২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ওই সময়ের ক্ষমতাসীন ১/১১ এর সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে। বিষয়টি সকল রাজনৈতিক সচেতন মহলের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। যদিও কয়েকদিন আগে থেকেই সরকার তার বিদেশ থেকে ফিরে আসার ওপর নানা ধরনের হয়রানিসহ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সেই সরকারের এই ধরনের আচরণ সকলের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। কেননা তিনি ১/১১-এর সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আগে ক্ষমতায় ছিলেন না, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য দেশে কোনো আন্দোলন সংগঠিত হয়নি, তার বিরুদ্ধে জনমতও ছিলো না। বরং ১/১১-এর সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল।
বিএনপির জোট সরকার মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করেনি। সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটায়। এরর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন ও সংগ্রাম সংগঠিত হয়। এ সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব প্রদান করে একটি ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। যেনতেন উপায়ে দেশে নির্বাচন দেখিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার জোট সরকার পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার যে নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তার বিরুদ্ধে শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও পাতানো নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়।
জনমত সেই পাতানো ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার ও উপদেষ্টা পরিষদের বিরুদ্ধেই শুধু নয়, চার দলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধেও তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সহিংসতা বেড়ে যায়। চারজন উপদেষ্টা তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে পদত্যাগ করেন। ইয়াজউদ্দিন ইচ্ছেমতো উপদেষ্টা নিয়োগ এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে পাতানো নির্বাচন ও ফলাফল তৈরির ব্যবস্থা করায় এই সংঘাত চরম নৈরাজ্যের দিকে দেশকে ঠেলে দেয়ার উপক্রম হয়। ইয়াজউদ্দিনের সরকার তাতেও কর্ণপাত না করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিনিধির নাম একের পর এক ঘোষণা করতে থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপ্রতি ইয়াজউদ্দিন সরকার ভেঙে দিয়ে নির্বাচন বন্ধ করতে বাধ্য করেন।
১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরকে প্রধান উপদেষ্টার শপথ পাঠ করান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। গঠিত হয় নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সকল মহল এই পরিস্থিতিতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, দেশ ভয়ংকর নৈরাজ্যের হাত থেকে রক্ষা পায় বলে সকল মহল ধারণা করেছিল। গোটা এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট এবং জোটের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া ও জামায়াতের কর্মকাণ্ডে দেশের মানুষ তাদের ওপর বিক্ষুব্ধ ছিল।
২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত জোট সংবিধানে বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোসহ নানা ধরনের পূর্বপরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল- বিষয়টি বুঝতে পেরে দেড়-দুই বছর আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদ ও আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত না হওয়ার পর দেশব্যাপী জনবিস্ফোরণ সৃষ্টি হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট গঠিত হয়, এর সঙ্গে বিএনপি থেকে বের হয়ে বেশ কিছু নেতা মহাজোটের শরিক হয়। তাদের সকলের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ডের যে প্রতিবাদ হচ্ছিল সেটি রুখে দেয়ার জন্য জোট সরকারের মতো প্রশাসন, পুলিশ এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাকর্মীরা রাস্তায় জন-আন্দোলনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিটি মোটেও কোনো তিন মাসের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালনের চরিত্র বহন করে না। স্পষ্টতই এটি ছিল পূর্ববর্তী জোট সরকারের ছায়া হিসেবে সেই সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা পূরণ এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার শক্তি প্রয়োগের দৃশ্য।
এটিও ছিল সকল মানুষের কাছে এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতা দখল ও পাকাপোক্তকরণের নীল নকশা বাস্তবায়নের মঞ্চ। অথচ ১৯৯৫-৯৬ সালে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দেশে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে একটি আন্দোলন দেশে সংগঠিত হয়েছিল। সেই আন্দোলন ওই সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার দমন করতে শক্তি প্রয়োগ করে, কোনো আলোচনায় রাজি হয়নি।
১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি তারা এক তরফা একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে যা নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দেয়, একইসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির যৌক্তিকতা সমর্থন করে নতুন সংসদ ও সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। সেই অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল সংসদে উত্থাপন ও পাস করার মাধ্যমে সংসদ ভেঙে দেয়া হয় ও সরকার সংবিধান অনুযায়ী গঠিত নতুন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পদত্যাগ করে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচন বানচালে ষড়যন্ত্র হলেও উপদেষ্টা পরিষদের দৃঢ় অবস্থানের কারণে নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে বলে সকল মহল মনে করে। নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয়।
৫ বছর পর শেখ হাসিনা মেয়াদ শেষে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন এবং সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি লতিফুর রহমানকে প্রধান উপদেষ্টা করে দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত সংসদের মেয়াদ ছিল। জোট সরকারের মেয়াদ শেষে জোটনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের সঙ্গে যে গোপন ষড়যন্ত্র করেন তার ফলে সংবিধানে বিএনপি কর্তৃক আনীত সংযোজনী তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে এর মর্যাদা ও ক্ষমতা হারায়।
দেশ গভীর সংকটে পড়ে। সেই সংকটময় মুহূর্তে দেশে যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন চলছিল তার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পরামর্শে নির্বাচনের নামে প্রহসন এবং চারদলীয় জোটের একক সংসদ তৈরির পথেই হাঁটতে থাকেন।
সেই মুহূর্তে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দেয়া, প্রধান উপদেষ্টা পদ থেকে সরে আসা এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের অনুরোধ জানায়। অবস্থা বেগতিক দেখে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ১১ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ, উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেয়া এবং নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
দেশে মুহূর্তের মধ্যেই পরিবর্তনের এক সুবাতাস সৃষ্টি হয়। চারদলীয় জোট হতভম্ব হয়ে পড়ে। ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। মহাজোট এটিকে স্বাগত জানায়। নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে দেশবাসীকে জানায়।
গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন এ ব্যাপারে সরকারের অতিরিক্ত সময়ের পক্ষে সাংবিধানিক অধিকার সরকারের রয়েছে বলে অভিমত দেন। সাধারণভাবে তখন জনগণ এটিকে সমর্থন প্রদান করে। কেননা ভোটার তালিকায় এক কোটির বেশি ভুয়া ভোটারের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ও প্রমাণ গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। সে কারণে রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণ ভোটারতালিকা ভুয়া ভোটারমুক্ত করতে ফখরুদ্দীন সরকারকে সময় দিতে প্রস্তুত ছিল। তবে নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন যে সময়সাপেক্ষ সেটি সকল মহলই বিশ্বাস করছিল। সেকারণে নব্বই দিনের অতিরিক্ত কিছু সময় হয়তো নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের প্রয়োজন হওয়ার বিষয়টি সকলেই ধরে নেয়।
এই অবস্থায় নির্বাচন কিছুটা পেছাতে পারে সেই বিবেচনা থেকেই রাজনীতি নির্বাচনি প্রচারণায় রূপ নেয়নি। সেই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মহাজোটপ্রধান শেখ হাসিনা নিজের চোখের চিকিৎসা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী তার পুত্রবধূর অসুস্থতার খবরে সেখানে ১৫ মার্চ গমন করেন। এরই মধ্যে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি তথা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের চিন্তাভাবনা বিস্তৃত হতে থাকে। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে থাকেন।
৯ এপ্রিল তারিখে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং জামায়াত-শিবিরের দায়ের করা হত্যামামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। বোঝাই যাচ্ছিল উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করতেই এমনটি নেপথ্যে থেকে করছিলেন। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছিল প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদ ক্রমেই ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ছিলেন।
পর্দার অন্তরালে সেনাবাহিনীর একটি অংশ এবং সুশীল সমাজের একটি গোষ্ঠী কলকাঠি নাড়ছিলেন বলে টের পাওয়া যাচ্ছিল। সেকারণেই ফখরুদ্দীন সরকারকে কেউ কেউ সামরিকসমর্থিত সরকার বলার চেষ্টা করেন, তবে সেনাবাহিনীগতভাবে নয় সেনাবাহিনীর কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পেছনে কিছুটা ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করে থাকতে পারে। সেসময়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ মন্তব্য করতে থাকেন। নির্বাচনি প্রস্তুতি গ্রহণের কর্মযজ্ঞ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সরে গিয়ে ক্রমে দুর্নীতিবিরোধী, রাজনীতিবিরোধী, রাজনীতিতে সংস্কার আনয়ন ইত্যাদির কথা একের পর এক উচ্চারণ করতে থাকেন। কিন্তু সবার আগে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে না আসতে উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন প্রত্যক্ষভাবে বাধা দিচ্ছিলেন বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হতে থাকে।
তার বিমান টিকেট বাতিল করা হয়, ঢাকা বিমানবন্দরে তার অবতরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সেই অবস্থাতে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার সকল ঝুঁকি মাথায় পেতে নেন। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক মহলেও তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। অবশেষে তিনি ৭ মে ঢাকায় ফিরে এলে লাখ লাখ মানুষ তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হয়। সরকার জনস্রোতের মুখে দাঁড়াতে পারেনি। শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে এসে দেশে ভোট ও ভাতের অধিকার বাস্তবায়নের দাবিতে যেকোনো সংগ্রামে ত্যাগ স্বীকার করার কথা ঘোষণা করেন।
১৬ জুলাই সকাল বেলায় তাকে সুধা সদন থেকে প্রথমে মেট্রোপলিটন আদালত, পরে সংসদ ভবনের সন্নিকটে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। সকল মহলের কাছে বিস্ময়ের উদ্রেক হয়েছিল একারণে যে দোষ করলেন কে, কারাগারে নেয়া হলো কাকে? বিষয়টি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ভেতরেও মতবিরোধ ছিল।
ফলে ৩ সেপ্টেম্বর বেগম খালেদা জিয়াকেও সংসদ ভবনের পাশে আরেকটি কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। তখন দেশে স্পষ্ট হতে থাকে যে, উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর ও বাইরে নানা গোষ্ঠী ও অপশক্তি দেশের রাজনীতিকে ভেঙে তছনছ করে দেয়া, কিংস পার্টি গঠন করা, ক্ষমতায় কোনো না কোনো মহলকে অধিষ্ঠিত করা ইত্যাদি লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এই অবস্থায় ২০০৮ সালের শুরুর দিকে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। তারপরও নানা অনিশ্চয়তা দেখা দিতে থাকে। শেখ হাসিনা এই সময়ে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে অস্থায়ী জামিনে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
১১ জুন তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। দেশে তখন একদিকে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় সংসদ ভবনের পাশে বসা আদালত চলছিল, অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধেও ছাত্রজনতার বিক্ষোভ হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়।
এই অবস্থায় নতুন ভোটারতালিকা প্রস্তুতকরণে নবগঠিত নির্বাচন কমিশন সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটদানে পরিচয়পত্র ব্যবহারের গুরত্ব প্রমাণিত হয়। দেশে দ্রব্যমূল্য এবং অর্থনৈতিক সংকট ২০০৮ সালে গভীরতর হওয়ায় সরকার দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে শুরু করে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা শেষে অবশেষে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৩০টি, বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন এবং জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দল বাকি আসন লাভ করে।
এই নির্বাচনে বস্তুত জোট সরকারের দুঃশাসন, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, ২১ আগস্টসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, জঙ্গিবাদের উত্থান ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ এবং ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে সংকট, ১/১১ এর পরবর্তী দেশের পরিস্থিতির জন্য বিএনপি ও চারদলীয় জোটের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সেটি নবম জাতীয় সংসদে জনগণের ভোটে প্রতিফলিত হয়। শেখ হাসিনা এই লড়াইয়ে জনগণের ভোটাধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, দেশকে এগিয়ে নেয়ার যে দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছিলেন তা ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাকে দেশ পরিচালনায় নিরঙ্কুশ সমর্থন জুগিয়েছিল।
১/১১-এর সরকারের যেসব কুশীলব তাকে ১৬ জুলাই বিনা কারণে আটক করে কারাবন্দি এবং রাজনীতি থেকে মাইনাস কিংবা বিদেশে রেখে দিয়ে দেশকে নিজেদের নামে পরিচালনার অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে ঠেলে দিয়েছিল সেটিও ভণ্ডুল হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ফিরে আসে রাজনীতিতে, সুযোগ পায় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে। যা ছিল বাংলাদেশের জন্য অতীব প্রত্যাশিত।
লেখক: গবেষক-অধ্যাপক।