বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শ্রমজীবীদের বিপন্নতা নিয়ে কে ভাবে

  • রণেশ মৈত্র   
  • ১৭ জুলাই, ২০২১ ১৯:০৭

গ্রামের দিনমজুর-ক্ষেতমজুর- যারা সংখ্যায় কমপক্ষে এক থেকে দেড় কোটি - তারাও সংকটাপন্নের তালিকাভুক্ত। তাদের জন্য কখনও কোনো ভর্তুকি বা প্রণোদনার ব্যবস্থা আজও হয়নি। সুতরাং ১৭ কোটি মানুষের পেটে ভাত জোটানোর কারিগর এই শ্রমজীবী কৃষকদেরকে বাঁচাতে তাদের জন্য সাংবাৎসরিক পল্লি রেশনিং, স্বল্পমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার ও সারা বছর কাজের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

ঈদ আসন্ন। বাড়তি খরচ অপরিহার্য। এর আগেই করোনা মহামারি ভয়ংকর মাত্রায় হানা দিয়েছে। অফিস-আদালত, কল-কারখানা, গণ-পরিবহন সবই বন্ধ না রেখে উপায় নেই। তাহলে শ্রমজীবীরা কী করবেন? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক এবং এর যথাযথ উত্তর খুঁজে সব দিক সামাল দিতে না পারলে দেশের সামগ্রিক জীবনেই ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে বাধ্য এবং সে ক্ষেত্রে কারো পক্ষেই রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২৩০ জন ছাড়ানোর অর্থ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

পরিস্থিতির ক্রমাবনতি দৃষ্টে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা করোনা-সংক্রমণ ও মৃত্যু যে হারে বাড়ছে তাতে মার্চ-এপ্রিলের চেয়েও পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। মৃত্যুর হিসাব পর্যালোচনায় যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে- তা কম-বেশি ২০২০-এর মার্চ থেকেই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।

প্রথম দিকে যে কঠোরতা জারি করা হয়েছিল-তাতে ফলও কিছুটা ফলে। গত বছরের মে থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটাই সহনশীল ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির ক্রমাবনতি শুরু হয় তার পর থেকে। বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা গত ঈদুল-ফিতরের সময় যে ভয়াবহ জনস্রোত ঢাকা থেকে গ্রামমুখী-আবার এক সপ্তাহ পর গ্রাম থেকে শহরমুখী হলো তার পর থেকেই পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে শহর পর‌্যন্ত। দুই মাসের মতো ব্যবধানে মৃত্যু-সংক্রমণের এই ভয়াবহ বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে।

আসন্ন ঈদ-উল-আজহায় পারা যাবে কি এবারে জনস্রোত ঠেকাতে গত ঈদের অভিজ্ঞতা থেকে? আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলছেন- এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত-করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকানো যেত। বুঝে নিতেই হয়-একদিকে সীমাহীন গাফিলতি, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী।

কী করা উচিত ছিল? কঠোর লকডাউন দিয়ে সব কিছু বন্ধ করে ঈদযাত্রা সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব করে তোলার মাধ্যমে। উল্লেখ্য, সেবারে ঈদযাত্রা স্থগিত রাখার লক্ষ্যে সরকারপ্রধান বলেছিলেন, ঈদের নামাজ ময়দানেই পড়তে হবে তা নয়, মসজিদে (স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে)।

একজন প্রধানমন্ত্রী যখন এমন আবেদন জানান তখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিশেষত স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এবং কিছুটা পরিমাণে ধর্ম মন্ত্রণালয়েরও তীক্ষ্ণভাবে নজর রাখা যাতে প্রধানমন্ত্রীর ওই আবেদন বৃথা না যায় বরং তা পুরোপুরি কার্যকর করা হয়। কিন্তু কার্যত দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।

উল্লিখিত মন্ত্রণালয়গুলো থাকল পুরোপুরি নিস্পৃহ। বাস-ট্রেন না চললেও বাদ-বাকি সব যানবাহনের হয়ে পড়লো পোয়াবারো। লাখ লাখ মানুষ ছুটতে থাকল নিজ গন্তব্যে। কেউ রিকশায়, কেউ ভ্যানে, কেউ স্কুটারে বা অপরাপর যানবাহন এমনকি লঞ্চ সার্ভিসও চালু হয়ে গেল। শুধু হলো না মাঠে নামাজ। কিন্তু খুব কম মসজিদেই বিধি-বিধান মেনে স্বল্পসংখ্যক মুসল্লি নিয়ে দফায় দফায় নামাজ হলো। পুলিশ কোথাও কাউকে বাধা দিল না। পুলিশের সংখ্যাও রাস্তায় রাখা হয়েছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম।

এই পরিস্থিতির শিকার হতে হলো আজকের বাংলাদেশকে। বেড়ে গেল পরিবহনের ভাড়া হু হু করে, বৃদ্ধি পেল ঈদের প্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্য।

এমতাবস্থায় শিকার হতে হলো শ্রমজীবী মানুষের। তাদের বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে করোনার শুরু থেকেই অর্থাৎ ২০২০-এর মার্চ থেকেই। মালিকেরা শ্রমিকদেরকে কাজ করতে বাধা না দিয়ে তাদের বেতন ও প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা করল যাতে গার্মেন্টসসহ সকল মিল, কল-কারখানার শ্রমিকেরা তাদের বেতন বকেয়াসহ পান। প্রণোদনার ওই টাকা দিব্যি চলে গেল মালিকদের পকেটে। আবার শেষে এসে জানা গেল তাদের রফতানি বাজার ঠিকই ছিল অর্থাৎ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মুনাফা তাদের ব্যাংকে, পকেটে, ও বিদেশে ঠিক ঢুকল।

এ ক্ষেত্রে শিল্প ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের করণীয় ছিল ব্যাপক। চাইলে তারা বাধ্য করতে পারত মালিকদেরকে, বাধ্য করতে পারত যাতে শ্রমিকেরা সরকারের প্রণোদনা ও মালিকের অর্জিত মুনাফা থেকে তাদের সকল বকেয়া হতে পাওনাসহ শোধ করে দিতে বাধ্য করতে। কিন্তু সে দায়িত্ব পালনে তারা এগিয়ে আসেননি। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির শিকারে তাদেরকে ঠিকই পরিণত হতে হলো।

এই শ্রমজীবী বলতে শুধু শহরে শ্রমিকদের কথা বলছি না। গ্রামের দিনমজুর-ক্ষেতমজুর- যারা সংখ্যায় কমপক্ষে এক থেকে দেড় কোটি - তারাও সংকটাপন্নের তালিকাভুক্ত। তাদের জন্য কখনও কোনো ভর্তুকি বা প্রণোদনার ব্যবস্থা আজও হয়নি। সুতরাং ১৭ কোটি মানুষের পেটে ভাত জোটানোর কারিগর এই শ্রমজীবী কৃষকদেরকে বাঁচাতে তাদের জন্য সাংবাৎসরিক পল্লি রেশনিং, স্বল্পমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার ও সারা বছর কাজের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তরা অনাহারে থাকবেন কিন্তু মুখ ফুটে বলবেন না তারা ক্ষুধার্ত। তাদের জীবনযাত্রা মারাত্মক সংকটের মুখে পড়েছে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে। পণ্য মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেখা যায় কি দেশি কি বিদেশি সকল পণ্যেরই দাম বেড়েছে কয়েকগুণ।

তারা গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের গায়ে কোনো সময়েই হাত পড়ে না, কারণ রাঘববোয়ালদের অনেক নেতাই এর সঙ্গে জড়িত। ফলে পর্যালোচনাও হয় না। মাঝে মধ্যে সরকারি নেতারা হুংকার ছাড়েন দ্রবমূল্য বৃদ্ধি করলে সরকার তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না। এসব ব্যাপারে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছেন। এরপর হয়তো কোন কোন বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত যাবে- কাকে কাকে জরিমানা করা হবে এর খবর পেয়ে নিকটবর্তী সব দোকানদার দোকান বন্ধ করে চলে যাবে- ব্যর্থ হবে ভ্রাম্যমাণ আলাতের অভিযান। পরদিন থেকে দেখা যায় মূল্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

এহেন পরিস্থিতিতে বাজার পরিদর্শন, বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সকল জেলা-উপজেলা পর্যাপ্ত পরিমাণে টিসিবি পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করলে মানুষের দুর্ভোগ বহুলাংশে মিটতে পারে যদি অবশ্য তা ভোগান্তিমুক্ত হয়।

এ সব ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরেও শ্রমজীবী মানুষের সংকটের পূর্ণাঙ্গ সমাধান হবে না। তা করতে হলে আর্থিক সহায়তাও ব্যাপকভাবে করতে হবে। তা সম্ভব হতে পারে বহুমূখী উদ্যোগ নিলে।

এক. মিল কারখানাসমূহে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন বাজারদরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে তিন বছর অন্তর বৃদ্ধি করার আইন ও তা প্রয়োগের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।

দুই. তাদের তাবৎ বকেয়া বকেয়া পাওনা ঈদের আগে বাধ্যতামূলকভাবে পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিন. নারী-পুরুষ শ্রমিকের বেতন ভাতায় সমতা বিধান করতে হবে;

চার. মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ও পুরুষদের পিতৃত্বকালীন ছুটি যথাক্রমে এক বছর ও ছয় মাস নির্ধারণ করতে হবে;

পাঁচ. বন্ধ কল-কারখানা যাতে করোনাকাল শেষে যেন চালু হয় এবং শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ ও মাসিক বেতন মাসেই প্রদান করার ব্যবস্থা চালু করা;

ছয়. নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, শ্রমজীবী যারাই করোনাকালে অভুক্ত থাকবেন যথাযথভাবে তাদের উপযুক্ত তালিকা প্রণয়ন করে তাদেরকে খাদ্য-ওষুধ-আর্থিক সহায়তা দানের ব্যবস্থা করতে হবে।

সাত. সর্বত্র করোনা পরীক্ষার ল্যাব বসিয়ে দ্রুত পরীক্ষার ফল জানা এবং পরীক্ষিত রোগীদের বিজ্ঞানসম্মত আইসোলেশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, এবং

আট. আঠারো বছর পর্যন্ত সব নারী-পুরুষের করোনা ভ্যাকসিন প্রদানের ব্যবস্থা আগামী তিনমাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে কারণ এ ছাড়া দরিদ্রদের সংক্রমণ প্রতিরোধ বা কারো ক্ষেত্রেই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর