হবে ব্যাপক হারে। ক্রেতার বিশ্বাস ও সন্তুষ্টি যেন নষ্ট না হয়ে যায় সেদিকটিও লক্ষ রাখা উচিত। মার্কেট গড়ে ওঠার আগেই যেন তা নষ্ট না হয় সেই লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে ক্রেতা, কর্তৃপক্ষ, ব্যবসায়ী সবাইকে।
লেখক: প্রবন্ধকার