করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর ১৫ মাস পেরিয়ে গেছে। লাখ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। এ নিয়ে সচেতন মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোনো শেষ নেই। সর্বশেষ গত ১২ জুলাই ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর ও ইউনেসকোর মহাপরিচালক অড্রে অ্যাজুল এক যৌথ বিবৃতিতে ‘আর অপেক্ষা না করে স্কুলগুলো দ্রুত খুলে দেয়ার’ আহ্বান জানান। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘স্কুলে যেতে না পারার কারণে শিশু এবং তরুণ জনগোষ্ঠী যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তা হয়তো কখনোই পুষিয়ে নেয়া যাবে না। শেখার ক্ষতি, মানসিক সংকট, সহিংসতা ও নির্যাতনের সম্মুখীন হওয়া থেকে শুরু করে স্কুল-ভিত্তিক খাবার ও টিকা না পাওয়া বা সামাজিক দক্ষতার বিকাশ কমে যাওয়া—শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি তাদের শিক্ষাগত অর্জন এবং সামাজিক সম্পৃক্ততায় এর প্রভাব দেখা যাবে। মা-বাবা এবং শিশু যত্নকারীদেরও ক্ষতির ভার বইতে হচ্ছে।’
হেনরিয়েটা ফোর ও অড্রে অ্যাজুল বিবৃতিতে আরও বলেন, ‘স্কুলগুলো পুনরায় চালুর ক্ষেত্রে সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর টিকা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করা যায় না। বৈশ্বিক পর্যায়ে টিকা ঘাটতি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। এ অবস্থায় টিকাদানের ক্ষেত্রে সম্মুখসারির কর্মী ও মারাত্মক অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার প্রদান অব্যাহত থাকবে।’ এ পরিস্থিতিতে তারা সরকারগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন যেন, প্রজন্মগত বিপর্যয় এড়াতে নিরাপদে স্কুলগুলো খুলে দেয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ও ইউনেসকোর মহাপরিচালকের যৌথ বিবৃতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা বাংলাদেশের স্কুল খোলার ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা পালন করবে, সেটা বলা কঠিন। কারণ বাংলাদেশে স্কুল খোলার পক্ষে যেমন জোরালো মত রয়েছে, আবার বিপক্ষেও রয়েছে শক্ত যুক্তি। অনেক অভিভাবকই স্কুলে পাঠিয়ে নিজের সন্তানদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চান না।
তাদের কারও কারও কাছে লেখাপড়ার চেয়ে সন্তানের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আসলে স্কুল খোলা উচিত কি না, সেটা নিয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মাসের পর মাস অতিবাহিত হচ্ছে। গত প্রায় দেড় বছরে শপিং মল, পর্যটনকেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছুই কখনও না কখনও চালু করা হয়েছে। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই বন্ধ রয়েছে। দেশে কবে করোনার প্রকোপ কমবে, এগুলো কবে চালু হবে, তা এখনও অনিশ্চিত রয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার ব্যাপারে জাতীয়ভাবে কোনো সংলাপ, আলাপ-আলোচনা বা উদ্যোগও চোখে পড়ছে না।
আমাদের দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বিঘ্নিত হচ্ছে। এটা একটা বিরাট সংকট ও অপরিমেয় ক্ষতি। সম্প্রতি একটি বেসরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস-জনিত বন্ধে প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে না পারা বা শিক্ষণঘাটতির ঝুঁকিতে আছে। শিক্ষার এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এমনকি যেসব এলাকায় সংক্রমণ নেই বা কম, সেসব এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ব্যাপারটিকেও গত ১৫ মাসে তেমন গুরুত্ব পায়নি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যে অত্যন্ত জরুরি, এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি যেমন থাকে, আবার দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে পুরো জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ কথা ঠিক যে, গত দেড় বছরে যেসব শিক্ষার্থী স্কুলে যায়নি, তাদের সবাই কিন্তু ঘরেও থাকেনি। একটা বড় অংশই এই সময়ে মাঠেঘাটে, রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে, আড্ডা দিয়েছে, বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে, অনেকে বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণও করেছে। গণপরিবহনে উঠেছে। অনেকে কোচিং সেন্টারেও গিয়েছে। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই তারা যায়নি। প্রশ্ন হলো, শুধু কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই করোনা আক্রমণ করে? বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার সময় এসেছে।
করোনা মোকাবিলার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ভ্যাকসিন বা টিকা। এখন পর্যন্ত যে গতিতে টিকাকরণ হচ্ছে, যেভাবে টিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে, তাতে দেশের ৭০-৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে অন্তত পাঁচ থেকে আট বছর সময় লাগবে। প্রশ্ন হলো, করোনার প্রকোপ যদি না কমে, ততদিন পর্যন্ত কি তাহলে স্কুলগুলো বন্ধ রাখা হবে?
আর করোনার প্রকোপ যে সহসাই কমবে, এমন কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। এটা প্রতিনিয়ত রূপ পরিবর্তন করে যেভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে আক্রমণ করছে, তাতে মনে হয় না, সহসাই আমরা করোনার হাত থেকে রেহাই পাব।
গত ১৫ মাসে বিকল্প পদ্ধতিতে পড়ালেখা চালিয়ে নেয়ার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বটে, কিন্তু এসব উদ্যোগে সবাইকে সমানভাবে শামিল করা যায়নি। আসলে স্মরণকালের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকেনি। তাই বিকল্প ব্যবস্থাগুলোও তেমন কার্যকর হয়নি। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কমাতে সরকার অনলাইন ও টেলিভিশনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এরই মধ্যে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীদের পরের শ্রেণিতেও তুলে দেয়া হয়েছে। তবে এই বিকল্পপাঠে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে শুরু থেকেই।
সবচেয়ে বড় কথা আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত বেশির ভাগ দরিদ্র শিক্ষার্থীর অনলাইনে লেখাপড়া শেখার সুযোগ নেই। টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার উদ্যোগটাও সুপরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করা হচ্ছে না। আর যারা অনলাইনে ক্লাস করছে, তাদের মধ্যে অনেকেই ঠিকমতো পড়া বুঝতে পারেনি। কারণ অনলাইন ক্লাসের রয়েছে নানা সমস্যা। কখনও হ্যাং হয়ে যায়, কখনও কথা বোঝা যায় না। কখনও ঠিক সময়ে ক্লাসে প্রবেশ করা যায় না। তা ছাড়া অনলাইন ক্লাস একপক্ষীয়। শিক্ষকরা এসে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দেন। কে বুঝল, কে বুঝল না-সেটা দেখা হয় না। এ তো গেল অনলাইনে ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের কথা, আর যারা অনলাইন ক্লাসের বাইরে আছে, তাদের অনেকের সঙ্গে তো বই-খাতার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। স্কুল, পড়া, এগুলো তাদের কাছে কেবল স্মৃতি। এই শিক্ষার্থীদের শিশুর শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
তাছাড়া শহুরে শিশুদের ঘরবন্দি জীবন আর অনলাইন ক্লাসের কারণে যন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। স্কুল বন্ধ থাকায় শহুরে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবন থেকেও। শিক্ষায় ঘাটতির পাশাপাশি ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে এই অনলাইন শিক্ষার কারণে। অর্থবিত্তে, সুযোগ-সুবিধায় এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা চলমান পরিস্থিতিতে ঠিকই লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারছে। কিন্তু যারা সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া, যাদের বাসায় শিখিয়ে দেবার, গাইড করার কেউ নেই, তারা পিছিয়ে পড়ছে। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের অনেকেই করোনাকালে বাবা-মা কিংবা ভাইয়ের সঙ্গে উপার্জনমূলক কাজে যোগ দিয়েছে। বলা যায় বইখাতা বা স্কুলের সঙ্গে এক ধরনের বিচ্ছেদ তৈরি হয়েছে। স্কুল খুলে দিলেও তারা কি আবার সেখানে ফিরে আসতে পারবে? মানিয়ে নিতে পারবে? হয়তো স্কুলে যেতেও চাইবে না, ঝরে পড়তে পারে। কারণ তাদের লেখাপড়া বা স্কুলে যাওয়ার অভ্যাসটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
এমনিতেই আমাদের গ্রামের শিশুরা প্রকৃত জানাবোঝার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। থ্রি-ফোরের বাচ্চারা ঠিকমতো অক্ষরও চেনে না। অটোপাসের কারণে যখন সে ক্লাস ফোর বা ফাইভের বই পড়ছে, তখন তো তার কাছে এটা একটা বিরক্তিকর গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে। নতুন ক্লাসে যেহেতু সবই নতুন, তাই তাদের পক্ষে পাঠ্যসূচি আয়ত্ত করা অত্যন্ত কঠিন এক সংগ্রাম হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে পরিকল্পনা, সৃজনশীল উদ্যোগ, সহায়তা দরকার, সেটা আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। এতে বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। ধনী ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় এগিয়ে যাচ্ছে, দরিদ্ররা পিছিয়ে পড়ছে। বৈষম্যের শিকার হয়ে ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, পড়াশোনা বন্ধ থাকায় কোনো অভিভাবক তাদের নাবালিকা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। তাদের পুরো জীবন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে, তাহলে আগামী দিনে কিশোর অপরাধ, মাদক, সন্ত্রাস ইত্যাদি অপরাধ অনেক গুণ বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। শিশুরা মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
স্কুল খুলে দেয়া যদি নিতান্তই সম্ভব না হয়, তাহলে সকল শিশুকে কীভাবে বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা যায়, সে ব্যাপারে সরকারকে আশু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অনলাইন শিক্ষায় যেন সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সে জন্য যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ডেটাবেজ তৈরি করে যাদের ল্যাপটপ-ইন্টারনেট নেই, তাদের বিনা মূল্যে সেগুলো দিতে হবে। ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রমকে গতিশীল ও বাস্তবসম্মত করতে হবে। তা না হলে আগামী দিনে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রবন্ধকার।