‘করোনায় মৃত্যুতে বিশ্বে শীর্ষ দশে বাংলাদেশ’—এই সংবাদটি যেদিন গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়, সেদিনই অর্থাৎ ১২ জুলাই দেশের কয়েকটি মূলধারার সংবাদপত্রে প্রকাশিত আরও কয়েকটি শিরোনাম ছিলো এরকম:
১. শনাক্ত নতুন উচ্চতায়, মৃত্যু আরও ২২০।
২. কিছুতেই কমছে না সংক্রমণ, সামনে ভয়াবহ সময়!
৩. কীসের লকডাউন, সবইতো দেখি খোলা।
৪. ১৫ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত চলবে গণপরিবহন।
৫. রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট ১৭ জুলাই থেকে।
কোরবানির ঈদ উপলক্ষে যেদিন চলমান বিধিনিষেধ বা কঠোর লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত হয়, সেদিন করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ শনাক্তের তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এদিনের পরিসংখ্যান বলছে, ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ২২০ জন। নতুন করে শনাক্ত ১৩ হাজার ৭৬৮ জন। এ নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৭ জনের দেহে।
মৃত্যু হয়েছে ১৬ হাজার ৬৩৯ জনের। সুতরাং করোনা পরিস্থিতি যখন বলতে গেলে চূড়ান্ত খারাপ; যখন কোনো হাসপাতালে আইসিইউ তো দূরে থাক, সাধারণ বেডও খালি নেই; যখন মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্স নেই; যখন হাসপাতালগুলোয় সীমাহীন সংকট, তখন লকডাউন শিথিল করে দেয়ার পেছনে যে যুক্তিই থাকুক না কেন; মানুষের আবেগ-অনুভূতি আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থ যতই বড় হোক- এর জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে।
বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ঈদের সময় মানুষকে বাড়ি যাওয়া-আসার সুযোগ দেয়া হলে সেখানে স্বাস্থ্যবিধি বা শারীরিক দূরত্বের কোনো বালাই থাকে না। বরং পরিবহনের সংখ্যা কম হলে একজনের ঘাড়ে চেপে আরেকজন যাবে। এরইমধ্যে গণপরিবহনে রাজধানী থেকে দেশের নানা প্রান্তে মানুষের ছুটে চলার যেসব দৃশ্য গণমাধ্যমে এসেছে—তা সুখকর নয়।
কোরবানির ঈদের সঙ্গে রোজার ঈদের একটা বড় পার্থক্য হলো, ঢাকা শহরে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বিরাট অংশ কোরবানির দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সারা শহর থেকে মাংস সংগ্রহের পরে ওইদিন রাতে বা পরদিন ভোরে মাংস নিয়ে বাড়িতে যান। কিন্তু বলা হচ্ছে, বাস ও ট্রেনে আসন ফাঁকা রেখে যাত্রী বসবেন। ট্রেনে টিকিট কাটতে হবে অনলাইনে।
এই সাধারণ মানুষের কতজন অনলাইনে টিকিট কাটতে পারবেন? তারা যখন এক সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও লঞ্চঘাটে হাজির হবেন—তাদের স্রোত কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঠেকাতে পারবে? সেখানে কোনো শারীরিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি বজায় থাকবে? যেখানে ট্রাক থেকে টিসিবির খোলা বাজারে পণ্য কেনার লাইনেই কোনো শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকে না, বরং লোকজন গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে ঈদযাত্রায় বাস-লঞ্চ ও ট্রেন স্টেশনে কী পরিস্থিতি হবে বা হয়— তা দেশবাসীর অজানা নয়। রোজার ঈদের সময় ফেরিঘাটে যে চিত্র দেখা গেছে এবং এখন করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর যে ঊর্ধ্বগতি, তার পেছনে ঈদের সময়ে মানুষকে এই বেপরোয়া চলাচলের সুযোগ দেয়া যে অনেকাংশে দায়ী, সেটিও কি অস্বীকার করা যাবে?
পশুর হাটেও কি কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব হবে? সেখানে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়াবে; একটি গরু কোরবানি দেবেন যে সাতজন, পারলে তারা সবাই হাটে যাবেন। কারণ কোরবানির পশু জবাই যেমন একটি ধর্মীয় বিধান, তেমনি এটি একটি উৎসবও। সেই উৎসবের একটি অংশ হচ্ছে কোরবানির পশু কিনতে দল বেঁধে হাটে যাওয়া।
সুতরাং হাট বসতে দিলে মানুষ যে দল বেঁধেই সেখানে যাবে, তা ঠেকানো কঠিন। উপরন্তু এখনও মাস্ক পরার ব্যাপারে মানুষের যে অনীহা, তাতে পশুর হাটের মতো একটি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা, যেখানে একসঙ্গে অনেক লোকের সমাগম হয়, সেখানেও যে তারা মাস্ক ছাড়াই কিংবা থুতনির নিচে মাস্ক রেখে ঘোরাফিরা করবেন, তাতে আর সন্দেহ কী! এরইমধ্যে সুমন হোসেন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর এসেছে, যিনি কোরবানির হাট থেকে ফিরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
১৬ জুলাই সন্ধ্যায় যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ১০-১২ দিন আগে তিনি তার বাবার সঙ্গে গরু কিনতে বাজারে যান। বাড়িতে ফিরে সেদিন রাতেই তার জ্বর হয়। শ্বাসকষ্ট বাড়লে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সুতরাং, এরকম ঘটনা যে আরও ঘটবে, তাতে সন্দেহ কম। অর্থাৎ রোজার ঈদের পরে যেমন করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছ, কোরবানির ঈদের পরে পরিস্থিতি হয়তো আরও ভয়াবহ হবে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতির ভেতরেও গণপরিবহন চলাচল এবং পশুর হাট করতে সুযোগ দেয়ার পেছনে দেশের অর্থনীতি ও মানুষের ধর্মীয় আবেগকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যে হারে মানুষ মরছে এবং সবগুলো সরকারি হাসপাতাল যখন প্রায় টইটম্বুর, তখন অন্তত এই একটিবারের জন্য হলেও সবাইকে যার যার জায়গায় থাকার কঠোর নির্দেশ দেয়া এবং সেটি বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রয়োজনে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেয়াই যুক্তিযুক্ত ছিল। সেইসঙ্গে এবার অনলাইনে পশু কেনার যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেগুলোকে অনেক বেশি সহজ ও ক্রেতাবান্ধব করা এবং খুব বেশি হলে এলাকাভিত্তিক কয়েকটি হাটের অনুমতি দেয়া যেত— যেখান থেকে শুধু কমিউনিটির লোকেরাই কিনতে পারতেন।
যেসব ব্যবসায়ী ক্ষতির শিকার হতেন, তাদেরকে সরকার প্রণোদনা দিতে পারত। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে যেখানে শত শত কোটি টাকা তছরুপ হয় এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নিজের আবেগের প্রকল্প বলে খ্যাত আশ্রয়ণ প্রকল্পেও অভাবনীয় দুর্নীতি হয়, সেখানে কোরবানির পশু বিক্রেতাসহ লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য মানুষের যতটা সম্ভব একটি সঠিক তালিকা করে প্রণোদনা দেয়া খুব কঠিন কাজ নয়। কারণ গত বছরের দুটি ঈদের সময়ে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণের যে হার ছিল, এমনকি গত রোজার ঈদের সময়েও যে ভয়াবহতা ছিল, তার তুলনায় এবারের বাস্তবতা অনেক বেশি ভয়াবহ ও করুণ!
গত শীতে দ্বিতীয় ঢেউ আসার উদ্বেগ থাকলেও সংক্রমণ ও মৃত্যু—দুটোই কমে আসে। একপর্যায়ে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে নেমে যায়। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবেচনায় মহামারি নয়, নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি। কিন্তু গত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শনাক্তের হার আবার বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় ঢেউ নিশ্চিত হওয়ার পর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ভারতে করোনার নতুন ধরনের কথা জানা যায় এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। সুতরাং আগের ঈদগুলোয় মানুষকে বাড়ি যেতে দেয়া হয়েছে বলে এবার এই চূড়ান্ত খারাপ সময়েও লকডাউন শিথিল করে গণপরিবহন চালু করে দেয়া এবং পশুর হাট বসতে দেয়া যেকোনো যুক্তিতেই আত্মঘাতী।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিনও সতর্ক করে বলেছেন, ‘সংক্রমণের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। যে হারে দেশে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে তাহলে আগামী সাত থেকে ১০ দিন পর আর হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে না।’ এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ হয়ে যাবে বলেও তিনি হুঁশিয়ার করেন। অথচ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করা গেল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই সতর্কবাণীর পরেই লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত হলো। শোনা যাচ্ছে, করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটিও এই লকডাউন শিথিলের পক্ষে নয়। প্রশ্ন হলো, কে কার পরামর্শে এরকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলেন?
বিষয়টা এমনও হতে পারে যে, নানা পক্ষের চাপে লকডাউন শিথিল করা হলেও যেহেতু কোরবানির ঈদের পরে একটা লম্বা সময় এমনিতেই সবকিছু ছুটির আমেজে থাকে, ফলে সেই সময়ে টানা ১৪ দিন সত্যিকারের কঠোর লকডাউন দিয়ে সরকার হয়তো করোনার সংক্রমণ কমানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু তারপরও ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসা এবং কোরবানির পশুর হাটে যে পরিমাণ স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হবে— তার খেসারত কতটা দিতে হয়— সেটিই উদ্বেগের।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।