৩৬ বছর বয়স্ক, হার্ভার্ড-শিক্ষিত লি জান সিওককে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান বিরোধী দল পিপল পাওয়ার পার্টির নেতা নির্বাচিত করা হয়েছে। লি জান সিওককে এমন একটা সময়ে তার দলের নেতা করা হয়েছে, যখন আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আর মাত্র এক বছর কয়েক মাস পরে অনুষ্ঠিত হবে সে দেশে। এবং আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাকে এমন একটা বয়সে নেতা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে, যে বয়সে তিনি আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। কারণ, কোরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হলে তাকে ৪০ বছর বয়স্ক হতে হবে। লির বয়স হবে সে সময় ৩৭। যে কারণে তিনি পার্টি প্রধান থাকলেও তাকে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থী তার দল থেকে ঠিক করতে হবে।
তারপরেও সবকিছু জেনেশুনে কেন এমন একটা সময়ে একজন তরুণকে দক্ষিণ কোরিয়ার কনজারভেটিভ নীতির এই পিপল পাওয়ার পার্টির নেতা করা হলো? এ প্রশ্ন এখন যেমন কোরিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের, তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও। বাস্তবে লি এমন একটা সময়ে তার দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন, যে সময়ে সে দেশে লিবারল ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় থাকলেও তারা উদার গণতন্ত্রের পক্ষে শতভাগ কথা বলছেন না। এমনকি তারা উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে শতভাগ নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন না।
কোরিয়ার বর্তমান ক্ষমতাসীনরা লিবারেল ডেমোক্রেটিক হলেও তারা এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ গণতন্ত্রবিবর্জিত দেশ চায়না ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখছে বলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। বলা হচ্ছে, বর্তমানের দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার অনেকখানি চায়নাপন্থি, যে কারণে জনগণ তাদের প্রতি খুশি নয়। তা ছাড়া এ মুহূর্তে ওই এলাকার সব থেকে বড় সমস্যা হংকংয়ের গণতন্ত্র ও সাউথ চায়না সি নিয়ে চায়নার নীতি। এ ক্ষেত্রে যদিও কোরিয়ার বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুরুতেই বলেছে, তারা চায়নার দুই নীতি এবং হংকংয়ের সর্বোচ্চ স্বাধিকারের পক্ষে। তবে সে দেশের জনগণ মনে করেছে, সম্প্রতি হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের ওপর চায়নার মেইনল্যান্ড সরকার যে কঠোর দমন নীতি চালিয়েছে, তার বিপরীতে দক্ষিণ কোরিয়া মোটেই উচ্চকণ্ঠ ছিল না। এমনকি সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এক কথায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হলেও দক্ষিণ কোরিয়া যথার্থ প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
এর বিপরীতে লি বলছেন, তার জন্ম ১৯৮৫ সালে। তার দুই বছর পরেই কোরিয়ার সামরিক শাসকের অবসান হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ তিনি গণতান্ত্রিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। তা ছাড়া তিনি বিশ্বাস করেন, গণতন্ত্র এমন একটি পদ্ধতি, যা বিচ্ছিন্নভাবে কোনো একটি দেশে চলতে পারে না। গণতন্ত্র রক্ষা করা প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকের কর্তব্য এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন জেনারেশন এটাই পছন্দ করে। লি সেই নতুন জেনারেশনেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। অন্যদিকে লিকে নিয়ে তার দল পিপল পাওয়ার পার্টির কোনো তাড়াহুড়ো নেই বলেই সবাই মনে করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, লি মূলত তার দলের পক্ষ থেকে ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। এবং এ সময়ের মধ্যে লি নিজেকে রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি অভিজ্ঞ ও যোগ্য করে তুলতে পারবেন। এবং ২০২৭ সালের আগ অবধি যদি তার দল বিরোধী দলেও থাকে, তাহলেও তার দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ, বৈদেশিক নীতি ও কোভিড-পরবর্তী নতুন অর্থনৈতিক যুগে তিনি বিরোধী দলে থেকেও কোরিয়ার জনগণের জন্য কাজ করতে পারবেন। কোনো গণতান্ত্রিক দেশই দায়িত্বপূর্ণ ও যোগ্য নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ছাড়া স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আর এই কাজে লি অনেক যোগ্য হবেন নতুন প্রজন্মের নেতা হিসেবে।
অন্যদিকে আরও একটি ধারণা সবার মনে আসবে, বর্তমানের দক্ষিণ কোরিয়ার মুন সরকার কিছুটা চায়নার দিকে ঝুঁকে পড়াতে চায়নার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা হার্ভার্ড-শিক্ষিত লিকে কোরিয়ার নতুন নেতা হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। কারণ আমেরিকাসহ পৃথিবীর তাবৎ বড় শক্তি মনে করে, আগামী দশকে চায়না ও আমেরিকার নেতৃত্বাধীন জোট সরাসরি অনেক রকম সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে এশিয়ার এই অঞ্চলে। আর সে জন্য তারা এ অঞ্চলের অনেক দেশেই তাদের বিশ্বস্ত নেতা এখন থেকেই গড়ে তুলবে। আর সেসব নেতা যে তরুণ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং এ কথা সত্য, বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক হিসাব-নিকাশ বাদ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল চলতে পারবে না।
দক্ষিণ কোরিয়া এলাকায় যখন মূল সমস্যা উদার গণতন্ত্র এবং তা গ্রাস করতে চাচ্ছে চায়না, ঠিক তেমন একটি সময় দক্ষিণ এশিয়ায় সব থেকে বড় সমস্যা হিসেবে সামনে এসেছে আফগানিস্তান পরিস্থিতি। বাইডেন প্রশাসন সেখান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়। এবং একটি বিমানঘাঁটি থেকে কিছু সেনা প্রত্যাহার করে। আর এর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে দেশের প্রায় ৮০ ভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে তালেবানরা। এর ভেতর দিয়ে প্রমাণিত হচ্ছে, দ্রুতই তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করবে। এবং নিকট ভবিষ্যতে পাকিস্তানও তাদের করায়ত্ত হবে। আর এমন একটি ভবিষ্যতে দাঁড়িয়ে বলা যায়, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান তালেবানদের করায়ত্তে গেলে বাংলাদেশের তালেবান অর্থাৎ জামায়াত-হেফাজত অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। সে সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার জন্যে অবশ্যই সরকারের পাশাপাশি আধুনিক প্রজন্মের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলেরও দরকার হবে।
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্ব এখন দুর্বল। তারা ঘরে উঠে গেছে। তবে তাই বলে কেউ বলে না যে, বিএনপির জনসমর্থন নেই। বিএনপির জনসমর্থন আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপির সমর্থক আর হেফাজতের সমর্থকের চরিত্র দিন দিন একই কাতারের দিকে চলে যাচ্ছে। অথচ এ সময়ে সব থেকে বড় প্রয়োজন ভবিষ্যতে যাতে মৌলবাদীদের হাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন না হয়। আর সে জন্য সরকার ও বিরোধী দলকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। তাই এ সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বিরোধী দলগুলোর দায়িত্ব এমনই নতুন প্রজন্মের আধুনিক নেতা নির্বাচন করা, যারা আগামীতে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে মৌলবাদের হাত থেকে দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করবে। এবং আগামীতে এই এলাকায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে হিসাব-নিকাশগুলো বড় হয়ে দেখা দেবে, সেখানে তারা গণতন্ত্রের পক্ষে থাকবে। কোনো মৌলবাদ বা একনায়কতন্ত্রের পক্ষে নয়।