বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আশ্রয়ণ: স্বপ্নের প্রকল্প হয়ে উঠুক

  •    
  • ১৪ জুলাই, ২০২১ ১৫:৩৪

বিশ্বের যেকোনো প্রকল্পেই বিচ্যুতির এইটুকু মাত্রা গ্রহণযোগ্য। মানলাম, সোয়া লাখ ঘর বানাতে শ তিনেক ঘরে সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু যে প্রকল্পটি নিখুঁতভাবে করা সম্ভব ছিল, সেটি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এমন লেজেগোবরে করা হলো কেন। আর যা জানা যাচ্ছে, তাতে সমস্যা শুধু ৩০০ ঘরে থাকবে না। দ্রুতই আরও অনেক ঘরে সমস্যা দেখা যাবে। এক লাখ ৭১ হাজার টাকায় টেকসই ঘর বানানো সম্ভব নয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আবেগ এবং স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্পে নানা অনিয়ম নিয়ে গত কদিন ধরেই গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড়। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে এটিএন নিউজের বিশেষ প্রতিনিধি মুন্নী সাহা গিয়েছিলেন মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায়। সেখানকার প্রকল্পটি মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। মুন্নী লাইভে বারবার বলছিলেন, মিনি কক্সবাজার। পরে সন্ধ্যায় মুন্নী প্রকল্পের কয়েকটি ছবি শেয়ার করেছিলেন ফেসবুকে। সেখানে একটি ছবির নিচে আমি মন্তব্য করেছিলাম, ‘আহা, এইখানে যদি আমার একটি ঘর থাকতো।’ মন্তব্যটি নিছক আবেগের বশে করা নয়। সব মানুষেরই শেষ জীবন কাটানোর স্বপ্ন থাকে। কেউ কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি কেনে, কেউ মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে, কেউবা আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। আমার ইচ্ছা শেষ জীবনটা গ্রামে কাটানোর। গ্রামে কোথায় কাটাতে চাই তার একটা লিখিত রূপ আছে।

২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকা টাইমসে ‘আহা, এইখানে এক নদী ছিল...’ শিরোনামে আমি লিখেছিলাম, ‘সবারই শেষ জীবন কাটানোর একটা স্বপ্ন থাকে। কারও স্বপ্ন পূরণ হয়, কারওটা হয় না। আমার স্বপ্নটা ছোট, কিন্তু জানি পূরণ হবে না। আহা, আমার যদি ছোট্ট একটা নদীর পাড়ে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর থাকত। সেখানে ফেসবুক দরকার নেই, ইন্টারনেট লাগবে না; খালি বই পড়া আর গান শোনার ব্যবস্থা থাকলেই হবে। সকালে নদীর পাড়ে হাঁটব, বুক ভরে নেব ফ্রেশ অক্সিজেন, দুপুরে নদীতে সাঁতার কাটব, বিকেলে নদীর পাড়ে আরাম কেদারায় বসে বই পড়ব আর গান শুনব। রাতে নদী থেকে আসা ভেজা হাওয়া গায়ে মেখে, বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে ঘুমিয়ে যাব।’

গজারিয়ার আশ্রয়ণ প্রকল্পটি আমার স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর। ছোট নদী নয়, রীতিমতো মেঘনার পাড়ে বাড়ি; তাও কুঁড়েঘর নয়, সেমিপাকা বাড়ি। তবে স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর এই প্রকল্পেই এখন অনিয়মের কালিমা। নানা ধরনের অনিয়মের খবর আসছে পত্রপত্রিকায়। প্রথম অনিয়ম হলো, দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন। এটা করতে গিয়ে মানের দিকে নজর দেয়া যায়নি। স্থান নির্বাচন নিয়েও বিবেচনার ছাপ দেখা যায়নি। যেনতেনভাবে হাতের কাছে পাওয়া জমিতে দ্রুতগতিতে ঘর বানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করানো হয়েছে।

মনে হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেই যেন প্রকল্প শেষ। ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ মুজিববর্ষে এই হলো মুজিবকন্যার অঙ্গীকার। কিন্তু এ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন পর্যায়ে পদে পদে অদক্ষতা, খামখেয়ালি হয়েছে। গৃহহীনদের তালিকা করার সময় থেকে অনিয়মের শুরু। গৃহহীনদের কারও কারও কাছ থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অর্থ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব ছিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। কিন্তু হাজার কাজের ফাঁকে তাদের পক্ষে এই প্রকল্পে যথাযথ নজরদারি সম্ভব ছিল না। তারা স্থানীয় লোকজনদের দিয়ে করিয়েছেন। তাতে অল্প হলেও দুর্নীতি হয়েছে। বালু-সিমেন্টের মিশ্রণ যথাযথ ছিল না, ইট-টিনের মানও যথাযথ করা হয়নি। আশ্রয়ণ প্রকল্পে অদক্ষতা, খামখেয়ালি, নজরদারির অভাব ছিল বটে, তবে খুব বেশি দুর্নীতির সুযোগ ছিল না। কারণ প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। এই টাকায় ঘর বানানোই অসম্ভব। আর এর মধ্যে যেখানে অল্পবিস্তর হলেও দুর্নীতি হয়েছে, সেখানে ঘর আর পাকা ঘর হয়নি, তাসের ঘর হয়েছে।

তিন মাস না যেতেই যা ভেঙে পড়ছে। প্রতিটি ঘরের জন্য এক লাখ ৭১ হাজার বাজেটটাই ছিল অবাস্তব। একটি ঘর বানাতে জমি তৈরি করতে হয়। কিন্তু এই বাবদ কোনো বরাদ্দ ছিল না। তাই কোনো আগপিছু বিবেচনা ছাড়াই হাতের কাছে পাওয়া খাসজমিতে ঘর বানানো হয়েছে। যেমন জামালপুরের সরিষাবাড়িতে বিলের মাঝখানে ঘর বানানো হয়েছে। বর্ষা আসতেই যা পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় ঘরের নিচে মাটি সরে গিয়ে ঘর ভেঙে গেছে। প্রকল্পের আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো, কোনো রকম পাইলটিং ছাড়াই এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ৫টি দল আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখছে, অনিয়ম তদন্ত করছে। এটা যদি এখন না হয়ে আগে হতো, তাহলে এই বিপর্যয় হয়তো হতো না।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে. সারা দেশে মাত্র শ তিনেক ঘরে সমস্যা হয়েছে, যা প্রকল্পের মাত্র দশমিক ২৫ ভাগ। বিশ্বের যেকোনো প্রকল্পেই বিচ্যুতির এইটুকু মাত্রা গ্রহণযোগ্য। মানলাম, সোয়া লাখ ঘর বানাতে শ তিনেক ঘরে সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু যে প্রকল্পটি নিখুঁতভাবে করা সম্ভব ছিল, সেটি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এমন লেজেগোবরে করা হলো কেন। আর যা জানা যাচ্ছে, তাতে সমস্যা শুধু ৩০০ ঘরে থাকবে না। দ্রুতই আরও অনেক ঘরে সমস্যা দেখা যাবে। এক লাখ ৭১ হাজার টাকায় টেকসই ঘর বানানো সম্ভব নয়। এখন সব দায় ইউএনওসহ মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। তদন্ত হচ্ছে আরও অনেকের বিরুদ্ধে। তবে ইউএনওদের বলির পাঁঠা বানিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। যারা কোনো রকম সম্ভাব্যতা যাচাই পাইলটিং, যথাযথ মনিটরিং ছাড়া নামমাত্র অর্থে ঘর বানাতে চেয়েছে; দায় নিতে হবে তাদেরও।

আশার কথা হলো, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড়ের পর টনক নড়েছে সবার। দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে। ভাঙা ঘর মেরামত হচ্ছে। কোথাও কোথাও সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। যেমন- জামালপুরের পুরো প্রকল্পটি অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে অল্প টাকায় করতে গিয়ে এখন দ্বিগুণ ব্যয় হচ্ছে। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নয়, প্রকল্পের সব ঘরই সরেজমিন তদন্ত করতে হবে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প একটি চলমান প্রকল্প। ৩০০ ঘর ভেঙেছে বলেই এখন সবার নজর পড়েছে এখানে। আশা করি এখন পুরো প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করা হবে। গৃহহীনদের তালিকা করা থেকে শুরু করে, জমি নির্বাচন সব ক্ষেত্রেই যেন স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতার ছাপ থাকে। প্রকল্পের ব্যয় যেন যৌক্তিক পর্যায়ে বাড়ানো হয়। ৩০০ ভাঙা ঘর যেন ৯ লাখ ঘরকে টেকসই করে দেয়। টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়, ‘দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তবে তো দাগই ভালো।’ ৩০০ ভাঙা ঘর এই প্রকল্পে যে কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছে, তা মুছে গিয়ে যেন সত্যিই তা স্বপ্নের প্রকল্প হয়ে উঠতে পারে। গৃহহীন মানুষ যেন নির্ভাবনায় নিজের ঘরে থাকতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর