১৬ জুলাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি কালোদিন। ২০০৭ সালে এই দিনে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতন্ত্রের মানসকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে বিনা পরোয়ানায় আইনবহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যায়, অবিচার, গণতন্ত্রকে হত্যা করার বিরুদ্ধে জননেত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠ রোধ করার জন্যই সেদিন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে মূলত গণতন্ত্রকেই বন্দি করা হয়েছিল।
অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় এসে ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশকে বিরাজনৈতিকীকরণের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল দেশের দুই প্রধান রানৈতিক নেত্রীকে বিদেশে চলে যেতে বাধ্য করা। ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ দেশরত্ন শেখ হাসিনা সন্তানদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমেরিকা ও কানাডা যান। সেই সুযোগটাই গ্রহণ করে ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদ সরকার।
শেখ হাসিনা যাতে দেশে ফিরে না আসতে পারেন, সে জন্য পরিকল্পনা মোতাবেক ৯ এপ্রিল ওয়েস্টজোন পাওয়ার কোম্পানির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম ফারুক, ইস্টকোস্ট ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে চৌধুরী, ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর আলী প্রমুখ ব্যবসায়ীকে দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা করানো হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা ভুয়া মামলাকে চ্যালেঞ্জ করে আইনগতভাবে মোকাবিলার জন্য ১৪ এপ্রিল দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ১১ এপ্রিল শেখ হাসিনাকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য আগের একটি হত্যা মামলায় আসামি করে চার্জশিট দেয়া হয়।
এরপরও অদম্য শেখ হাসিনা দেশে ফেরার ব্যাপারে অনড় থাকলে ১৮ এপ্রিল ২০০৭-এ সরকার শেখ হাসিনাকে দেশের জন্য ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ আখ্যায়িত করে দেশে ফেরার ব্যাপারে চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইটকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, শেখ হাসিনাকে বহন করলে ঢাকায় তাদের ল্যান্ড করতে দেয়া হবে না। কিন্তু তিনি তো বঙ্গবন্ধুকন্যা, তাকে তো এভাবে আটকানো সম্ভব নয়। সব বাধাকে অতিক্রম করে ৭ মে জরুরি অবস্থা এবং সরকারের কঠোর প্রতিরোধের মুখে তিনি দেশে ফিরে আসেন। জরুরি অবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লাখ লাখ জনতা মুজিবকন্যাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! সেনাসমর্থিত সরকারের তোপের মুখে জীবনবাজি রেখে লাখো মানুষ বিমানবন্দর থেকে হেঁটে মিছিল সহকারে তাদের প্রিয় নেত্রীকে প্রথমে ধানমন্ডি ৩২ নং বঙ্গবন্ধু ভবন ও পরে সুধা সদনে নিয়ে যায়G
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিকল্পনা ছিল শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করা। সে জন্য বের করা হয় অদ্ভুত তত্ত্ব মাইনাস-টু ফর্মুলা। অর্থাৎ দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করা। কিন্তু তারা জানত তাদের ক্ষমতার পথের কাঁটা শেখ হাসিনাই। তাই তাকে মাইনাস করার জন্য উঠেপড়ে লাগে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। বাংলাদেশের কিছু স্বঘোষিত সুশীল ও দুটি গণমাধ্যমের সম্পাদক তো শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বাদ দেয়ার জন্য মিশন নিয়ে নেমে পড়ে।
১১ জুন ২০০৭ সালে প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক তো নিজেই মন্তব্য কলাম লিখলেন, ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে।’ পত্রিকা দুটির কাজই ছিল জনপ্রিয় নেতাদের চরিত্র হনন করা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বিতীয় পরিকল্পনা হলো ফৌজদারি দণ্ড দেয়ার মাধ্যমে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণা করে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়া। তাদের একমাত্র টার্গেট ছিল শেখ হাসিনাই। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয় লোকদেখানো, যেহেতু শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেহেতু খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা না হলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে।
সে জন্যই শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের আড়াই মাস পর ৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসলে রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। কারণ বেগম জিয়া বা বিএনপি কোনোটাই তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার অন্তরায় ছিল না।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, দুঃশাসন, জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। সেসব দুর্নীতিবাজের সঙ্গে মিলিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে একই পাল্লায় অভিযুক্ত করাটা ছিল সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রেই অংশ।
দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল জানত, শেখ হাসিনাকে বাইরে রেখে কিংবা রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে না পারলে তাদের মনোবাসনা কখনও পূর্ণ হবে না। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে প্রথমেই গ্রেপ্তার করা হয়। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা অপরিপক্ব রাজনীতিবিদ। তাকে ১৭টি মামলা মোকাবিলা করতে হবে।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শুধু বীরের মতো জেল থেকে বেরিয়েই আসেননি, টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আর সেদিনের অর্বাচীন মইনুল গংরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে এতিম হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। প্রথমত, ২৬ মার্চ ১৯৭১, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি শেখ হাসিনাও দেশবাসীর উদ্দেশে করণীয় নির্ধারণে দিকনির্দেশনামূলক একটি খোলা চিঠি লেখেন, যা পরের দিন দেশের প্রতিটি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়।
সেখানে তিনি বলেন, ‘আমার প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছে আবেদন কখনও মনোবল হারাবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই। আমি আছি আপনাদের সঙ্গে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবই।’
দ্বিতীয়ত, দলের প্রবীণ ও পরীক্ষিত নেতা জিল্লুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ। তিনি তখন শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পেয়েই জিল্লুর রহমান গর্জে ওঠেন। তিনি ঘোষণা করেন, নেত্রী মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো সংস্কার বা কাউন্সিল হবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যার দেয়া দায়িত্বকে অসীম সাহসের সঙ্গে পালন করে দলকে শুধু ঐক্যবদ্ধই রাখেননি, গঠনতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে মুক্ত করতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা গ্রেপ্তারের আগে কিংবা পরে দলের কিছু নেতা গ্রেপ্তারের ভয়ে কিংবা মতিভ্রম হয়ে দলের সংস্কারের কথা বললেও তারা কখনোই শেখ হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগ চাওয়ার সাহস করেননি, কারণ তারা জানত শেখ হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগ গঠন করা সম্ভব নয়। সারা দেশের নেতা-কর্মীদের কাছে শেখ হাসিনার আছে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ নেই। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই, সে সময় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি সভা হয়েছিল।
সারা দেশের জেলা প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন। সভায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সভাপতির চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়। তৃণমূল প্রতিনিধিদের ইস্পাত কঠিন ঐক্য সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংস্কারপন্থিদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। সে জন্য বিএনপিকে ভাঙতে পারলেও তারা আওয়ামী লীগকে ভাঙতে সক্ষম হয়নি। শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে যেকোনো নির্বাচন এ দেশে সম্ভব নয়, সেটিও বুঝে যায় ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদ সরকার।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মহান রাজনীতিবিদরা জেলে বসে অলস সময় কখনও নষ্ট করেননি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসনামলে জেলে বসে আত্মজীবনী লিখেছেন, যা এখন একটি ঐতিহাসিক দলিল। ব্রিটিশ শাসনামলে জেলে বসে জওহরলাল নেহেরু লিখেছেন ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ ও নেলসন ম্যান্ডেলা লিখেছেন ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম' এবং ‘দি অটোবায়োগ্রাফি’। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জেলে বসে কীভাবে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ করা যায়, সে পরিকল্পনা করেছেন। এ বিষয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘কারাগারে গিয়ে আমি বসে থাকিনি। একদিন না একদিন তো মুক্তি পাব, দেশের জন্য কাজ করব। কী কাজ করব, কোন সালে কী করব, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা, স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা, মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত জীবনমান নিশ্চিত করা, শিক্ষার মান বাড়ানো, দেশকে কীভাবে অর্থনৈতিক মুক্তি ও উন্নত-সমৃদ্ধ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সেসব পরিকল্পনা করে লিখে রাখতাম।’ আজ বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, তার প্রতিটি পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুকন্যা জেলে বসেই করেছিলেন।
দেশরত্ন শেখ হাসিনা জেলে বসেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি অগণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে কোনো আপস করেননি। সে সময় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শেখ হাসিনাই প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। শেখ হাসিনার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রত্যেক মানুষ।
কারাগারে থাকাকালে শেখ হাসিনার অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে মুক্তির জোরালো দাবি ওঠে। প্রতিবাদে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। মাত্র এক সপ্তাহে জরুরি অবস্থার মধ্যেও দেশরত্ন শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে শুধু ঢাকা শহরেই ২৫ লাখ মানুষ গণস্বাক্ষর দিয়েছিল। যতই দিন যায়, ততই শেখ হাসিনার মুক্তির দাবি জোরালো হতে থাকে এবং দ্রুত নির্বাচন দিতে প্রবল চাপ আসতে থাকে। ক্ষমতা দখলকারী ফখরুদ্দীন-মইন সরকার বুঝতে পারে শেখ হাসিনাকে কারাগারে রেখে কোনো নির্বাচন সম্ভব নয়। সে লক্ষ্যে ২০০৮ সালের ১১ জুন শেখ হাসিনাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে যান। ৫ নভেম্বর চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন। ঘোষিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বাংলার গণমানুষের ভালোবাসায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেই থেকে টানা তিন মেয়াদে একযুগের বেশি সময় ধরে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
ই-মেইল: haldertapas80@gmail.com