বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১৪ বছর আগে, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই। তিনি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী (১৯৯৬-২০০১)। এ ছাড়াও তিন দফায়- ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০১, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তদুপরি তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। নেতা-কর্মী-সমর্থক, সবার অগাধ আস্থা তার প্রতি।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে ড. কামাল হোসেন তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। দলের নেতৃত্বপদ ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। তিনি সেটা করেও ছিলেন। কিন্তু কর্মী-সমর্থকরা সেটা মানেননি। তার প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের প্রকাশ ঘটে নানাভাবে। বছর তিনেকের মধ্যে ড. কামাল হোসেনই দল ছেড়ে দেন। এখন তার দল গণফোরাম কার্যত অস্তিত্বহীন, বিএনপিসহ কয়েকটি দল নিয়ে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে যে জোট গঠন করেছিলেন সেটিরও সাফল্য নেই।
কেন শেখ হাসিনাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রেপ্তার করেছিল? তিনি সফল আন্দোলনের নেৃতত্ব দিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। ২১ বছর দলটি রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে ছিল। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনরা দম্ভভরে বলত- আওয়ামী লীগ ৫০ বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে প্রবল গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করেন।
এরপর নির্বাচনে তার দল জয়ী হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে তিনি ফের ক্ষমতা হারান। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত নির্বাচনে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বিএনপি নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। দলের এক সময়ের নেতা বিচারপতি এম এ হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে আসীন করার জন্য এমনকি সংবিধান পর্যন্ত সংশোধন করে। কিন্তু শেখ হাসিনা মহাজোট গঠন করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন। রাজপথের সংগ্রামে তিনি অনন্য, ফের তার প্রমাণ মেলে। খালেদা জিয়া সেনাবাহিনী মোতায়েন করেও বিপর্যয় ঠেকাতে পারেননি।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে জরুরি আইন বলবৎ এবং পরদিন ড. ফকরুদ্দীন আহমদ নির্দলীয় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণের এটা ছিল প্রেক্ষাপট। তিনি জরুরি আইন জারি করেন এবং কারণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ গোলযোগে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিপন্ন হওয়ার কথা বলা হয়।
নিষিদ্ধ হয় সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ‘দলনিরপেক্ষ সরকার’ অচিরেই বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে। একইসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পেছনে থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকা সেনাবাহিনী প্রধান মইন উ আহমদের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস ১৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দেন- ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল তিনি গঠন করবেন। [বার্তা সংস্থা রয়টার্স, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭]
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদকে ‘রাজনীতিবিদ’ বানানোর সুপরিকল্পিত উদ্যোগ ছিল, সেটা স্পষ্ট।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। জরুরি আইন জারির পর পরই তিনি লাগাতার অবরোধ-হরতালসহ সব ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন। একইসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জনগণের প্রত্যাশার কথা। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর শাসনামলে তাদের পছন্দের বিচারপতি আবদুল আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ১ কোটির বেশি ভুয়া ভোটার রেখে যে ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছিল সেটা বাতিল করে নতুন করে ছবিযুক্ত তালিকা প্রকাশের দাবিও তিনি তুলে ধরেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই প্রত্যুষে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তার বাসভবন সুধা সদন থেকে পুলিশ ৪০টি সিডি, শতাধিক ফাইল, তিনটি মোবাইল ফোন সেট ও বিভিন্ন কাগজ জব্দ করে এবং একটি সিন্দুক সিলগালা করে দেয়া হয়। তাকে আদালতে তোলার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হেনস্থা করেছে- এ দৃশ্য দেশবাসী দেখেছে টেলিভিশন পর্দায়। [সমকাল ও প্রথম আলো। ১৭ জুলাই, ২০০৭]
এই গ্রেপ্তারের মাস তিনেক আগে তাকে লন্ডনে নির্বাচিত রাখার একটি অপচেষ্টাও হয়েছিল। কানের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেবেছিল বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে নির্বাসনের দারুণ সুযোগ মিলেছে। ২৩ এপ্রিল তিনি লন্ডন থেকে বাংলাদেশ ফেরার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাকে বাংলাদেশগামী বিমানে উঠতে দেয়া হয়নি ঢাকা থেকে যাওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে। কিন্তু তিনি ছিলেন অদম্য। লন্ডনে থেকে তিনি বিশ্বব্যাপী প্রচার চালান- মূল বিষয়- রাজনৈতিক হয়রানি, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণ। সরকার বাধ্য হয় তাকে দেশে ফেরার পথের বাধা প্রত্যাহারে।
তার এই ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’কে আওয়ামী লীগ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগায়। ৭ মে ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে বের হয়ে এসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনের উদ্দেশে রওনা হবার সময় হাতেগোনা কয়েকজন নেতা তাকে স্বাগত জানান। জরুরি আইনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বিশাল জমায়েত করে দলের সভাপতিকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর সুযোগ ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, ড. ফকরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে বাংলাদেশে ফিরতে না দিতেই বিশেষভাবে তৎপর ছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের ভেতরের সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে নিয়ে গাড়িটি প্রধান সড়কে পড়তে না পড়তেই দেখা গেল অভূতপূর্ব দৃশ্য- দলে দলে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা প্রশস্ত রাজপথ ভরে ফেলল। এ যেন ম্যাজিক! কেবল একটি স্থানে নয়, বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডি পর্যন্ত ১৫-১৬ কিলোমিটার পথজুড়ে কেবল মানুষ আর মানুষ। কণ্ঠে তাদের স্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার আগমন স্বাগতম, স্বাগতম! সাধারণত আওয়ামী লীগ কিংবা এ ধরনের দলের বড় সমাবেশে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতা-কর্মীরা আসেন বাস-ট্রাকে। কিন্তু সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমনটি ঘটতে পারেনি। কী করে সম্ভব হলো এ ধরনের জমায়েত? তিনি আন্দোলনের পাশাপাশি দলকে সংগঠিত করেছিলেন বলেই এমনটি ঘটতে পেরেছিল।
শেখ হাসিনা জানতেন, তাকে বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার করা হতে পারে। কিংবা সুধা সদনে গৃহবন্দি করে রাখা হতে পারে। কিন্তু দৃঢ় সংকল্প তার- নাথিং উইল গো আনচ্যালেঞ্জড। তিনি দলকে জানিয়ে দেন- রাজপথে থাকতে হবে।
১৬ জুলাই তিনি গ্রেপ্তার হন। ওই দিনই আদালতে নেওয়া হলে দলের নেতা-কর্মীরা ফের স্লোগানমুখর হয়- শেখ হাসিনার মুক্তি চাই। তিনি যতদিন কারাগারে ছিলেন, একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভিক। কর্মীরাও ছিলেন রাজপথের সাহসী সৈনিক। ১১ মাসের বন্দিজীবন শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন।
তাকে গ্রেপ্তারের এক মাস যেতে না যেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নামে। শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় থেকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যহারের দাবিতে। ২০ আগস্ট ছাত্রছাত্রীরা রাতভর বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পুলিশের চেকপোস্টে আগুন দেয়া হয়। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয় শতাধিক শিক্ষার্থী। কলাভবন, কেন্দ্রীয় শহীদমিনার, টিএসসি এলাকা ছিল ছাত্রছাত্রীদের দখলে। পরের দুই দিন আন্দোলনে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা অংশ নেয়। কারফিউ জারি এবং সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে সেন্সরশিপ আরোপ করেও আন্দোলন থামানো যায়নি। অধ্যাপক ড. হারুন-অর রশিদ, আনোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ জুলাই প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বরাত দিয়ে লিখেছিল- ‘আন্দোলন থামাতে কারফিউ জারির বিকল্প ছিল না।’
এই আন্দোলনের কয়েকদিন পর ৩ সেপ্টেম্বর (২০০৭) বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তারেক রহমান গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ৭ মার্চ। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবার, যারা দেশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল- তাদের গ্রেপ্তারে জনমনে স্বস্তি ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের গ্রেপ্তার ও তড়িঘড়ি বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের অপচেষ্টার কারণ তাদের বোধগম্য ছিল না। শেখ হাসিনার বিচার কাজ শুরু হয় বিশেষ আদালতে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য কম অপচেষ্টা হয়নি। এ কাজে বার বার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে। তার সাফল্য যেমন রাজপথে, তেমনি দেশ গঠনে। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে দলটি ক্ষমতায় মাত্র দুই দশকের মতো। আর পাকিস্তান আমলে বছর দুই। কিন্তু এই স্বল্প সময়েই দলটি প্রমাণ করেছে- উন্নয়ন করতে পারে দলটি। আরেকটি দিক হচ্ছে বিপর্যয়ে ভেঙে না পড়ে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। বিএনপি এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু এ দুটি ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ। খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হয়েছেন তিন বছরের বেশি।
তার বিচারের রায় হয়েছিল ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর প্রায় সাড়ে তিন বছর চলে গেছে। তারেক রহমান ‘নির্বাসিত’ এক যুগের বেশি। কিন্তু দলটি নিজেকে আর অপরিহার্য প্রমাণ করতে পারছে না। তারা প্রতিদিন গণমাধ্যমে হাজির থাকছে। শেখ হাসিনা তথ্য-প্রযুক্তির যে অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়েছেন, তার সুযোগ নিতে কার্পণ্য করছে না বিএনপি। প্রতিদিন একাধিক সংগঠনের ব্যানারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভেতরে-বাইরে দলটির একাধিক নেতা হাজির থাকছেন। আওয়ামী লীগবিরোধী আরও কয়েকজন ‘এক নেতা-এক দল’ নেতাও মুখর। কিন্তু জনসাধারণ সাড়া দিচ্ছে না। কেন, এর উত্তর খুঁজতে চাইছে না তারা। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করার মতো অনেক বিষয় রয়েছে। সুশাসনের ইস্যু আছে, দুর্নীতি-অনিয়ম আছে। কিন্তু বিএনপি ও তার মিত্ররা না পারছে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে, না পারছে আওয়ামী লীগের ভুল-ত্রুটি সংশোধনে উপযুক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনা এবং তার দল কঠিন সময়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে, বিএনপি কেন তা পারছে না- রাজনীতির বিশ্লেষকরা সেটা নিয়ে কাঁটাছেড়া করতেই পারেন। বিএনপি নিজেই এ কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে কি না, সেটাও কিন্তু প্রশ্ন।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত